নামেই আভাস ছিল, গানগুলি কালজয়ী হবে।
কুমারত্ব অটুট যে গলার, যে গলার বয়স আর বাড়েনি, যে গলায় বাসা বাঁধেনি জ্বরা, আট থেকে আশি সকলেই যাঁর গানে, গায়নে মজে আছি, ভালোবাসি, তিনি তো চিরকিশোর। কিশোর কুমার। আভাস কুমার গাঙ্গুলি!
কি সুর সে গলায়, কি নির্ভার, উচ্ছল উচ্ছ্বাস! বিরহ বেদনার কি দরদভরা মনভারাক্রান্ত করা আবেদন! কৈশোরের অনায়াস সাবলীল সরলতা, তরলতা, গলা ভাঙা ‘উডলোইং’ আর সিস দেওয়া – সিধে হৃদয়ের দরজাটি হাট হয়ে খুলে যায়, প্রাণখোলা দরাজ সে গলার গান সটান সিঁদ কেটে সেঁধিয়ে যায় অন্তরের অন্দরে। যেন পাশের বাড়ির সতেজ তাজা কিশোরটি চানঘরে নাইতে নাইতে প্রাণভরে গান ধরেছে! যে শোনে সেই গুনগুনিয়ে ওঠে। আহা! গান গাওয়া বুঝি এতই সহজ, এতই সরল!
“বাজু….
বাবু, সমঝো ইশারে, হরেন পুকারে
পম… পম…পম
ইঁয়াহা চলতি কো গাড়ি
কহতে হ্যায় পেয়ারে
পম…পম…পম”
কৈশোরের প্রেমে তিনিই ভরসা, যৌবনোদ্গমের সে সন্ধিক্ষণে তাঁর গানই তো বেদ, উপনিষদ, গীতা!
“তুমহে কোই অওর দেখে, তো জ্বলতা হ্যায় দিল
বড়ি মুশকিলোঁ সে ফির সম্ভলতা হ্যায় দিল”
হুমম, যে জানে, সেই জানে। একেবারে নিয্যস মনের কথা! গুমরে ওঠা প্রাণে গুরুর গান যেন হুতাশনে খাঁটি গব্য ঘৃত! যদি ব্যথা কমে, যদি কথা হয় চোখে চোখে, যদি পাই কোনও অবিশ্বাস্য রঁদেভুর আশ্বাস! গুনগুনিয়ে উঠি..
“আজ উনসে পহেলি মুলাকাত হোগি,
ফির আমনে সামনে বাত হোগি
ফির হোগা কেয়া, কেয়া পতা, কেয়া খবর..”
সব জমে যখন ক্ষীর, হাত ছাড়াতে গেলেও আঙুলে আঙুল জড়িয়ে থাকতে চায়, গোধূলি গড়িয়ে যায় অভ্যস্ত সন্ধ্যায়, তবুও আঁধারে হারায় চোখে চোখ, পরাণে পরাণ!
“তুম যো কহদো তো আজ কি রাত, চাঁদ ডুবেগা নেহি
রাত কো রোক লো
রাত কি বাত হ্যায়, অওর জিন্দেগি বাকি তো নেহি”
এই মন কেমন করা ব্যাপারটা, এই যে মন ছুঁয়ে থাকা -আর কোনও গলার সাথে এমনি করে হয় না। কিশোর কুমার এখানেই অনন্য, চিরস্থায়ী তাঁর আসন।
বোদ্ধারা বলে থাকেন, তাচ্ছ্যিলের সাথে বুঝিয়ে দেন, ওঁর গায়নে অনেক অনেক ত্রুটি, ওঁর ক্ল্যাসিকাল কোনও তালিম নেই, ইত্যাদি ইত্যাদি। সবই মেনে নিয়ে বলতে হয়, এত ত্রুটি বিচ্যুতি নিয়েও ওঁর সমতুল্য প্লেব্যাক শিল্পী খুব কমই জন্মেছেন এই ভারতীয় উপমহাদেশে। কিশোর কুমার একটি অবিস্মরণীয় নাম, এক অদ্ভুত প্রতিভা। ওঁর সাথে, ওঁর গায়কির সাথে, ওঁর ইম্প্রোভাইজেশনের সাথে কারও তুলনা টানা সম্ভবই শুধু নয়, অবাস্তব হবে সে চেষ্টা।
এমন সর্বব্যাপী আবেদন নিয়ে আর কোনও শিল্পী আর কোনওদিন আসবেন বলে মনে হয় না ভারতীয় গানের জগতে।
ওঁর গানে গানেই বলতে হয়,
“কুছ লোগ এক রোজ যো বিছড় যাতে হ্যায়
উও হাজারোঁকে আনে সে মিলতে নেহি
উমর ভর চাহে কোই পুকারা করে উনকা নাম
উও ফির নেহি আতে
উও ফির নেহি আতে”
(পুরাতনী)