বাড়ি ভর্তি লোক, সকলের মুখ থমথমে। এরই মধ্যে বাইরে কারা যেন বোম ফাটাচ্ছে। বলি হচ্ছে টা কি, শোকের সময় চ্যাংড়ামো! বাইরে থেকে উত্তর ভেসে আসে, ‘‘চ্যাংড়ামো নয়, জয়ধ্বনি। যে চকলেট বোম বানিয়ে গোটা বাজির বাজার জিতে নিয়েছেন, সেটা ফাটিয়েই বুড়ীমাকে শ্রদ্ধা জানালাম!”
তাঁর শেষ দিনটা আজও ভুলতে পারেননি নাতি সুমন দাস। ঠাকুমার ‘লেগেসি’ সামলাচ্ছে তো এখন তাঁরাই। ১৯৯৬ সালে প্রথমবার শব্দবাজির তীব্রতা নিয়ন্ত্রণ করে সরকার। কিছুটা হলেও থমকে যায় ‘বুড়ীমা’-র (Burima) চাহিদা। তবে, সেই দিন দেখতে হয়নি অন্নপূর্ণাদেবীকে (Annapurna Devi), তার ঠিক আগের বছরেই ধরাধাম ছাড়েন তিনি। কিন্তু, বাঙালি মেয়ে হিসেবে ব্যবসায় সাফল্যের এক অনন্য নজির গড়ে গিয়েছেন অন্নপূর্ণা দাস ওরফে ‘বুড়ীমা’। কথায় বলে পেটের জ্বালা বড়ো জ্বালা। আর সে কারণেই, বাজি খারাপ না ভালো এই গবেষণা না করে এমনকী ব্যবসা করতে গেলে যে ‘লাইসেন্স’ নামক বস্তুটি লাগে, সেসব না জেনেই বাজি বিক্রির পথ বেছে নিয়েছিলেন অন্নপূর্ণা দেবী। ঘটনাটা ছিল এইরকম-
জন্ম অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুরে। সন্তান বলতে তিন মেয়ে আর এক ছেলে। ‘পূর্ব পাকিস্তানে’ থাকাকালীনই স্বামীর মৃত্যু। তারপর ভিটেমাটি ছেড়ে, উদ্বাস্তু পরিচয়ে চলে আসা এপার বাংলায়। উদ্বাস্তু ক্যাম্প থেকে পরে বেলুড়ের স্থায়ী ঠিকানার মাঝের পথটুকু জুড়ে জীবনসংগ্রাম। প্রথমে ধলদিঘির বাজারের পাশে রাস্তাতেই আনাজপাতি বিক্রি করেই কোনোমতে পেট চালিয়েছেন অন্নপূর্ণা। পাশাপাশি শিখে নিয়েছেন বিড়ি বাঁধা। ধলদিঘি থেকে ভাসতে ভাসতে গঙ্গারামপুর। বিড়ির ব্যবসায় হাত পাকানো শুরু। ক্রমে নিজের কারখানাও হল। বেলুড়ে নিজস্ব দোকান আর বাড়ি। গঙ্গারামপুর ছেড়ে পাকাপাকিভাবে চলে এলেন বেলুড়ে।
ব্যবসার মাঝে বারবার বাধা এসেছে। দাঁতে দাঁত চিপে লড়ে গেছেন অন্নপূর্ণা। ‘অবলা বিধবা’ হয়ে দুর্ভাগ্যস্রোতে ভেসে যাননি, সন্তানদেরও ভেসে যেতে দেননি। বিড়ির পাশাপাশিই শুরু হল আলতা, সিঁদুরের ব্যবসা। সেই সঙ্গে দোলের সময়ে রং-আবির, বিশ্বকর্মা পুজোর সময়ে ঘুড়ি আর কালীপুজোর সময়ে বাজি। বাজি বিক্রি শুরু করতেই হোঁচট। লাইসেন্স না থাকায় সব বাজি বাজেয়াপ্ত করে নিল পুলিশ, ভেঙে দেওয়া হল দোকান। অন্নপূর্ণা ভেঙে পড়ার মহিলা নন। তাঁর জেদ আরো ঘন হল।
