কেরলের বর্তমান রাজধানী নগরী তিরুবনন্তপুরম-এর পূর্বতন নাম ছিল ত্রিবাঙ্কুর। ব্রিটিশ আমলে ত্রিবাঙ্কুর একটি দেশীয় রাজ্য হিসেবেও পরিচিত ছিল। ১৭২৯ সাল থেকে ১৭৫৮ সাল পর্যন্ত এই দেশীয় রাজ্যটির শাসনভার হাতে নেন রাজা মার্তণ্ড বর্মার ভ্রাতুস্পুত্র–কার্তিকতিরুন্নাল রামবর্মা। রাজা মুৎসুহিতের উদ্যোগে জাপানে যেমন মধ্যযুগের আঁধার সরে গিয়ে উদারমনস্ক সংস্কৃতির সূর্য উদিত হয়েছিল, শালেমানের শাসনে ফ্রান্সে যেমন সংস্কৃতির জোয়ার এসেছিল, পূষ্যভূতি-রাজ হর্ষবর্ধন ও দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যের রাজত্বে সাহিত্য-সংস্কৃতিতে প্রাচীন ভারত যেমনভাবে প্রদীপ্ত হয়ে উঠেছিল, তেমনি রাজা কার্তিকতিরুন্নাল রাম বর্মার উৎসাহে ও পৃষ্ঠপোষকতায় ত্রিবাঙ্কুর-সহ দক্ষিণ ভারতে সাহিত্য, সঙ্গীত, নৃত্য-সহ সংস্কৃতির বিভিন্ন অঙ্গনে একটা নতুন জোয়ার এসেছিল। ভরত মুনির নাট্যশাস্ত্র নামক গ্রন্থটি যেভাবে নাটক এবং অভিনয় শিল্পের সর্বপ্রথম পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা উপস্থাপিত করেছিল সবার সামনে, তেমনি রাজা কার্তিকতিরুন্নাল রাম বর্মার রচিত বলরামভারতম নামক গ্রন্থটিও ভারতীয় নৃত্যশৈলীর একটি চিরায়ত রূপ তুলে ধরে সকলের সামনে।
১৭৫৮ থেকে ১৭৯৮ সাল পর্যন্ত ত্রিবাঙ্কুরের মহারাজা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন রাজা কার্তিক তিরুন্নাল রাম বর্মা। প্রশাসনিক গুরুদায়িত্ব সামলেও ‘দক্ষিণের ভোজরাজ’ নামে সুপরিচিত রাজা কার্তিক তিরুন্নাল মালয়ালী সংস্কৃতি পুরুষ কাপ্পালিঙ্গাদ নাম্বুদ্রির সহায়তায় কথাকলি নৃত্যের একটি নব আঙ্গিকের প্রচলন করেন। মাণ্ডুর রাজা রাজবাহাদুর, সমুদ্রগুপ্ত, মিঞা তানসেনের মতো ত্রিবাঙ্কুরের এই নৃপতি ও সঙ্গীত ও বাদ্যযন্ত্র বিশারদ ছিলেন। কথাকলি নৃত্য ও আবহসঙ্গীতের মাধ্যমে ভারতীয় পুরাণের বিভিন্ন কাহিনির রূপায়ণের প্রচলন (আত্তাকাঙ্খ) করেন রাজা কার্তিক তিরুন্নাল। মালয়ালী কবি দেবরাজ রাজাকার্তিক তিরুন্নালের ভূয়সী প্রশংসা করে লিখেছেন— “এই রাজা যেন স্নিগ্ধ চন্দ্রালোকের মতো, যিনি সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে তার প্রতিভার বিকিরণের সাহায্যে মানবতাবাদকে নিয়ে এসেছেন।” দেবরাজের এই প্রশস্তির সঙ্গে সমুদ্রগুপ্তের প্রশংসা করে লেখা, কবি হরিষেণের ‘এলাহাবাদ প্রশস্তি’ শিলালিপিটির তুলনা করা চলে। নৃত্যশৈলীর ওপর ‘বলরামভারত’-এর পাশাপাশি রাজা কার্তিক তিরুন্নাল আরও কয়েকটি প্রামাণ্য গ্রন্থ রচনা করেন। সেগুলি হলো ‘রাজসূয়ম’ ‘সুভদ্রাহরণম’,(কৃষ্ণের সুভদ্রাহরণ কাহিনি সম্পর্কিত), বকবধর্ম’(একচক্রা গ্রামে মধ্যম পাণ্ডব ভীমের হাতে বরাক্ষস বধের বৃত্তান্ত), গন্ধর্ববিজয়ম, ‘পাঞ্চালীস্বয়ম্বর’ (স্বয়ম্বর সভায় দ্রৌপদীর অর্জুনকে বরমাল্য প্রদান), ‘কল্যাণসৌগন্ধীকরম’ এবং ‘নরকাসুরবধম’ বর্তমানে কেরলের তিরুবনন্তপুরমে অবস্থিত কেরল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে, ভূর্জপত্র