তখন তাচ্ছিল্য করে কেউ কেউ ‘কল্যাণ সিং’ বলে ডাকতেন। তাতে অপমানিত তো হতামই না, অসম্ভব খুশি হতাম। নিজের নাম ‘কল্যাণ’ হওয়ায় যথেষ্ট গর্ব ছিল। কল্যাণ সিং তখন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী, হিন্দু-অস্মিতার এক অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। আর ততোধিকই নিন্দিত বাংলার কমিউনিস্ট অলিগলিতে, পাড়া-মহল্লায়।
তখন সিপিএমের প্রবল-প্রতাপ। পার্টির ইশারা না থাকলে গাছের পাতাও নড়ে না। ‘বিজেপি’-র নাম নেওয়া, ‘শ্রীরাম’ উচ্চারণ করা তখন বামপন্থীয় ‘মহাপাপ’ বলে গণ্য। পন্থীয় দাদাদের কাছে পাড়ার প্রতিটি ‘গোলমেলে’ যুবকের নামে হিসেবের খাতা মজবুত থাকত। কার সঙ্গে সে কথা কইছে, কে কবে কখন কার সঙ্গে দেখা করতে এইছে — এসব বিষয় টীকাটিপ্পনীসহ নিখুঁতভাবে লেখা থাকতো। তাদেরই কারো কারো মতে, “কল্যাণ আগে ছিল ‘বামুন’, এখন হয়েছে ‘হিঁদু’।” তখন কালীভক্ত-কমরেড, শিবভক্ত-পার্টিদরদী প্রকাশ্যে ‘ঠাকুর প্রণাম’ করতেও দ্বিধাবোধ করতেন, পাছে পার্টি-প্রমোশন বন্ধ হয়ে যায়!
তখন কোনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না আমি। কিন্তু রাজনীতির প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল। চায়ের দোকানে দোকানে তখন ‘আজকাল’ আর ‘গণশক্তি’ পত্রিকা রাখা হত। যারা ‘হিঁদু’ আখ্যায়িত, তারা সেই কাগজই পড়তেন ‘উল্টো করে’। কোন্ খবর গ্রহণ-বর্জন করতে হবে তার একটি আটপৌরে হিসেব ছিল তাদের — “না মানে হ্যাঁ”। ওই কাগজগুলি যাদের যাদের প্রত্যহ গালাগালি করতো, তাদেরকেই ‘হিরো’ বানাতেন তারা। সেই সময় রাষ্ট্রবাদীরা এইভাবে কাগজ পড়ার একটি পোষাকি-নাম দিয়েছিল, “উল্টো বুঝলি রাম” ভাবে কাগজ পড়া। ‘তালিবানি’ শাসনে বাংলাতেও সেভাবেই কাগজ পড়া এবং নিউজ চ্যানেল দেখার অভ্যাস করা উচিত আজ প্রতিটি বাঙালির।
তখন ‘শ্রীরাম’ মানে খৈনিখোর খোট্টাদের দেবতা, ‘বিজেপি’ মানে বর্বর। সুযোগ পেলেই সিপিএমের কাছে বিজেপির কার্যকর্তারা উত্তম-মধ্যম আহার পেতেন। করসেবকেরা ছিলেন তাদের কাছে ‘সাতখুনের দোষী’। বিজেপি-আরএসএসের কর্মী সমর্থকেরা ‘প্রগতিশীল বামপন্থী’-দের কাছে ‘অসভ্য-জানোয়ার’, মানুষ হিসাবেই গণ্য হতেন না। রাম দারোয়ানরা ‘রামাহৈ’ বলে রাত-পাহারা দিতে সাহস করতেন না।
সবকিছুর পরেও অন্তরঙ্গে হিন্দু-সংস্কারিত মানুষের ভেতরে ভেতরে অবস্থান করতেন ভগবান শ্রীরামচন্দ্র। সুযোগের সন্ধানে পার্টির তল্পিবাহক হলেও দলের মধ্যে রামনাম জিওল মাছের মতো বেঁচে ছিল। তারাই রগড়ে রগড়ে মনের ভেতর ‘কল্যাণ সিং’ কে শ্রদ্ধা করতেন। “তিনি বেশ করেছেন, তিনি ঠিক করেছেন। অযোধ্যারই তো রঘু।” আমার মতো অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও তাই — “কবি, তব মনোভূমি/রামের জনমস্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।” ফলে ‘কল্যাণ সিং’ বলে কেউ আমায় ডাকলে ‘বর্বর’-বোধ হবার বদলে ‘সর্দার’-বোধই হত। কল্যাণ সিং ছিলেন হিন্দু জাগরণের এক নবোত্থানের নাম। ফলে তার দলই আমার দল। তিনি রামের দলে, আমিও তাই। সে জাগরণ যে কতটা গভীর ছিল বর্তমানের রাষ্ট্রবাদী মানুষ, যখন তাদের বয়স ন্যূনতম আঠারো-বিশ, তারাই জানেন। কল্যাণ সিং তাদের মন থেকে কখনও ভুলে যাওয়ার নয়। কল্যাণ সিং-কে ভারতের রামভক্ত মানুষ চিরকাল মনে রাখবেন। কল্যাণ সিং অযোধ্যা নগরীতে বারেবারে জন্মাবেন। রাম-মন্দিরের চির-প্রদীপের সলতে পাকাবেন। জয় শ্রীরাম। জয় রঘুবীর, শ্রীরামচন্দ্র।
কল্যাণ গৌতম।