আজও র‍্যাগিং সংস্কৃতিকে বুকচিতিয়ে লালনপালন করছে এক অংশের পড়ুয়া, কেন?

Story image

১০ অগাস্ট। বিকেলবেলা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অরবিন্দ ভবনের সামনে তখন পড়ুয়াদের বিক্ষোভ চলছে সামনেই একটা ছেঁড়া হোর্ডিং, সেটি নামিয়ে নতুন হোর্ডিং লাগানো হচ্ছে। তাতে বড়ো বড়ো করে লেখা “Ragging: A Criminal Offence…” সঙ্গে আরও দুকলি যার বাংলা করলে দাঁড়ায়, “র‍্যাগিংয়ের শিকার কিংবা সাক্ষী যেকোনো ব্যক্তি হোর্ডিংয়ে দেওয়া এন্টি র‍্যাগিং স্কোয়াডের সদস্যদের সত্ত্বর জানাবেন… সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী কাউকে র‍্যাগিংয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকার প্রমাণ পেলে তাকে বহিষ্কার করবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।” তার পাশে ‘স্কোয়াড’ সদস্যদের নাম ও যোগাযোগ নম্বর।

সম্প্রতি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্য ভর্তি হওয়া এক ছাত্র স্বপ্নদীপ কুণ্ডু (Swapnadip Kundu)-র হস্টেলের তিনতলা থেকে ঝাঁপ দিয়ে ‘মৃত্যু’র মর্মান্তিক ঘটনাটি আবারও নতুন করে সামনে নিয়ে এল ‘র‍্যাগিং’ নামক ঘৃণ্য প্রথার আলোচনাকে। ছাত্রের পরিবারের তরফ থেকে করা এফআইআরে উল্লেখ করা হয়েছে হস্টেলে র‍্যাগিং-এর কারণেই মৃত্যু হয়েছে স্বপ্নদীপের। ‘প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা’, ‘রহস্যমৃত্যু’ নাকি ‘অস্বাভাবিক মৃত্যু’ — এ নিয়ে নানা মুনির নানা মত। শব্দবন্ধে না গিয়ে যদি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও হস্টেলবাসীর মন্তব্য লক্ষ্য করা যায়, তাহলে এটা অন্তত পরিষ্কার যে র‍্যাগিংয়ের বিভিন্ন উপাদান নানান ভাবে এই ঘটনার ক্ষেত্রে উঠে আসছে এবং অতীতেও হস্টেলে র‍্যাগিং হয়েছে। আপাতত এখানে দাড়ি টেনে আমরা বরং কথা বলব এই মুহূর্তে ভারতবর্ষের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে র‍্যাগিংয়ের বাস্তব চিত্রটি নিয়ে। 

‘থ্রি ইডিয়টস’, ‘ছিছোরে’-র মতো জনপ্রিয় ছবিগুলি নিশ্চয়ই অনেকে দেখেছেন। হস্টেলের সেই দৃশ্যগুলো চোখের সামনে আরেকবার ভাসিয়ে নিলেই দেখা যাবে কোথাও শারিরীক ভাবে আবার মানসিক ভাবে ‘হ্যারাস’ করা হচ্ছে অনেক স্বপ্ন বুকে নিয়ে সদ্য কলেজে পড়তে আসা পড়ুয়াদের। দৃশ্যগুলি দেখে আজও অনেকের হাসির উদ্রেক হয় বৈকি! আমার হাসি পায় না, ঘেন্না হয়, এটাই আমার দেশের বড়ো বড়ো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাস্তবতা। পরেশ রাওয়াল অভিনীত ‘টেবিল নং ২১’ ছবিটি নির্মিত র‍্যাগিং-এর ঘটনাকে কেন্দ্র করেই। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন, এমনকি মৌখিক হেনস্থার মাধ্যমেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তথাকথিত ‘দাদা-দিদি’রা নিজেদের কর্তৃত্ব ফলিয়ে, ‘মজা’ পেয়ে আজও র‍্যাগিং সংস্কৃতিকে বুকচিতিয়ে লালনপালন করে চলেছেন। যার ফলাফল স্বপ্নদীপের মতো ছাত্রদের স্বপ্নগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া। 

