” ধর্মগ্ৰন্থ যাহা কিছু ছিল এবং ধর্ম সম্পর্কে যাহা কিছু শুনিতে পাইতাম, তাহা হইল যীশুখ্রীষ্টর গল্পবিষয়ক”।
পাদরীরা,এই সুযোগে, রাস্তার মোড়ে ও বাজারে যাইয়া যীশুর গল্প শুনাইত। বাঙালি পাদরীরা, হেদোর ধারে, কেষ্ট বন্দ্যোর গীর্জার কোণটিতে, রবিবার সকালে যীশুখ্রীষ্টের কথা বলিত, আর হিন্দু দেবদেবীদিগকে গাল পাড়িত।
দাদা একদিন বেলা নয়টার ঐখান দিয়ে আসিতেছিল। সে খানিকক্ষণ পাদরীদের বক্তৃতা শুনিয়া তাহাদের সহিত তর্ক – বিতর্ক করিয়া ঝগড়া শুরু করিল। ঝগড়াটা ক্রমে বাড়িয়া উঠিল। দুই দিকে বেশ দল পাকিল এমন কি, মারামারি হইবার উপক্রম হইল। পরে, দুই দল ঠান্ডা হইলে, দাদা চলিয়া আসিল এবং দুই দলের লোকরাও রাগিয়া চলিয়া গেল।
এই রূপে খ্রীষ্টান পাদরীরা সকলকে খ্রীষ্টান করিবার জন্য বিশেষ প্রয়াস পাইতে লাগিল। ইংরেজ পাদরী ও সহকারী দেশীয় পাদরীর সংখ্যা খুব অধিক বাড়িয়া গিয়াছিল। তাহারা গলির মোড়ে মোড়ে , বাজারে ও নানাস্থানে যাইয়া হিন্দু ধর্ম ও হিন্দু সমাজের কুৎসা ও অসারতা প্রচার করিতে লাগিল। পাদরীরা বলিত যে , গঙ্গাস্নান করা কুসংস্কার ; দাড়ি কামানো কুসংস্কার। এইজন্য আমরা দাড়ি কামাইতাম না। — তাহারা বলিত হিন্দুদের যাহা কিছু আছে, তাহাই কুসংস্কার ; শুধু তাহারা যাহা বলিবে, তাহাই যুক্তিসঙ্গত। হিন্দু ধর্ম মানেই হইল কুসংস্কার, হিন্দু ধর্ম মানেই হইল, যাহা কিছু সব ভুল।
হিন্দু ধর্ম যে কি, তাহা অনেকেই তখন বুঝিত না। হিন্দু ধর্ম সম্বন্ধে কাহারো বিশেষ পড়াশোনা ছিল না, এবং হিন্দু ধর্মের বিষয়ে কোনো গ্ৰন্থও পাওয়া যাইত না। এইজন্য পাদরীদের কথার উত্তর দেওয়াও দুঃসাধ্য ছিল। আবার পাদরীরা ছিল ইংরেজ। পাদরীদের কিছু বলিলে, পাছে হাঙ্গামা হয়, সেইজন্য সাহস করিয়া কেহ বিশেষ কিছু বলিতে পারিত না।
নরেন্দ্রনাথ যে সাহস করিয়া হেদোর ধারে পাদরীদের সহিত তর্ক -বিতর্ক করিয়াছিল, সেরূপ সকলে পারিত না।
য়ুরোপীয় রাজনীতিতে একটি উক্তি আছে ঃ First send the missionaries, then send the merchants and last send the army. ইহার অর্থ এই যে , একটি দেশ জয় করিতে হইলে, প্রথমে ধর্ম – প্রচারকদিগকে পাঠাইবে, পরে বণিকদিগকে এবং সর্বশেষে সৈন্যদলকে পাঠাইবে। ভারতবর্ষেও ঠিক সেরূপ হইয়াছিল। এইজন্য পাদরীদিগকে আমরা সশঙ্কচিত্তে দেখিতাম ; শ্রদ্ধাভক্তির কথা নয়, অতিশয় ভয় করিতাম ; কারণ ভাবিতাম, তাহারা কখন বিপত্তি আনিয়া দিবে।
গ্ৰাম্যভাষায় তখন একটি কথা প্রচলিত ছিল :
জাত মাল্লে পাদরী এসে
প্যাট মাল্লে নীল বাঁদরে।
অর্থাৎ পাদরীরা এসে জাত ও ধর্ম নষ্ট করিল, এবং নীলকররা উদরের অন্ন হরণ করিল।
শ্রীচৈতন্য ও বৈষ্ণব- ধর্মের বিষয়ে আমরা বিশেষ কিছু জানিতাম না। গীতা ও উপনিষদের নাম কেহ শুনে নাই। চন্ডীপাঠ মাত্র কয়েকজন ভট্টাচার্য ব্রাহ্মণ করিতেন। ……. পাদরীরা বাইবেলগুলি বাড়ি বাড়ি দিয়া যাইত, সেইটাই আমাদের কতকটা পড়া ছিল মাত্র।
আবার, এক মত উঠল কোঁতিষ্টদের। ইহাদের মত হইল, ঈশ্বরাদি কিছুই নাই। ইহাদের প্রত্যক্ষবাদী বা Positivist বলা হইত। ব্রাহ্ম- ধর্ম তবু ধর্মের ভিতর ছিল, কিন্তু প্রত্যক্ষবাদীরা সব উড়াইয়া দিত।