বা তাল পাতার ওপর সংস্কৃত ভাষাতে লেখা ‘বলরামভারতম’-এর মূল পাণ্ডুলিপিটি সংরক্ষিত আছে। এই গ্রন্থটি ১৯৩৬ সালে ওই বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের কিউরেটর সম্ভাশিব শাস্ত্রীর উদ্যোগে প্রথম ছেপে বের হয়। এই গ্রন্থটির মধ্যে নৃত্যের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন রকমের অভিনব শৈলীর বিবরণও দেওয়া আছে। এই ‘বলরামভারত’ গ্রন্থটিতে আছে ২২২৮টি কাব্য পংক্তি এবং ২০টি গদ্য অনুচ্ছেদ। বিভিন্ন আঙ্গিকে এবং শারীরিক মুদ্রার সাহায্যে কীভাবে নানান রকমের নৃত্যনাট্যর উপস্থাপনা করতে হয় সেটারও বিশদ ব্যাখ্যা রয়েছে এই ‘বলরামভারত’ গ্রন্থে। কথাকলি নৃত্যশৈলী ছাড়াও এই গ্রন্থেরাজা কার্তিক তিরন্নাল, অষ্টাদশ শতকে কেরল এবং দাক্ষিণাত্যের আরো কয়েকটি স্থানে প্রচলিত ‘কু দিআট্টম’, ‘কু থু’, ‘কৃষ্ণআট্টম, ‘থিরভাথিরাক্কালি’, ‘কুম্মি’, ‘থুল্লাল’ ও “দাসিআট্টম’-এর মতো নৃত্যশৈলীগুলিরও বিশদ ব্যাখ্যা এবং পর্যালোচনা করেছেন। মহাকাব্য মহাভারত এবং রামায়ণ-এর কাহিনির ওপর ভিত্তি করে (প্রবন্ধম) ‘কুথু’ নৃত্যশৈলীটি কেরলের বহু মন্দিরে ‘চাক্কিয়ার’ সম্প্রদায়ের মানুষ প্রদর্শন করতেন। কেরলে একটি নারী সম্প্রদায় দেবী পার্বতীর লাস্য নৃত্যের ভঙ্গিমাতে ‘থিরুভাথিরাক্কালি’ নৃত্যশৈলীটি প্রদর্শন করতেন। এক্ষেত্রে এই নর্তকীরা, মগধের রাজা বিম্বিসারের সমসাময়িক রাজনৰ্তকী আম্রপালী, বাসবদত্তা ও বসন্তসেনার উত্তরসূরি হিসেবে পরিচিতি পেতে পারেন।
রাজা কার্তিক তিরুন্নালের এই ‘বলরামভারত’ গ্রন্থটি থেকে জানা গেছে সপ্তদশ শতকে কথাকলি নৃত্যশৈলীর উদ্ভব হয় “রামনা] ও ‘কোত্তারাক্কারা থাম্বুরন’ নামক দুটি নৃত্যশৈলীর বিবর্তনের মাধ্যমে। কেরলে যে দেবদাসীদের মন্দির-নৃত্য বা ‘দাসীআট্টম’ প্রচলিত ছিল—তার থেকেই ‘মোহিনীআট্টম’ নামক নৃত্য ঘরানাটির উদ্ভব ঘটেছে বলে ‘বলরামভারত গ্রন্থটিতে উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত কেরলের অন্তর্গত শচীন্দ্রম মন্দিরে ‘দাসীআট্টম’নৃত্য প্রদর্শিত হয়। অবশ্য, একক নৃত্যশৈলী ‘মোহিনীআট্ট’ সম্পর্কে আরো অনেক তথ্য পাওয়া যায় নৃত্য-বিশেষজ্ঞ মাঝমঙ্গল নারায়ণন নাম্বুদ্রি বিরচিত ব্যবহারমালা’ নামক গ্রন্থটি থেকে। তবে, দাক্ষিণাত্যের আরো কয়েকটি রাজ্যের নৃত্যশৈলী সম্পর্কে লিখেছেন রাজা কার্তিক তিরুন্নাল। এগুলির মধ্যে আছে কাশ্লারি’, ‘দোলা’ ‘বক্ৰঙ্গিনাট্যম’, ‘ভরতনাট্যম’, ‘নিষাদনটনান’এর মতো নৃত্যশৈলীগুলিও। তবে মালয়ালী সাহিত্য বিশ্লেষক মহাকবি উল্লুর পরমেশ্বর আইয়ার, তার মহাগ্রন্থ- ‘কেরালাসাহিত্যচরিতম এ জানিয়েছেন, রাজা কার্তিক তিরুন্নাল বলেছিলেন যে ‘দাসীআট্ট’ নামক নৃত্যশৈলীর জন্ম কিন্তু কেরলে নয়, তামিলনাড়ুতে হয়েছিল। রাজা কার্তিক তিরুন্নাল-এর পুত্র ও পরবর্তী নৃপতি শ্রী স্বাতী তিরাল মহারাজার আমলে কেরলে মোহিনীআট্ট ও কথাকলির মতো নৃত্যশৈলীর আরও বিবর্তন ঘটে।
কৌশিক রায়
2019-07-19