“সবই ব্যাদে আছে” – মেঘনাদ সাহা (প্রবন্ধের কিয়দংশ)
“অনেক পাঠক আমার প্রথম প্রবন্ধে “সবই ব্যাদে আছে” এইরূপ লিখায় একটু অসন্তষ্ট হইয়াছেন। অনেকে ধরিয়া লইয়াছেন যে আমি ‘বেদের’ প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করিয়াছি। কিন্তু এই ধারণা ঠিক নয়। প্রায় ১৮ বৎসর পূর্বেকার কথা আমি তখন প্রথম বিলাত হইতে ফিরিয়াছি। বৈজ্ঞানিক জগতে তখন আমার সামান্য কিছু সুনাম হইয়াছে। ঢাকা শহর নিবাসী কোনো লব্ধ প্রতিষ্ঠিত উকিল আমি কি বৈজ্ঞানিক কাজ করিয়াছি জানিবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। আমি প্রথম জীবনের উৎসাহভরে তাঁহাকে আমার গবেষণা সম্বন্ধে সবিশেষ বর্ণনা দেই। তিনি দুই-এক মিনিট পর পরই বলিয়া উঠিতে লাগিলেন’ এ আর নতুন কি হইল, এ সমস্তই ব্যাদে আছে।” আমি দুই একবার মৃদু আপত্তি করিবার পর বলিলাম “মহাশয়, এ সব তত্ত্ব বেদের কোন অংশে আছে অনুগ্রহপূর্বক দেখাইয়া দিবেন কি?” তিনি বলিলেন আমি তো কখনো ব্যাদ পড়ি নাই, কিন্তু আমার বিশ্বাস,তোমরা নূতন বিজ্ঞানে যাহা করিয়াছ বলিয়া দাবি কর সমস্তই ‘ব্যাদে’ আছে। অথচ এই ভদ্রলোক বিদ্যালয়ের উচ্চতম পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হইয়াছিলেন।

বলা বাহুল্য যে বিগত কুড়ি বৎসরে বেদ, উপনিষদ,পুরাণ ইত্যাদি সমস্ত হিন্দু শাস্ত্রগ্রন্থ এবং হিন্দু জ্যোতিষ ও অপরাপর বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় প্রাচীন গ্রন্থাদি তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিয়া আমি কোথাও আবিষ্কার করিতে সক্ষম হই নাই, যে এই সমস্ত প্রাচীন গ্রন্থে বর্তমান বিজ্ঞানের মূলতত্ত্ব নিহিত আছে। বাস্তবিক পক্ষে বর্তমান বিজ্ঞান গত তিনশত বৎসরের মধ্যে ইউরোপীয় পণ্ডিতগণের সমবেত গবেষণা, বিচারশক্তি ও অধ্যাবসায় প্রসূত। একটা দৃষ্টান্ত দিতেছি, এদেশে অনেকে মনে করেন ভাস্করাচার্য একাদশ শতাব্দীতে অতি অস্পষ্ট ভাবে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন সুতরাং তিনি নিউটনের সমতুল্য। অর্থাৎ নিউটন নুতন কি করিয়াছে? কিন্তু এই সমস্ত ‘অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী’ শ্রেণীর তার্কিকগণ ভুলিয়া যান যে ভাস্করাচার্য কোথাও পৃথিবী ও অপরাপর গ্রহ সূর্যের চতুর্দিকে বৃত্তাভাস (elliptical) পথে ভ্রমণ করিতেছে একথা বলেন না। তিনি কোথাও প্রমাণ করেন নাই যে, মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ও গতিবিদ্যার নিয়ম প্রয়োগ করিলে পৃথিবীর ও অপরাপর গ্রহের ভ্রমণ কক্ষ নিরুপন করা যায়। সুতরাং ভাস্করাচার্য বা কোনো হিন্দু, গ্রীক বা আরবী পণ্ডিত কেপলার-গ্যালিলিও বা নিউটনের বহুপূর্বেই মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব আবিষ্কার করিয়াছেন, এরূপ উক্তি পাগলের প্রলাপ বই কিছুই নয়। দুঃখের বিষয় দেশে এইরূপ অপবিজ্ঞান প্রচারকের অভাব নাই, তাঁহারা সত্যের নাম নির্জলা মিথ্যা প্রচার করিতেছেন মাত্র।

একথা বলিয়া দিতে হইবে না যে লেখক বেদকে মনুষ্যপ্রণীত মনে করেন। যাঁহারা বেদকে ‘অপৌরষেয়’ মনে করেন তাঁহাদের জন্য এই প্রবন্ধ লিখিত নয়।”

আজ এই মহান বিজ্ঞানীর জন্মদিবসে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক একটি স্মৃতিচারণা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.