কলকাতার যখন এইরূপ অবস্থা, তখন কেশববাবু বক্তৃতা দিতে লাগিলেন। কেশববাবুর বিষয়ে কিছু বলিতে হইলে প্রথমেই বলা আবশ্যক যে, তাহার চেহারা ও মুখশ্রী কার্যকারিতা বা সফলতা লাভে তাঁহাকে বারো আনা ভাগ সাহায্য করিত, এবং বাকি চার আনা ভাগ সাহায্য করিত তাঁহার বাক্য বিন্যাস। কলিকাতার আ্যলবার্ট ইন্সটিটিউটে রক্ষিত ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেনের যে তৈলচিত্র দেখা যায়, তাহাতে শুধু একভাব দেখানো হইয়াছে, কিন্তু কেশববাবুর জীবিত অবস্থায় চেহারা আরো সুন্দর ও ও মাধূর্যপূর্ণ ছিল। চোখের চাহনী ও মুখভঙ্গি — ভক্তি, ঈশ্বর বিশ্বাস, ও ওজস্বীভাবে পরিপূর্ণ ছিল। কেশববাবুকে দেখিয়াছেন এমন লোক যদি আজও জীবিত থাকেন তো, তিনি
নিশ্চয়ই বলিবেন যে, কেশববাবুর চেহারাতে একটি বিশেষ লাবণ্য বা মাধূর্য ছিল, এবং সাধারণ লোক হইতে তাঁহার চেহারার অনেক প্রভেদ ছিল।
পাদরীরা যেমন পাড়ায় পাড়ায় গিয়া বক্তৃতা দিত কেশববাবুও তেমনি পাড়ায় পাড়ায় গিয়া, মধ্যে মধ্যে সভা করিয়া, হিন্দু ধর্ম প্রচার করিতে লাগিলেন।
কেশববাবু প্রথম অবস্থায় ইংরেজীতে বক্তৃতা দিতেন, কিছু দিন পর হইতে বাংলায় বক্তৃতা দেওয়া আরম্ভ করিলেন। …. শিমলাতে মনোমোহনদের এবং নন্দ চৌধুরীর বাড়িতে তিনি সভা করিয়াছিলেন : সমস্ত দেশটা যাতে খ্রীষ্টান না হইয়া যায়, তাহার জন্য তিনি বিশেষ প্রয়াস পাইতে লাগিলেন। প্রথম অবস্থায় তিনি খ্রীষ্ট ধর্ম ও হিন্দু ধর্মের মাঝামাঝি একটি সেতু তৈয়ার করিতে চেষ্টা করিলেন।
যীশুকে তিনি Oriental Christ —
প্রাচ্য দেশীয় যীশু ও তপস্বী যীশু করিয়া দেখাইতে লাগিলেন। তিনি কতকগুলি বক্তৃতা দিলেন। বক্তৃতাগুলিতে তিনি এইরূপ মত প্রকাশ করিলেন যে, বিলাতী হ্যাট কোট ত্যাগ করাইয়া দেশী যীশু করো এবং যীশুবিহীন ধর্ম মানো। কেশববাবু হিন্দু ধর্মের বিগ্ৰহপূজাদি ত্যাগ করলেন, কিন্তু ভক্তির পথ অবলম্বন করলেন। ইহাতে শিক্ষিত লোকের ভিতর খ্রীষ্টান হওয়া কিছু পরিমাণে কমিয়াছিল। ….
কেশববাবুর দলে যোগদান করায়, যদিও মদ খাওয়া ও অন্যান্য সামাজিক দুর্নীতি হইতে আমরা অন্য দিকে যাইলাম ; কিন্তু একদিকে নিরাকার ব্রহ্ম যে কি, তাহা কিছুই বুঝিতাম না, এবং অপর দিকে, ঠাকুর দেবতা ও পুরানো আচার পদ্ধতিও কিছু মানিতাম না।
সমাজের এইরূপ অবস্থাতে আমাদের শৈশব কাটিয়াছিল। সমাজে তখন নাস্তিকতা ও বিশৃঙ্খলার ভাব আসিয়াছিল। অনেক শিক্ষিত যুবক এইরূপ অনিশ্চিত অবস্থায় থাকিয়া, শেষে খ্রীষ্টান হইয়াছিল। কিন্তু আমরা অধিকাংশ যুবক খ্রীষ্ট ধর্ম পছন্দ করিতাম না ও হিন্দু ধর্মও মানিতাম না।
আমরা পুরানো মানিতাম না, নূতন কি করিতে হইবে, তাহাও জানিতাম না। আমরা কোনটা যে ধরিব তাহা যেন স্থির করিতে পারিতেছিলাম না ; মহা অশান্তির ভাব আসিল। যুবকদের মনে প্রচণ্ড আগুন জ্বলিল। কি করিতে হইবে, তাহা কেহই বুঝিতে পারিতেছিল না। পুরানো বাংলা তখন চলিয়া যাইতেছিল এবং নূতন বাংলা আসিতেছিল।
কেশববাবু বাংলাদেশে প্রথম নব ভাব জাগ্ৰত করলেন। তিনি “ব্যান্ড অভ হোপ”( Band of Hope) নামে একটি দল গঠন করিলেন। দলের লোকরা মদ খাইবে না; এমন কি, তামাকও খাইবে না। নরেন্দ্রনাথ এই “আশার দল”এ নাম লিখাইয়াছিল। তবে, এই দলের ভিতর কলিকাতার যুবক তত বেশী ছিল না। পূর্ববঙ্গের অনেক লোক ছিল। …..
