একটা সময় ছিল যখন ভারতে ‘মার্গো’ ব্র্যান্ড ছিল FMCG (ফাস্ট-মুভিং কনজিউমার গুডস) সংস্থার অন্যতম সেরা দ্রব্য। মার্গো নিম সাবান ত্বককে ময়শ্চারাইজ করে, রুক্ষ ত্বকে চুলকানি এবং লালভাব দূর করে। ছত্রাক, পরজীবী বা বাহ্যিক সংক্রমণের হাত থেকে ত্বককে রক্ষা করে। সেই সময় দাঁত এবং মাড়ির রোগ নিরাময়ের জন্য নিমের কার্যকারিতার উপর মানুষের মনে পূর্ণ আস্থা তৈরি হয়েছিল। তাছাড়া দেশিয় ল্যাভেন্ডার পারফিউমের দুর্দান্ত সুগন্ধও ছিল অভিজাত মহিলাদের পছন্দের তালিকায় এবং বিয়ের কনের তত্ত্বের ট্রে-তেও প্রসাধনের তালিকায় সাবান ছিল অপরিহার্য। তাই সুগন্ধ এবং উপকারিতা দুইয়ের মেলবন্ধনে মার্গো বাঙালির ঘরে ঘরে সহজেই পরিচিত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এই সাবান তৈরির ইতিহাসে যে লুকিয়ে আছে একজন বাঙালি উদ্যোক্তার গবেষণা, তা আমরা ক’জন জানি? শুধু তাই নয়, কীভাবে এই সাবান দেশিয় বাজারে এতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠল, তা নিয়েও অনেকেরই মনে ধোঁয়াশা রয়েছে।
খগেন্দ্র চন্দ্র দাস ছিলেন সেই উদ্যোক্তা এবং কলকাতা কেমিক্যাল কোম্পানির স্বত্বাধিকারী। তাঁর নেতৃত্বেই, কোম্পানিটি বহুল পরিচিত স্বদেশি ব্যবসায় পরিণত হয়। মার্গোর পাশাপাশি অন্যান্য আরও অনেক পণ্যের জন্য সুপরিচিত ছিল এই সংস্থা। কিন্তু ক’জন মনে রেখেছে সেই বাঙালি স্রষ্টাকে? ইতিহাসের পাতায় বিস্মৃতির অতলেই রয়ে গেছেন সেই নায়ক। বাংলার এক ধনী বৈদ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন খগেন্দ্র চন্দ্র দাস। তাঁর পিতা বাহাদুর তারক চন্দ্র দাস, যিনি পেশায় ছিলেন একজন বিচারক। এবং তাঁর মা ছিলেন মোহিনী দেবী, যিনি পরবর্তীকালে একজন কট্টর গান্ধিবাদী এবং স্বাধীনতা কর্মী হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। একটি মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির প্রাক্তন সভাপতিও ছিলেন মোহিনী দেবী। শৈশব থেকেই স্বদেশি আন্দোলনে মায়ের সম্পৃক্ততা দেখে বড়ো হয়েছিলেন খগেন্দ্রনাথ। ফলে নিজেও জীবনে সেই পথই অনুসরণ করেছিলেন।
খগেন্দ্র চন্দ্র দাস
কলকাতায় পড়াশোনা শেষ করে খগেন্দ্র চন্দ্র শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের লেকচারার হন। তারিখটা ১৬ অক্টোবর ১৯০৫, লর্ড কার্জনের (১৮৯৯-১৯০৫) অধীনে বাংলার ইতিহাসের সেই চরমতম অধ্যায়, বঙ্গভঙ্গ। আধুনিক বাংলার ইতিহাসে বঙ্গভঙ্গ নিছক কোনও ঘটনা ছিল না, এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এই ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতির দ্বারা ইংরেজরা চেয়েছিল ভারতীয়দের মধ্যে ধর্ম নিয়ে বিভেদ তৈরি করতে। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই ভারতীয় জনগণ ক্ষুব্ধ হয়ে বিরোধিতা করতে শুরু করে এই নীতির। উপনিবেশকারীরা শাসন করার সুবিধার্থে স্থানীয় জনগণকে নিজেদের শত্রুতে পরিণত করছে, হিন্দু মুসলিম বিরোধিতা তৈরি করছে, তা বুঝতে পারে ভারতীয়রা। শুরু হয় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশি আন্দোলন। বাঙালির উচ্ছ্বসিত আবেগের বহিঃপ্রকাশ ছিল এই আন্দোলন। প্রাথমিকভাবে ব্রিটিশ পণ্য বয়কট করা এবং শুধুমাত্র দেশিয় পণ্য ব্যবহার করা, এই ছিল স্বদেশি আন্দোলনের মূল মন্ত্র।