‘এইটুকু সহ্য করতে পারবি না?’ কিংবা ‘হস্টেলে একটু আধটু এসব হয়েই থাকে’ বা ‘মানিয়ে নে’ ইত্যাদি বলে আসলে দিনের পর দিন ধরে চলে আসা এই র‍্যাগিং সংস্কৃতিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে এবং বিশেষ করে হস্টেলগুলিতে ‘এটাই তো স্বাভাবিক’ বলে ধরে নেওয়া হয়েছে। এই সমস্ত বৈশিষ্ট্যগুলি আসলে একধরনের পিতৃতান্ত্রিক ও সামন্ততান্ত্রিক সংস্কৃতিকেই বহন করে নিয়ে চলেছে। বেশকিছু ক্ষেত্রে তা হোমোফোফিক, ট্রান্সফোবিকও বটে।

ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর (এনসিআরবি) তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালে ১২,৫২৬ জন পড়ুয়া আত্মহত্যা করেছেন। র‍্যাগিংয়ের কারণে আত্মহত্যার পরিসংখ্যানও এর মধ্যেই ধরা আছে। ইউজিসির তথ্য বলছে ২০১৮ ও ২০১৯ সালে সারা দেশে যথাক্রমে ১,০৭০ ও ১,০১৬টি র‍্যাগিংয়ের অভিযোগ নথিভুক্ত হয়েছে। ২০২০ সালে সারা দেশে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পঠনপাঠন বন্ধ থাকা অবস্থাতেও ২১৯টি র‍্যাগিংয়ের অভিযোগ পাওয়া যায়। ২০২১ সালে যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫১১টিতে। ২০১৩ থেকে ২০২২, এই দশ বছরে ভারতবর্ষে সবচেয়ে বেশি র‍্যাগিংয়ের অভিযোগ এসেছে উত্তরপ্রদেশে, ৮৩২টি। তারপরেই আছে মধ্যপ্রদেশ, ৬৬৬টি। ২০০৯ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে মোট ৮৪১টি র‍্যাগিংয়ের অভিযোগ নথিভুক্ত হয়েছে। এছাড়াও কত অজস্র র‍্যাগিং-এর ঘটনা যে চাপা পড়ে গেছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। 

উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ইউজিসির ২০০৯ সালের গাইডলাইন এবং পরবর্তীতে ২০১৬ সালের সংশোধনী অনুযায়ী, কোনো নবাগত বা যেকোনো পড়ুয়াকে তার জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ, বর্ণ, সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন, চেহারা, ভাষাগত পরিচয়, জন্মস্থান, আঞ্চলিকতা, শ্রেণি, অর্থনৈতিক অবস্থান, কমিউনিকেশনের ধরন ইত্যাদির ভিত্তিতে আক্রমণ করলে এবং যেকোনো ধরণের শারীরিক বা মানসিক [যার মধ্যে গুণ্ডামি (বুলিং) এবং একঘরে করে দেওয়া (exclusion) অন্তর্ভুক্ত] নির্যাতন করলে তা র‍্যাগিং হিসেবে গণ্য করা হয় বা র‍্যাগিংয়ের আওতাভুক্ত। 

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে র‍্যাগিং আটকাতে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘এন্টি র‍্যাগিং কমিটি’ থাকা বাধ্যতামূলক, যা প্রায় প্রতিটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই বর্তমানে উপস্থিত। পড়ুয়াদের ভর্তির সময় ‘র‍্যাগিং করব না’, এই মর্মে একটি ফর্মেও সই করানো হয়ে আসছে বেশ কয়েক বছর ধরে। কিন্তু এতকিছুর পরেও কি র‍্যাগিং বন্ধ করা গেছে? একাধিক হত্যা বা আত্মহত্যার ঘটনা, একাধিক অভিযোগ তার উল্টো কথাই বলছে। 

র‍্যাগিংয়ের ক্ষেত্রে কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষনীয়:

১) সিনিয়ররা জুনিয়রদের সঙ্গে র‍্যাগিং করেছে, তাই সেই জুনিয়ররাও নিজেরা সিনিয়র হয়ে তাদের জুনিয়রদের র‍্যাগিং করবে, এটাই নাকি স্বাভাবিক!

২) সিনিয়র অর্থাৎ বড়ো, শুধু বয়সে নয়, পাওয়ার পজিশনের দিক থেকেও বড়ো, তাই র‍্যাগিং করা তাদের যেন অধিকার!

৩) ‘ইন্ট্রো’ সংস্কৃতি। অর্থাৎ সিনিয়রদের সামনে জুনিয়ররা সিনিয়রদের কথা মতো (এবং তাদের দেওয়া ‘টাস্ক’ অনুসরণ করে) নিজেদের পরিচয় করিয়ে দেবে। কোথাও ভুল হলেই কিল, চড়, মৌখিক গুণ্ডামি কিংবা ‘শাস্তি’!