একদিকে যেমন মাতালের দল উঠিল, অপর দিকে তেমনি এই ব্যান্ড অভ হোপ্ – এর দল উঠিল। ব্যান্ড অভ হোপ্ – এর দলের কথা ছিল — Touch not, taste not, smell not, drink not anything that intoxicates the brain, —- অর্থাৎ , যাহাতে মস্তিষ্ক উত্তেজিত হয়, এমন জিনিস স্পর্শ, আস্বাদন, আঘ্রাণ বা পান করিও না। এইরূপ দুই দলে দ্বন্দ্ব চলিতে লাগিল।
প্রতাপ মজুমদার, বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী, উমেশ দত্ত, নগেন চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতি সকলে প্রথম অবস্থায় কেশববাবুর সংস্পর্শে আসিয়া নব ভাবে উদ্দীপ্ত হইয়াছিলেন। অবশেষে শাস্ত্রী মশাই, গোঁসাইজী, উমেশ দত্ত, নগেন চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতি সকলে।পৃথক হইয়া ” সাধারণ সমাজ ” স্থাপন করেন।
কিন্তু তাহা হইলেও, কেশববাবুর প্রতি সকলের শ্রদ্ধা- ভক্তি পূর্বের ন্যায় অটল ছিল। আমরাও তাঁহাকে বিশেষ শ্রদ্ধা ভক্তি করিতাম।
সাধারণ সমাজ গঠিত হইলে পর, আমরা সাধারণ সমাজে যাইতে লাগিলাম। সেখানে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী, শিবনাথ শাস্ত্রী, নগেন চট্টোপাধ্যায়, উমেশ দত্ত, প্রভৃতি কয়েকজনের বক্তৃতা শুনিতাম। এইরূপে, যুবকদের মধ্যে ব্রাহ্ম ধর্মের ভাব জাগিয়া উঠিল। পরে যাঁহারা পরমহংস মশাইএর কাছে গিয়াছিলেন, তাঁহাদের মধ্যে অধিকাংশ ব্যক্তিই প্রথমে সাধারণ সমাজে যাতায়াত করিতেন। ….
নরেন্দ্র নাথ ধ্রুপদ গান ভাল করিয়া শিখিলে পর, সাধারণ সমাজে উপাসনার দিন, রাত্রে, মাঝে মাঝে , ধ্রুপদ গান গাহিত। ব্রহ্ম সঙ্গীতেও সে অল্প বয়সে খ্যাতিলাভ করিয়াছিল। ……
এই সময়, নরেন্দ্রনাথ বিশেষ কিছু হিন্দুধর্মগ্ৰন্থ না পাওয়ায়, হার্বাট স্পেন্সার ও মিল — এর গ্ৰন্থসমূহ অত্যধিক পাঠ করিতে লাগিল। নরেন্দ্রনাথ স্পেন্সার ও মিলের গ্ৰন্থ পাঠ করিয়া সকলের সাথে খুব তর্ক করিত। এমন কি, পাদরীদের সহিত সমানভাবে তর্ক করিত। “
লিখেছেন স্বামী বিবেকানন্দের অনুজ মহেন্দ্রনাথ দত্ত।
( শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণের অনুধ্যান ; মহেন্দ্রনাথ দত্ত
দি মহেন্দ্র পাবলিশিং হাউস, সপ্তম সংস্করণ, ১৪০৬)
মহেন্দ্রনাথ দত্তের বইগুলি রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ এবং তাঁদের পারিপার্শ্বিক সম্পর্কে এক সুন্দর ডকুমেন্টেশন। তাঁর লেখায় কোথাও নেই অর্থহীন স্তুতি, অতিরঞ্জন বা ‘অসার আবেগ’।
বরং তা আমাদের সাহায্য করে তখনকার সময়কে, ইতিহাসকে জানতে আর চিনতে। শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু, শিল্প-মহাবিদ্যালয়ের তৎকালীন অধ্যক্ষ শৈলেন দে, মৃৎশিল্পে নতুন ধারার প্রবর্তক নিতাই পাল, সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেছেন, তাঁদের নতুন ভাবধারায় অনুপ্রাণিত করার জন্য তাঁরা মহেন্দ্রনাথের কাছে অশেষভাবে ঋণী।
বাংলা, ইংরেজিতে তাঁর রচিত প্রায় ৮৫ টিরও বেশী গ্রন্থের প্রতিটি পাতায় ছড়িয়ে রয়েছে মণিমুক্তো।
ভগবান রামকৃষ্ণদেব নরেন্দ্রনাথের জীবনের উজ্জ্বল চিত্র প্রত্যক্ষ করে বলেছিলেন, “কেশব যেমন একটা শক্তির বিশেষ বৃদ্ধিতে জগদ্বিখ্যাত হয়েছে, নরেন্দ্রের ভিতর তেমন আঠারটি শক্তি পূর্ণ মাত্রায় বর্তমান”।
একদিন নরেন্দ্রনাথ একটি যুবককে বলিয়াছিল, “ওঁর কাছে যাই, সমাজ বা অন্য বিষয় শেখবার জন্য নয়। এসব বিষয় ওঁর কাছে শেখবার কিছুই নেই। এ সব বিষয় আমি ঢের পড়েছি, ঢের জানি, তবে দেখ,ওঁর কাছে Spirituality —- ব্রহ্মজ্ঞান শিখতে হবে। এটা ওঁর কাছে আশ্চর্য রকম আছে।”
