ইংলন্ডেশ্বরীর মৃত্যু, পুরনো উপনিবেশের উদ্‌যাপন-পূর্তির প্যাডেই শোকপ্রস্তাব ভারত সরকারের, নিছকই সমাপতন?

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘মহেশ’ ছোটগল্পে অপমান সইতে না পেরে অভিমানাহত গফুর মিঞা বলেছিল, “মহারাণীর রাজত্বে কেউ কারও গোলাম নয়।” সেই রামও নেই, নেই সেই অযোধ্যাও। যে ব্রিটিশ সূর্য কখনও অস্তমিত হয় না বলে মনে করা হত, তা টেমসের কূলে ডুবে গিয়েছে অনেক আগেই। তবু রানি ছিলেন। ছিল ভিক্টোরিয়ান ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার। সম্ভ্রমে হোক বা নিয়মরক্ষার খাতিরে, ব্রিটিশ কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলিতে বহু খুঁটিনাটি কাজেই মহারানির নাম এবং তাঁর স্মারক ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। এই বৃহস্পতিবার অবধিও।

ইতিহাস বলছে, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’-র শাসনের অবসান হওয়ার পর মহারানি ভিক্টোরিয়ার ঘোষণাপত্রের দ্বারা আনুষ্ঠানিক ভাবে ব্রিটিশ রাজপরিবারের দ্বারা শাসিত হয়েছিল পরাধীন ভারতবর্ষ। ইংলন্ডেশ্বরীর নামেই পরিচালিত হত ভারতীয় উপনিবেশের যাবতীয় কাজকর্ম। ভিক্টোরিয়ান নৈতিকতাকে মণিহার করে খাস কলকাতাতেই গড়ে উঠেছিল ‘নব্য বাবু সংস্কৃতি’। রানির মৃত্যুর পর দেশের নেটাগরিকদের একাংশ যখন শোকে বিহ্বল, তখন আর একটি অংশ সদ্যপ্রয়াত নবতিপর রানিকে দেশভাগ, সাম্প্রদায়িক হিংসা, সম্পদের লুণ্ঠন ইত্যাদি ঔপনিবেশিক অনাচারের উত্তরাধিকার বহন করে যাওয়ার জন্য দুষেছেন।

সেই আবহেই এই অদ্ভুত সমাপতন হল। ব্রিটিশদের হাত থেকে অর্জন-করা স্বাধীনতার ৭৫ বছরের উদ্‌যাপনকে স্মরণীয় করে রাখতে গোটা দেশ জুড়ে এখন চলছে ‘আজাদি কা অমৃত মহোৎসব’। সেই স্বাধীনতা পালনের উৎসবের নামাঙ্কিত প্যাডেই ঘোষিত হল ইংল্যান্ডের রানির মৃত্যুতে রাষ্ট্রীয় শোক! বলা হল, ইংলন্ডেশ্বরীর প্রয়াণে আগামী ১১ সেপ্টেম্বর, রবিবার এক দিনের রাষ্ট্রীয় শোকদিবস পালন করবে ভারত। সমস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানে অর্ধনমিত থাকবে জাতীয় পতাকা।

ইতিহাসবেত্তারা বলে থাকেন, ইতিহাস বড় নির্মম। ঘটনাচক্রে, রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর কিছু দিন আগেই ব্রিটেনকে টপকে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশের তকমা পেয়েছে ভারত। ৭৫ বছর আগে ল্যুটিয়েন্স দিল্লির মসনদ থেকে নেমে গিয়েছে ব্রিটিশ পতাকা ইউনিয়ন জ্যাক। উঠেছে ত্রিবর্ণরঞ্জিত জাতীয় পতাকা। তার পর পুরনো উপনিবেশ দেখতে ভারত সফরে এসেছেন সদ্যপ্রয়াত রানিও। দেখে গিয়েছেন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার হাত ধরে ভারী শিল্প এবং বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে ক্রমশ উন্নত হতে চাওয়া একটি দেশকে। তাঁর দেশের লোকেরা স্বাধীনতার পরেও বহু বার ভ্রূকুঞ্চন করে বলেছিলেন, ভারতে সংসদীয় গণতন্ত্র টিকবে না। কোনও কোনও ব্রিটিশ পণ্ডিত বলেছিলেন, বহু জাত-ধর্মে বিদীর্ণ এই দেশ অচিরেই গৃহযুদ্ধের পথে হাঁটবে। ভারতের মূল্যবান কোহিনূর মণি থেকে উপনিবেশ-পূর্ব শিক্ষা, সমাজব্যবস্থা অনেক কিছুই হরণ করে নিয়েছে ব্রিটেন।

তবু দেশভাগ, জাতিদাঙ্গার স্মৃতি পিছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছে ভারত। নড়বড়ে পায়ে, ঔপনিবেশিকতার গন্ধ কাটিয়ে স্বাধীনতার ৭৫ বছরে পদার্পণ করে ফেলেছে একদা ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রত্ন’ এই দেশ। উপনিবেশের পুরনো রাজধানী কলকাতা শহরেই রয়ে গিয়েছে মহারানি ভিক্টোরিয়ার নামাঙ্কিত স্মারক। ভিক্টোরিয়ার উত্তরাধিকারী রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের ভূমিকাটা হয়তো ছিল স্রেফ ঔপচারিকতা রক্ষার। তিনি রাজকীয় ঐতিহ্যের নিয়মতান্ত্রিক উত্তরাধিকার। কিন্তু ভারত-সহ এশিয়া, আফ্রিকার অধুনা স্বাধীন বহু দেশের মালকিনও তো বটে। সেই সব দেশগুলির মধ্যে অগ্রগণ্য ভারত।

যে দেশে মহাসমারোহে চলছে স্বাধীনতার ৭৫ বছর উদ্‌যাপনের অনুষ্ঠান। চলছে ‘হর ঘর তিরঙ্গা’-র জাতীয়তাবাদী ব্রতপালন। সেই ‘অমৃত মহোৎসব’-এর নামাঙ্কিত প্যাডেই ভারতসম্রাজ্ঞীর উত্তরাধিকারকে স্মরণ করল নয়াদিল্লি!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.