ততদিনে তাঁর বয়স বেড়েছে। সবার কাছেই তিনি ‘বুড়ীমা’। ঠিক করে ফেললেন, সরকারি সব নিয়ম-কানুন মেনেই বাজি বেচবেন। শুধু বেচাই না, বাজি তৈরিও করবেন। তাতে লাভ অনেক বেশি। শুরু হল বাজির কারখানা। নিজেই জোগাড় করলেন কারিগর। ক্রমে সেই ব্যবসা দাঁড়িয়ে গেল। ছেলে-নাতিরাও যোগ দিল ব্যবসায়। বাজির বিখ্যাত কারিগর আকবর আলির ফর্মুলায় বিখ্যাত হয়ে গেল ‘বুড়ীমার চকোলেট বোম’। তামিলনাড়ুর শিবকাশীতেও দেশলাই কারখানা খুললেন অন্নপূর্ণা। ডানকুনিতে বাজি কারখানা রমরম করে চলতে লাগল। কারখানার জন্য কিনলেও তালবান্দার জমি বিলিয়ে দিয়েছিলেন গরিবদের। এক সময় যাঁর মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না, তিনিই পঞ্চাশটি পরিবারকে বাড়ি বানিয়ে দিলেন। বলতেন, “ব্যবসাটা তুচ্ছ! এসেছি মানুষকে ভালবাসতে।” ছিন্নমূল, ভিটে হারানোর যন্ত্রনা তিনি জানতেন। এভাবেই ধীরে ধীরে বাংলার বাজি ব্যবসায় এক নম্বর জায়গাটি পাকা করে ফেলেন অন্নপূর্ণা দেবী। সবার ‘বুড়ীমা’। ব্যবসাকে শক্ত জমিতে দাঁড় করিয়ে তবেই চোখ বুজেছিলেন। বর্তমানে এই ব্যবসার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন তাঁর নাতি। তাঁর কথায়, করোনাকালে ব্যবসার প্রতিপত্তি কিছুটা কমলেও, বাজির কোয়ালিটি কিন্তু একই রয়েছে। সততাতই তাঁদের ব্যবসার মূলমন্ত্র।
তখনো শব্দবাজি নিয়ে এত কড়াকড়ি ছিল না চারপাশে। তখন, চকোলেট বোম মানেই ‘বুড়ীমা’। চকচকে গোলাপি, সবুজ আর নীল-সাদা ডোরাকাটা কাগজে মোড়া খুদে শব্দ-দানব। প্যাকেটের ওপরে লেখা ‘বুড়ীমার চকোলেট বোম’। কালীপুজো, দুর্গাপুজোড় বিসর্জন, ভারত-পাক কিংবা মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ থেকে ভোটে জেতার উল্লাস—সেই বাজির দাপুটে উপস্থিতি সর্বত্র। ক্রমে প্রশাসন কড়া হল। শব্দবাজি ‘নিষিদ্ধ’ হল। কিন্তু ‘বুড়ীমা’ ব্র্যান্ডনেম তাতে টাল খায়নি। শব্দবাজি ছাড়াও তাদের ‘শব্দবিহীন আতসবাজির’ সম্ভারও যে বিপুল। আমরা জানি, যেকোনও ধরনের বাজিই পরিবেশের জন্য খারাপ। তবে, সব খারাপের একটা ভালো দিকও থাকে। শুধু খুঁজে বের করতে হয়। যেমন- বাজিদূষণের ‘খারাপ’ দিক ছাপিয়ে গিয়েছে অন্নপূর্ণা দেবীর বাজি-ব্যবসার ‘ভালো’ গল্প। যে গল্পে দূষণ নেই রয়েছে জীবন সংগ্রামের অনুপ্রেরণা।
(‘বুড়ীমা’ ব্র্যান্ডের নাম অনুযায়ী বানান অপরিবর্তিত)