স্বয়ং মা-কালীকে একসময় ঠাট্টা করে যিনি বলতেন—–‘পুত্তলিকা’, একজন নির্মায়া নির্মোহ বৈদান্তিক সন্ন্যাসী, যাঁর কাছে ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্’ ব্রহ্মই ধ্যেয়, সেই স্বামী বিবেকানন্দ শ্রীশ্রীঠাকুরের কৃপালাভে পরবর্তীকালে শুধু দেব-দেবীর পূজাই করলেন না, বেশ কয়েকবার ভক্তিভরে পূজা করলেন একাধিক কুমারীকে।
বিবেকানন্দ ভগিনী নিবেদিতাকে বলেছিলেন, “ওঃ ! মা কালী আর তাঁর লীলাসকলকে আমি কি ঘৃণাই করতুম ! দু’ বছর ধরে আমি ওই নিয়ে ধস্তাধস্তি করেছি, কিছুতে তাঁকে মানব না। কিন্তু শেষে আমাকে মানতেই হল। পরমহংসদেব আমায় তাঁর কাছে উৎসর্গ করেছিলেন, আর এখন আমি বিশ্বাস করি, অতি সামান্য সামান্য কাজেও সেই মা’ই আমাকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, আমায় নিয়ে যা ইচ্ছা তাই করছেন। আমার তখন অতি দুঃসময়। মা সুবিধা পেলেন। তিনি আমায় গোলাম করে ফেললেন। ঠাকুরের নিজ মুখের কথা, “তুই মায়ের গোলাম হবি”। তিনি আমায় মায়ের হাতে সমর্পণ করে দিলেন।”
ঠাকুর ইহজগৎ ত্যাগ করার ঠিক ১৫ দিনের মাথায় ছেড়ে আসতে হয়েছিল কাশীপুর উদ্যানবাঢী। রাখালচন্দ্র ঘোষ, তারকনাথ ঘোষাল, বাবুরাম ঘোষদের নিয়ে পথে নেমে এসেছিলেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত। দায়িত্বটা যে ছিল তাঁরই! কারণ, ঠাকুর নরেনকেই চিহ্নিত করে গিয়েছিলেন নেতা হিসাবে। একটা কাগজের টুকরোয় লিখে দিয়ে গিয়েছিলেন, ” নরেন শিক্ষে দেবে”।
দেহত্যাগ করার আগে বলেছিলেন, নরেনের মধ্যে নিজের সব শক্তি দিয়ে তিনি ফকির হয়ে গিয়েছেন।
বরাহনগরে বাগানবাড়িতে কোনমতে মাথা গোঁজার পর এল প্রতিরোধ।
“বরাহনগর মঠ যখন প্রথম স্থাপিত হয় তখন কলিকাতা শহরে খ্রীষ্টানদিগের বড়ই প্রাদুর্ভাব। চৌমাথায়, গলির মোড়ে, হাটেবাজারে খ্রীষ্টান পাদরীরা দাঁড়াইয়া লেকচার দিত এবং হিন্দুধর্মের নিন্দাগ্লানি করিত। পুরুষ ছাড়া, মেয়ে একদল তাঁরা সৃষ্টি করিল — দেশী স্ত্রীলোক, দশটার সময় বাহির হইত, একহাতে একখানি বাইবেল, মাথায় ছাতি দিয়া সব লোকের বাড়িতে যাইয়া বাইবেল শোনাইত — সেলাই করা শিখাইবে ও খ্রীষ্টান করিবে এইজন্য তাহারা সমস্ত বাঙ্গালী পাড়াটি ঘুরিয়া বেড়াইত। তাহাদের সংখ্যা অনেক ছিল ; সাধারণ লোকেরা তাহাদের “ছাতিওয়ালী” বলিত।
১৮৮১ সালে স্যালভেশন আর্মি বা ( মুক্তি ফৌজ)
প্রথম কলিকাতায় আসে। বিডন স্ট্রীটে বেঙ্গল থিয়েটারটি ভাড়া লইয়া তাহারা বক্তৃতা আরম্ভ করিল। অপরাহ্নবেলা তাহারা থিয়েটার বাড়িটিকে স্যালভেশন আর্মির আড্ডা করিত এবং রাত্রে যেমন নাচঘর তেমনি হইত। ইংরেজি কাপড় ছাড়িয়া তাহারা দেশী কাপড় পরিলেন এবং গৈরিকবসন পরিতে আরম্ভ করিলেন। তারপর তাঁহারা ইংরাজ রমনী আনিয়া দেশী কাপড় পরাইয়া বিডন স্কোয়ারে বক্তৃতা দেওয়াইয়া লইয়া যাইতেন। বরানগরের বাজারের নিকট যে তেমাথাটি আছে সেই রাস্তার উপর তাঁহারা একটি আড্ডা বা ” যীশুখানা” খুলিলেন। তাঁহাদিগের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্থানগুলিকে লোকে “যীশুখানা” বলিত।
যাহা হউক, তাহারা খবর পাইল যে বরাহনগরে কতকগুলি যুবক একটি বাড়িতে থাকে, বিবাহ করে নাই এবং বেশ ঈশ্বরানুরাগী। এইসব ছোঁড়াদের যদি একবার জালে ফেলে খ্রীষ্টান করানো যায় তবে ব্যবসাটা বেশ জবর চলিতে পারে। প্রথম তারা দুটি দেশী লোককে পাঠাইল, কিন্তু নাম ইংরাজী। এখন আর তাহাদের নাম স্মরণ নাই। …. দুটি খ্রীষ্টান প্রথমে অতি ভক্তি দেখাইয়া বাইবেল খুলিয়া যীশুর কথা শুনাইতে লাগিল। কিছুদিন যাতায়াত করিয়া বেশ একটু ঘনিষ্ঠতা স্থাপন করিবার চেষ্টা করিল। খুব ভক্তি দেখাইত। এবং যীশুর প্রতি কতই ভক্তি ! ক্রমে ক্রমে তাঁদের স্বরূপ ফুটিতে লাগিল। তখন তাহারা একদিন শশী মহারাজ প্রভৃতিকে খ্রীষ্টান হইবার জন্য প্রস্তাবনা করিল এবং বলিল, যীশু ভিন্ন অপর কেউ মুক্তি দিতে পারে না এবং আলোক প্রদান করতে