এই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল বিদেশি পণ্যের বিপরীতে দাঁড়িয়ে দেশিয় পন্য ব্যাবহারের মধ্যে দিয়ে দেশের অর্থনৈতিক ভিতকে সমৃদ্ধ করা এবং স্বাবলম্বী করে তোলা দেশের জনগণকে। একেই খগেন্দ্রর ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব ছিল তুঙ্গে তার সঙ্গে যোগ দিল স্বদেশি আন্দোলনের হাওয়া, ফলে তিনি সহজেই জড়িয়ে পড়লেন আন্দোলনে।
অন্যদিকে, খগেন্দ্রর বাবা তখন ব্রিটিশ ভারত সরকারের কিছু নির্দিষ্ট কর্মকর্তার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তাই তাঁকে জানানো হয়েছিল, তিনি যদি ছেলেকে এই স্বদেশি কাজে বাধা না দেন তবে তাঁর ছেলেকে শীঘ্রই গ্রেফতার করা হবে। ফলে তিনি তড়িঘড়ি তাঁর ছেলেকে উচ্চ শিক্ষার জন্য লন্ডনে যাওয়ায় জোর দেন। খগেন্দ্র চন্দ্র তার পিতার আদেশ মানতে বাধ্য হয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু তিনি নিজের সিদ্ধান্তে ছিলেন অনড়। তিনি ঠিক করেন কিছুতেই ব্রিটেনে যাবেন না, রীতিমত জেদ ছিল তাঁর। তাই অন্য উপায়ে তাঁর অবাধ্যতা প্রকাশ করেন। অপেক্ষা করেছিলেন উপযুক্ত মুহূর্তটির জন্য। ১৯০৪ সাল। ইন্ডিয়ান সোসাইটি ‘ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অফ সায়েন্টিফিক ইন্ডাস্ট্রি’ থেকে একটি বৃত্তির প্রস্তাব দেওয়া হয় তাঁকে। এই সুযোগে তিনি আমেরিকান জাহাজে চড়ে ক্যালিফোর্নিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।
১৯০৭ সালে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খগেন্দ্র চন্দ্র এবং তার সহপাঠী সুরেন্দ্র মোহন বসু (ডাকব্যাক ওয়াটারপ্রুফের প্রতিষ্ঠাতা) উভয়কেই স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তরিত করা হয়। তাঁরা দুজনেই ১৯১০ সালে স্ট্যানফোর্ড থেকে রসায়নে স্নাতক হন। তাঁরাই প্রথম ভারতীয় যাঁরা মর্যাদাপূর্ণ স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নকালেও খগেন্দ্র সক্রিয়ভাবে স্বদেশি আন্দোলনে জড়িত ছিলেন এবং সেই সময়কালেই তিনি ভারতীয় স্বাধীনতা লীগের সাথে যুক্ত হন। লালা হরদয়াল প্রায়শই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশে অধ্যয়নরত ভারতীয় ছাত্রদের জন্য সভা এবং সেমিনারের আয়োজন করতেন যাতে তাঁরা বিদেশে বসেও ভারতের সমস্যার বিষয়গুলি সম্পর্কে সংবেদনশীল হতে পারে এবং নিজেদেরকে রাজনৈতিক আলোচনা ও বিতর্কের সঙ্গে যুক্ত করতে পারে। খগেন্দ্র চন্দ্র দাস ছিলেন এমন একজন, যিনি এসব অনুষ্ঠানে নিয়মিত যেতেন এবং আলোচনায় অংশও নিতেন।
স্নাতক শেষ করার পরে, খগেন্দ্র চন্দ্র এবং সুরেন্দ্র মোহন ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন কিন্তু ফেরার পথে তাঁরা জাপানী একটি সংস্থা ঘুরে দেখেন। সেখানে প্রত্যেকে তাঁদের মস্তিষ্কপ্রসূত ব্যবসা নিয়ে নানারকম মত দেন। যেমন – সুরেন্দ্র মোহন বসুর জন্য ‘ওয়াটারপ্রুফিং’ এবং খগেন্দ্র চন্দ্র দাসের জন্য ‘ফার্মাসিউটিক্যালস’।