৪) কোনো মেয়ের কথা বলা বা শারীরিক ভঙ্গি যদি ‘ছেলেদের’ মতো হয়, বা কোনো ছেলের ‘মেয়েদের’ মতো হয় , তখন তাকে লেসবিয়ান/গে বলে ঠাট্টা তামাশা করা, কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে শরীরের সমস্ত বস্ত্র ভয় দেখিয়ে জোর করে খুলিয়ে যৌনাঙ্গ নিয়ে ঠাট্টা করা।

৫) মদ্যপান করিয়ে বিভিন্ন অস্বস্তিমূলক ‘টাস্ক’ দেওয়া।

৬) কখনও নবাগত পড়ুয়ার ভাষা কিংবা কথা বলার ধরন নিয়ে ঠাট্টা তামাশা, কখনও পড়ুয়ার জাতিগত, লিঙ্গগত, অঞ্চলগত অবস্থানকে ব্যঙ্গ করা।

ইত্যাদি আরও অনেক বৈশিষ্ট্যই আছে।

‘এইটুকু সহ্য করতে পারবি না?’ কিংবা ‘হস্টেলে একটু আধটু এসব হয়েই থাকে’ বা ‘মানিয়ে নে’ ইত্যাদি বলে আসলে দিনের পর দিন ধরে চলে আসা এই র‍্যাগিং সংস্কৃতিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে এবং বিশেষ করে হস্টেলগুলিতে ‘এটাই তো স্বাভাবিক’ বলে ধরে নেওয়া হয়েছে। এই সমস্ত বৈশিষ্ট্যগুলি আসলে একধরনের পিতৃতান্ত্রিক ও সামন্ততান্ত্রিক সংস্কৃতিকেই বহন করে নিয়ে চলেছে। বেশকিছু ক্ষেত্রে তা হোমোফোফিক, ট্রান্সফোবিকও বটে। এগুলো আটকানো যাচ্ছে না কেন? কলেজ কর্তৃপক্ষের এই বিষয়ে উদাসীন মনোভাব, এন্টি-র‍্যাগিং কমিটিগুলির দিক থেকে র‍্যাগিংয়ের অভিযোগগুলিকে গুরুত্ব সহকারে না দেখা, দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির সমস্ত অংশীদারদের (stakeholder) দায় হীনতা এবং ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়ার প্রবণতা, হস্টেলগুলির পরিকাঠামোগত সমস্যা, হস্টেল সুপার কিংবা ওয়ার্ডেন পদগুলি খালি পড়ে থাকা ইত্যাদি কারণগুলি প্রাথমিক ভাবে দায়ী বলেই মনে হয়। 

আবার আরেকটা প্রশ্নও এখানে স্বাভাবিকভাবে উঠবে, সব কি আইন দিয়ে বা ফর্মাল মেকানিজম দিয়ে আয়ত্তে আনা সম্ভব? র‍্যাগিং সংস্কৃতি একটা সামাজিক পশ্চাৎপদ চিন্তাধারা। একপ্রকার সামাজিক ব্যাধি। আইনত গুরুতর অপরাধ। তা নিয়ে সমাজে বিশেষ করে পড়ুয়াদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি না করা গেলে শুধু ফর্মাল মেকানিজম দিয়ে এই সমস্যা মেটবার নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে বিভিন্ন ধরনের বৈষম্য, নির্যাতন বিষয়ে সংবেদীকরণের নানান প্রক্রিয়া, কাউন্সেলিং, সভা-সেমিনার, আলাপ-আলোচনার পরিসর গড়ে তোলা প্রয়োজন। প্রয়োজন পড়ুয়াদের ইউনিয়ন/সংগঠনগুলি থেকে লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া, এন্টি-র‍্যাগিং কমিটির উপর লাগাতার চাপ সৃষ্টি করে তাঁদের দিয়ে কাজ করানো। হস্টেলগুলির পরিকাঠামোগত উন্নয়ন। র‍্যাগিংয়ের মতো একটা ঘৃণ্য সংগঠিত অপরাধকে ‘স্বাভাবিক’ বলে চালানো বন্ধ করা। দোষীদের বাঁচানোর চেষ্টা এবং অপরাধগুলিকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা অবিলম্বে বন্ধ করে চোখের সামনে কেউ র‍্যাগিংয়ের শিকার হলে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদটা পড়ুয়াদের মধ্যে থেকেই উঠে আসা জরুরি। “অন্যায় যে করে অন্যায় যে সহে; তব ঘৃণা যেন তারে তৃণ সম দহে”।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.