পারে না। যাহা হউক, অনেকক্ষণ পর্যন্ত ধর্মের বাদানুবাদ চলিতেছিল। যখন বুঝিল যে সন্ন্যাসী যুবকবৃন্দ বেশ ভালরকম বাইবেল জানেন এবং বাইবেলের ত্যাগ, বৈরাগ্য ও ঈশ্বরনিষ্ঠা তাঁহারা সকলেই আচরণ করিতেছেন এবং সেই মহান উদ্দ্যেশ্যে জীবন উৎসর্গ করিয়াছেন,….. তখন তাহারা যুবক সন্ন্যাসীদিগকে খ্রীষ্টান করিবার জন্য অন্য উপায় অবলম্বন করিল। তাহারা স্পষ্টাস্পষ্টি বলিতে লাগিল, ” অনেক যুবতী বিলাতী মেম আসিয়াছে, তাহাদের সহিত বিবাহ করাইয়া দিব, তোমরা খ্রিষ্টান হও।” শশী মহারাজ এই কদর্য কথা শুনিয়া একেবারে রাগে অগ্নিশর্মা হইয়া উঠিলেন এবং তাহাদিগকে ভর্ৎসনা করিয়া বিদায় করিয়া দিলেন এবং আর কখনও তাহাদের আসতে দিতেন না। বরাহনগরের বাজারের কাছে যে আড্ডাটি খুলিয়াছিল সেটিও বন্ধ হইয়া গেল। তাহার পর তাহাদের বিষয় বিশেষ কিছু আর জানা যায় না।”
শ্রীমৎ স্বামী বিবেকানন্দের জীবনের ঘটনাবলী, প্রথম খন্ড, দি মহেন্দ্র পাবলিশিং হাউস, ষষ্ঠ সংস্করণ, ১৪০৫)
যীশুখ্রীস্টের প্রতি স্বামীজীর সারাজীবন অগাধ শ্রদ্ধা এবং ভক্তি ছিল। তিনি যীশুকে একজন ঈশ্বরাবতার বলেই মানতেন। তাঁর গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ নিজে খ্রীস্টমতে সাধনা করেছেন। দক্ষিণেশ্বরে তাঁর ঘরের দেওয়ালে টাঙ্গানো ম্যাডোনার কোলে যীশুর ছবিটি এখনো গেলে দেখতে পাওয়া যায়। রামকৃষ্ণ মিশনে যীশুপুজোর সময়, সেই ছবিটির অনুরূপ ছবিই প্রধানত পূজিত হয়।
স্বামী বিবেকানন্দ নিজে কি কোনদিন যীশুপুজো করেছিলেন?” সেই উত্তরের সন্ধানে কী তথ্য পাওয়া যাচ্ছে দেখা যাক।
“একবার বড়দিনের অনুষ্ঠান। বেলুড় মঠে প্রভু যীশুর জন্ম-স্মরণে স্বামীজী কতিপয় সন্ন্যাসী-ব্রহ্মচারী ও ভক্তবৃন্দকে নিয়ে শান্তভাবে সন্ধ্যার পর আনন্দোৎসব করলেন। তাঁর ঘরের বারান্দায় ‘ঈশ্বর পুত্রের’ একখানি আলেখ্য টেবিলের উপর মালা দিয়ে সাজানো হলো। সামনে কেক, বিস্কুট, নানাপ্রকার ফল নৈবেদ্য। স্বামীজী বাঙলায় সেই প্রাচীন মহনীয় যুগাচার্যের কাহিনী বললেন। সম্ভবতঃ শরৎ মহারাজ বাইবেল পাঠ করলেন।
নিবেদিতাও এই উৎসবে যোগ দেন। তিনি ইংরেজীতে কিছু বললেন। এই শুভতিথিতে বিশেষ করে শিশু ও বালকদের উপঢৌকন দেবার জন্য পাশ্চাত্যরীতিতে একটি ‘ক্রীসমাস ট্রি’ নানাবিধ মনোহারী জিনিস দিয়ে সাজালেন। যেসব বালক বেলুড়ে ছিল, নিবেদিতা তাদের সকলকে এক-একটি উপহার নিজ হাতে দিলেন।”
স্বামীজী প্রবলভাবে যেটার বিরোধিতা করেছেন, সেটা হল চার্চের প্রচারিত খ্রীস্টধর্ম, তাঁদের কনভার্সান পলিসি এবং সেই প্রভাবে দেশী সাহেব হয়ে যাওয়ার সমকালীন সংস্কৃতিকে।
এবং একক প্রচেষ্টায় তিনি সেই কনভার্সান অনেকটাই আটকে দিয়েছিলেন।
চার্চের প্রচারিত খ্রীস্টধর্মের থেকে প্রকৃত যীশুখ্রীস্টকে বের করে এনে তিনি মানুষকে দেখাতে চেয়েছিলেন, এই দু’য়ের মধ্যে কত তফাৎ।
সেই উদ্দেশেই বরানগর মঠে থাকাকালীনই তিনি, টমাস এ. কেম্পিসের লেখা, খ্রীস্টানদের বিখ্যাত গ্রন্থ “The Imitation of Christ”-এর বঙ্গানুবাদের কাজ (“ঈশানুসরন”) শুরু করেছিলেন এবং সেখানে যীশুর শিক্ষার সাথে ভারতীয় সংস্কৃতির শিক্ষার কোথায় কোথায় সাদৃশ্য, সেই সবকিছু ধরে ধরে দেখিয়েছিলেন। ভারত পরিভ্রমণকালে এই পুস্তকটি তিনি সর্বদা সাথে রাখতেন।
আজও যখন বেলুড় মঠ সহ রামকৃষ্ণ মিশনের বিভিন্ন শাখায় ক্রিস্টমাস ইভে যীশুপুজোর সময় বাইবেলের নির্বাচিত কিছু অংশ পাঠ করা হয়, তখনও তার সাথে সনাতন ধর্মের সাদৃশ্য বিচার করে আলোচনা করা হয়। তাই এটিও স্বামী বিবেকানন্দ প্রদর্শিত পথেরই অনুসরণ।
একথা ঐতিহাসিক সত্য, খ্রীষ্টান আগ্রাসনে একসময় হিন্দুধর্মের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেছে।