১৯১৬ সাল, কলকাতার ৩৫ পন্ডিতিয়া রোডে সূচনা হয় কলকাতা কেমিক্যাল কোম্পানির যাত্রাপথ। খগেন্দ্র চন্দ্র দাস, আর.এন. সেন এবং বি.এন. মৈত্র -এঁদের নেতৃত্বে স্থাপিত হয় এই কার্যালয়। এছাড়াও কলকাতার তিলজলায় একটি অতিরিক্ত কারখানা নির্মিত হয় এই কোম্পানির। তাঁর বন্ধু সুরেন্দ্র মোহন ১৯২০ সালে ‘ডাকব্যাক’ ব্র্যান্ড নামে ছাতা এবং রেইনকোট তৈরি করতে শুরু করেন। একই বছরে, খগেন্দ্র চন্দ্র দাসও তাঁর কোম্পানির প্রসার ঘটান এবং তৈরি করতে শুরু করেন প্রসাধন সামগ্রী। ক্রমেই কোম্পানিটি অত্যন্ত সফলতা লাভ করতে থাকে।
মূলত নিম গাছের নির্যাসকে কাজে লাগিয়ে তিনি প্রসাধনের ধারণায় সফল পদক্ষেপ নেন। নিম গাছের ভেষজ গুণের কথাই তিনি ভারতীয় পণ্যের প্রতীক হিসাবে প্রচার করেছিলেন। তৈরি করেছিলেন দুটি স্থায়ী ব্র্যান্ড – মার্গো এবং নিম টুথপেস্ট। নিতান্তই নিম্ন মূল্যে এই সমস্ত পণ্য তিনি বাজারে নিয়ে আসেন যাতে সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষ সহজেই তা কিনতে পারে। এর পাশাপাশি তিনি ল্যাভেন্ডার ডিউ পাউডার (যাতে আরও বেশি বাজার তৈরি করতে পারে কোম্পানি) সহ বেশ কয়েকটি অন্যান্য পণ্য তৈরি ও বাজারজাত করাও শুরু করেন।
ক্রমবর্ধমান চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কোম্পানিটি দেশের সমস্ত প্রধান শহরে অফিস তৈরি করে। শুধু তাই নয়, আরও বেশি উত্পাদনের জন্য তামিলনাড়ুতে অতিরিক্ত কারখানা স্থাপন করা হয়। এরপর কোম্পানিটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশে আন্তর্জাতিক ব্যাবসা শুরু করে এবং সিঙ্গাপুরেও তৈরি হয় ব্যাবসায়িক চেন। স্বদেশি দর্শনে আজীবন বিশ্বাসী ছিলেন খগেন্দ্র চন্দ্র, এমনকি স্বাধীনতার পরেও কট্টর ব্রিটিশ বিরোধী ছিলেন তিনি। তাঁর পোশাকেও তিনি ধরে রেখেছিলের স্বদেশিয়ানা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপান থেকে ফিরে আসার পর থেকে তিনি শুধুমাত্র দেশিয় খাদির পোশাক পরতে পছন্দ করতেন।
তিনি সারাজীবন আদর্শের প্রতি নিবিড়ভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন বলে অন্যের চাকুরিবৃত্তি তিনি একেবারেই পছন্দ করতেন না। তাঁর মৃত্যুর সময়, সমাজের বিভিন্ন স্তরের বিপুল সংখ্যক মানুষ এগিয়ে এসেছিলেন আর তাঁদের সকলের মুখেই শোনা যায় একটাই কথা যে তিনি অন্যের কাছে চাকরি করাকে উৎসাহ না দিয়ে সবসময় বলতেন নিজে কিছু করে দেখানোর কথা। উৎসাহ দিতেন নতুন কাজে। কত বড়ো মাপের কাজ হল, সেটা বড়ো কথা নয়, নিজের নতুন উদ্যোগকেই তিনি বেশি জোর দিয়েছেন আজীবন।
১৯৬০ দশকে খগেন্দ্র চন্দ্র দাসের মৃত্যুর সময়, তাঁর ‘ক্যালকাটা কেমিক্যাল’ কোম্পানিটি দক্ষিণ এশিয় অঞ্চলের সবচেয়ে সুপরিচিত এবং স্বীকৃত ব্যবসায় পরিণত হয়েছিল। শুধু কেমিক্যাল দ্রব্য নয়, এই কোম্পানিটি শিল্প প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক যৌগ তৈরির জন্যও পরিচিত ছিল। শতবর্ষ পেরিয়ে এসেও বাজার ধরে রেখেছে তাঁর অনন্য সৃষ্টি মার্গো সাবানটি। ১০০ বছর পুরোনো সেই উদ্যোগের জন্য মহান বাঙালি নায়ক তথা স্বদেশি উদ্যোক্তা অবশ্যই শ্রদ্ধার দাবি রাখেন।