তেমনি আরও একটি ঐতিহাসিক সত্য হল—খ্রীস্টান আগ্রাসনের হাত থেকে হিন্দুধর্মের সবথেকে বড় রক্ষাকর্তা স্বামী বিবেকানন্দ স্বয়ং।
তিনি নিজে পাশ্চাত্যে খ্রীষ্টান মিশনারিদের অনেক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, এবং সিংহবিক্রমে সেসবের সাথে এককভাবে লড়াই করে খ্রীষ্টানদের দুর্গে গিয়ে ভারতের সনাতন ধর্মের বিজয়পতাকা উড়িয়েছেন—এসব কথা তাঁর জীবনী পড়া মানুষমাত্রই জানেন।
কিন্তু তারপরও যীশুর প্রতি একবারের জন্যও তিনি কোন অশ্রদ্ধা প্রকাশ করেন নি, বা এইসবকিছুর জন্য যীশুখ্রীস্টের জীবন, বাণী বা কাজকে দায়ী করেন নি—আন্তরিক ভাবেই তিনি যীশুকে, মা মেরীকে শ্রদ্ধা করতেন।
“হিন্দু ও খ্রীষ্টান” শীর্ষক বক্তৃতাতেই তিনি খ্রীস্টধর্মের আগ্রাসী, আক্রমণাত্মক, অসহিষ্ণু, হিংস্র, রক্তক্ষয়ী ইতিহাসের অত্যন্ত কঠোর সমালোচনা করেছেন—আর তারপর যীশুর কথা উদ্ধৃত করে দেখিয়েছেন, ওটা যীশুর পথ নয়।
স্বামীজি বেদান্ত প্রচার করেছেন এবং বলেছেন, ঈশ্বরকে ধরে রেখে কর্ম কর। তবে আমাদের মত দরিদ্র দেশ প্রথমেই ফল ত্যাগ করতে পারবে না। ভোগ করলে তবেই না ত্যাগ । যার কিছু নেই, সে কি ত্যাগ করবে? তাই আগে পেটপুরে অন্ন। তারপরের ধাপ হল ধর্ম বা ত্যাগ।
শিকাগোর ধর্ম মহাসভায় অতুলনীয় কীর্তির পর বিবেকানন্দের বিরুদ্ধে চরম বিষোদ্গার চলতে থাকে।
স্বামীজীর আরেক সহোদর ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত লিখছেন,
” বিস্ময়ের কথা এই, স্বামী বিবেকানন্দের ন্যায় অপর কোন হিন্দুধর্মপ্রচারক এত নিন্দাবাদ ও কটুক্তির সম্মুখীন হননি। স্বদেশে রক্ষণশীলরা তাঁকে আক্রমণে জর্জরিত করেছিলেন। অপরদিকে বিদেশেও বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ের লোকেরা তাঁর কাল্পনিক ব্যর্থতার তাঁকে নিন্দাবাদ করেছিলেন।…..
স্বামীজীর বিরুদ্ধে সবচেয়ে জঘন্য নিন্দাবাদ হয় শিকাগোতে। পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের ধ্বজাধারী খ্রীষ্টান মিশনারী প্রতিষ্ঠানসমূহ ভারতের এই পৌত্তলিকদের উত্থান ভাল চক্ষে দেখেনি। কারণ এখানেই ছিল তাদের শোষণের ক্ষেত্র।…..
আমি যখন আমেরিকায় ছিলাম তখন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে আমেরিকাবাসীদের দৃষ্টি ভিন্নপথে পরিচালিত করবার জন্য খ্রীষ্টান ধর্মপ্রচারকরা হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধে নানাবিধ কুৎসা প্রচার করতেন। তাছাড়া অনেক ভাড়াটে ভারতীয়ও হিন্দুধর্ম ও ভারতবর্ষের নিন্দাবাদ করত। ১৯১৪ পর্যন্ত আমেরিকায় এই ধরনের অপপ্রচার চলত, এ আমার নিজের অভিজ্ঞতা।”
পৃষ্ঠা; ১৭৪ -১৭৫
স্বামী বিবেকানন্দ ; ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত
র্যাডিকাল ইম্প্রেশন, প্রকাশকাল ; ২০১৯
” জগতের কাছে আমি ভিক্ষা লইতে আসি নাই, আমি জগৎকে ভিক্ষা দিব, আমার অফুরন্ত ভান্ডার আছে, এই ছিল নরেন্দ্রনাথের আশৈশব ভাব।” বলছেন অনুজ মহেন্দ্রনাথ।
“বীরভোগ্যা বসুন্ধরা — বীর্য প্রকাশ কর, সাম-দান-দন্ডভেদ-নীতি প্রকাশ কর, পৃথিবী ভোগ কর, তবে তুমি ধার্মিক। আর ঝাঁটা-লাথি খেয়ে চুপটি ক’রে ঘৃণিত-জীবন যাপন করলে ইহকালেও নরক-ভোগ, পরলোকেও তাই। এইটি শাস্ত্রের মত। সত্য, সত্য, পরম সত্য-স্বধর্ম কর হে বাপু! অন্যায় ক’রো না, অত্যাচার ক’রো না, যথাসাধ্য পরোপকার করো। কিন্তু অন্যায় সহ্য করা পাপ, গৃহস্থের পক্ষে; তৎক্ষণাৎ প্রতিবিধান করতে চেষ্টা করতে হবে।”
— স্বামী বিবেকানন্দ
(প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য, “ধর্ম ও মোক্ষ”)
রামকৃষ্ণদেব বাংলার পালাগান, প্রবাদ-প্রবচন, লোকসংস্কৃতিকেই ব্যবহার করে আমাদের স্বদেশ ও সংস্কৃতির জন্য প্রতিরোধব্যবস্থা তৈরী করে দিয়ে গেছেন। তৈরী করেছেন আস্থার দুর্গ, citadel of faith.
স্বামী বিবেকানন্দের মতে, ” শ্রীরামকৃষ্ণের মতো এত উন্নত চরিত্র কোন কালে কোন মহাপুরুষের হয় নাই; সুতরাং তাঁকেই কেন্দ্র করে আমাদিগকে সঙ্ঘবদ্ধ হতে হবে; অথচ প্রত্যেকের তাঁকে নিজের ভাবে গ্ৰহণ করার স্বাধীনতা থাকবে-কেউ আচার্য বলুক,কেউ পরিত্রাতা,কেউ ঈশ্বর,কেউ আদর্শ পুরুষ,কেউ বা মহাপুরুষ- যার যা খুশি।”
“কথামৃত” যার বাণী, সেই ঠাকুর রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দকে বলেছিলেন শুষ্ক পুঁথি দিয়ে কিছু হবে না। চাই ভক্তি, কর্ম, জ্ঞান, সেবা।
ব্রাহ্মদের প্রথম দুটি দল অর্থাৎ দেবেন ঠাকুর এবং কেশব সেনের গোষ্ঠী হিন্দুধর্মের সমস্ত আচার মানতেন যেমন উপনয়ন, নিজের বর্ণে বিবাহ, বেদবেদান্ত চর্চা প্রভৃতি।
তবে এঁদের গতিবিধি সীমাবদ্ধ ছিল কলকাতা ও অন্যান্য শহুরে অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে।
এঁদেরই একাংশ কংগ্রেসের কেষ্টবিষ্টু হয়ে উঠেছিলেন।
তৎকালীন কংগ্রেস ছিল ব্রিটিশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি জনসাধারণের ক্রোধ প্রশমনের একটি মঞ্চ।
সেখানে শ্বশুরের পয়সায় বিলাত ঘুরে আসা ব্রাহ্ম আমলা/বুদ্ধিজীবীরা দেশের গরীব চাষাভুষা মানুষদের ডেকে এনে ইংরেজিতে বক্তৃতা দিত আর সেই সব অনাহার ক্লিষ্ট মানুষদের সামনে পঞ্চ ব্যঞ্জন সহকারে ভুরিভোজন সারত।
ঔপনিবেশিক, বুর্জোয়া, সংসদীয় রাজনীতির হাতেখড়ি তখন থেকেই। এই ব্যবস্থাকে আমাদের পরাধীন দেশের ঔপনিবেশিক বাস্তুতন্ত্রে ( Colonial Ecosystem ) শোষণের একটি হাতিয়ার বলা যায়।
রবীন্দ্রনাথও এই কারণে কংগ্রেসের কার্যপদ্ধতিতে ক্ষুব্ধ ছিলেন। বিবেকানন্দ প্রকাশ্যে কংগ্রেসের সমালোচনা করে বলেছিলেন কংগ্রেসের উচিত পূর্ণ স্বরাজের দাবি জানানো।
“ভারতের লোকগুলো কংগ্রেস কংগ্রেস ক’রে মিছামিছি হৈ চৈ করছে কেন? কতকগুলো হাউড়ো লোক এক জায়গায় জুটে কেবল গলা-বাজি করলেই কি কাজ হয়? চেপে বসুক, নিজেদের independent ব’লে declare করুক, হেঁকে বলুল, ‘আজ থেকে আমরা স্বাধীন হলাম’, আর সমস্ত স্বাধীন Government কে নিজেদের Declaration–পত্র পাঠিয়ে দিক; তখন একটা হৈ চৈ উঠবে।”
― লন্ডনে স্বামী বিবেকানন্দ/মহেন্দ্রনাথ দত্ত/প্রথম খণ্ড (মহেন্দ্র পাবলিশিং কমিটি, ১৯৩১)/কংগ্রেস ও ভারতের দাবী/পৃষ্ঠা-১৯০)
ভারতের সহনশীল আত্মাকে স্বামীজী সঠিকভাবে চিনেছিলেন। তিনি বলেছেন,
“জগতে যতটুকু পরধর্ম-সহিষ্ণুতা ও ধর্মভাবের প্রতি সহানুভূতি আছে, কার্যতঃ তাহা এইখানেই — এই আর্যভূমিতেই বিদ্যমান, অপর কোথাও নাই। কেবল এখানেই হিন্দুরা মুসলমানদের জন্য মসজিদ ও খ্রীষ্টানদের জন্য র্গিজা নির্মাণ করিয়া দেয়, আর কোথাও নহে। যদি তুমি অন্য কোন দেশে গিয়া মুসলমানদিগকে বা অন্যধর্মাবলম্বিগণকে তোমার জন্য একটি মন্দির নির্মাণ করিয়া দিতে বল, দেখিবে তাহারা কিরূপ সাহায্য করে! তৎপরিবর্তে তোমার মন্দির এবং পারে তো সেই সঙ্গে তোমার দেহমন্দিরটিও তাহারা ভাঙিয়া ফেলিবার চেষ্টা করিবে। “
(কলম্বোর ফ্লোরাল হল-এ প্রদত্ত বক্তৃতা, ১৫ জানুয়ারী ১৮৯৭, বাণী ও রচনা, পঞ্চম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯)।
‘প্রবুদ্ধ ভারত’ নামক ইংরেজি পত্রিকার সম্পাদকের আদেশে জনৈক সাংবাদিক স্বামী বিবেকানন্দকে অন্যধর্মাবলম্বীদের হিন্দুধর্ম গ্রহণ প্রসঙ্গে তাঁর মতামত জানতে চান। তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ, বেলুড় মঠের নিকট গঙ্গাবক্ষে নৌকার ছাদে বসে সাংবাদিকের সাথে তার শাস্ত্রীয় শুদ্ধিযজ্ঞ এবং বর্তমানকালের পরিভাষায় ধর্মান্তর প্রসঙ্গে এক সুবিস্তৃত কথোপকথনের হয় স্বামীজীর। সেই আলোচনাটিই ‘হিন্দু ধর্মের সীমানা’, নামের প্রবন্ধে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল সংখ্যায় ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ পত্রিকায় ছাপা হয়। পরবর্তীতে স্বামীজীর বাণী ও রচনা, নবম খণ্ডতে ‘হিন্দু ধর্মের সীমানা’ নামে অত্যন্ত মূল্যবান সাক্ষাৎকারটি সংকলিত হয়।
‘প্রবুদ্ধ ভারত’ নামক ইংরেজি পত্রিকার জনৈক সাংবাদিক প্রথমেই জিজ্ঞাসা করেন, “স্বামীজী, যাহারা হিন্দুধর্ম ছাড়িয়া অন্য ধর্ম গ্রহণ করিয়াছে, তাহাদিগকে হিন্দুধর্মে পুনর্গ্রহণ-বিষয়ে আপনার মতামত কি জানিবার জন্য আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছি। আপনার কি মত, তাহাদিগকে আবার গ্রহণ করা যাইতে পারে?”
স্বামীজী বলিলেন, “নিশ্চয়। তাহাদের অনায়াসে গ্রহণ করা যাইতে পারে, করা উচিতও।”
স্বামী বিবেকানন্দ মুহূর্তকাল গম্ভীরভাবে চিন্তা করে আবার বলতে শুরু করিলেন:
“আর এক কথা তাহাদিগকে পুনর্গ্রহণ না করিলে আমাদের সংখ্যা ক্রমশঃ হ্রাস পাইবে। যখন মুসলমানেরা প্রথমে এদেশে আসিয়াছিলেন, তখন প্রাচীনতম মুসলমান ঐতিহাসিক ফেরিস্তার মতে ভারতে ৬০ কোটি হিন্দু ছিল, এখন আমরা বিশ কোটিতে পরিণত হইয়াছি। আর, কোন লোক হিন্দুসমাজ ত্যাগ করিলে সমাজে শুধু যে একটি লোক কম পড়ে, তাহা নয়; একটি করিয়া শত্রু বৃদ্ধি হয়।”
কি চেয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ ?
স্বামী বিবেকানন্দের সহোদর মহেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর
” শ্রীমৎ বিবেকানন্দ স্বামীজীর জীবনের ঘটনাবলী ( তৃতীয় খন্ড ) ” গ্ৰন্থে লিখেছেন,
” স্বামীজী আলমবাজার মঠে একখানি পত্রে লেখেন যে , বাঙ্গলা দেশে মত বৈষ্ণব সম্প্রদায় ও যেখানে যেখানে যত ক্ষুদ্র সম্প্রদায় আছে তাহাদের সকলকে একত্রিত করিয়া সমষ্টি হিন্দুসঙ্ঘ কর। শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্ত যেখানে আছেন, ও যে যে ভাবের সাধক হউন না কেন তাহারা সকলে মিলিত হইয়া এক উদ্দেশ্যে যেন চলেন। ” ( পৃষ্ঠা : ৮০ )
” তাই বলছি, দেশটাকে এখন তুলতে হলে মহাবীরের পূজা চালাতে হবে, শক্তিপূজা চালাতে হবে, শ্রীরামচন্দ্রের পূজা ঘরে ঘরে করতে হবে। তবে তোদের এবং দেশের কল্যাণ। নতুবা উপায় নেই।”
(স্বামী-শিষ্য সংবাদ ২৪, বেলুড় মঠ, ডিসেম্বর ১৮৯৮, বাণী ও রচনা, নবম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৪৫)।
আমাদিগকে একটি মন্দির নির্মাণ করিতে হইবে — কারণ হিন্দুগণ সকল কাজেরই প্রথমে ধর্মকে লইয়া থাকে। তোমরা বলিতে পার, ঐ মন্দিরে কোন্ দেবতার পূজা হইবে— এই বিষয় লইয়া বিভিন্ন সম্প্রদায় বিবাদ করিতে পারে। এরূপ হইবার কিছুমাত্র আশঙ্কা নাই। আমরা যে মন্দির প্রতিষ্ঠা করিবার কথা বলিতেছি, উহা অসাম্প্রদায়িক হইবে, উহাতে সকল সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠ উপাস্য ওঙ্কারেরই কেবল উপাসনা হইবে। যদি কোন সম্প্রদায়ের ওঙ্কারোপাসনায় আপত্তি থাকে, তবে তাহার নিজেকে ‘হিন্দু’ বলিবার কোন অধিকার নাই।
বাণী ও রচনা, পঞ্চম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৫৪)।
” এদেশে সেই বুড়ো শিব বসে আছেন, মা কালী পাঁঠা খাচ্ছেন, আর বংশীধারী বাঁশী বাজাচ্ছেন।… ঐ বুড়ো শিব ডমরু বাজাবেন, মা কালী পাঁঠা খাবেন, আর কৃষ্ণ বাঁশী বাজাবেন—এ দেশে চিরকাল। যদি না পছন্দ হয়, সরে পড় না কেন? তোমাদের দু-চারজনের জন্য দেশসুদ্ধ লোককে হাড়-জ্বালাতন হতে হবে বুঝি ? ঐ বুড়ো শিবের অন্ন খাবেন, আর নিমকহারামী করবেন, যীশুর জয় গাইবেন—আ মরি।”
(বাণী ও রচনা, ষষ্ঠ খন্ড, পৃষ্ঠা ; ১১৮- ১১৯)
পোস্ট ; ঋতুপর্ণ বসু।