১৮৯৭ সাল। মহারাষ্ট্রে প্লেগ মহামারীরূপে দেখা দিল। এক বৃটীশ অফিসার – পুণে শহরে মানুষের উপর নির্দয় ব্যবহারের জন্য যিনি কুখ্যাত ছিলেন – সেই অফিসার রান্ড প্লেগ কমিশনার নিযুক্ত হলেন। প্লেগ দমনে রান্ড অত্যন্ত অশোভন আচরণ শুরু করলেন। জোর করে শহর খালি করে দিতে লাগলেন এবং গোরা সৈন্যদের নিযুক্ত করা হল প্লেগ নিবারণের জন্য। তারা বাড়ি বাড়ি ঢুকে যুবতী মেয়েদের গা টিপে দেখতে লাগল প্লেগ হয়েছে কি না। প্লেগ রোগ নির্ণয় করা এবং তার চিকিৎসা করা গোরা সৈন্যদের কাজ নয় এবং প্লেগ বেছে বেছে যুবতী মেয়েদের দেহেই বাসা বাঁধে না। গোরা সৈন্যদের বদ মতলব সম্বন্ধে মারাঠা মানুষদের মনে আর কোন সংশয় রইল না।
এই ঘটনায় সমগ্র মারাঠা সমাজে প্রচণ্ড অসন্তোষ দেখা দিল ও মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। লোকমান্য তিলক তাঁর ‘কেশরী’ পত্রিকায় লিখলেন, ‘এর চেয়ে প্লেগ অনেক ভাল’। কিন্তু কিছুতেই বৃটীশ সরকার রান্ডকে অপসারিত করল না প্লেগ কমিশনারের পদ থেকে। অবশেষে দামোদর চাপেকার এবং তার বন্ধুরা সিদ্ধান্ত নিলেন যে সরিয়ে দিতে হবে এই ঘৃণ্য অফিসারটিকে। ১৮৯৭ সালের ২২শে জুন রাতে এল সুযোগ। রানী ভিক্টোরিয়ার রাজ্যাভিষেকের ষাট বছর পূর্তির উৎসব শেষে রান্ড এবং আর এক অফিসার লেফটেন্যান্ট আয়ার্স্ট যখন পুণে সরকারী ভবন থেকে ফিরছেন তখন একটি নির্জন স্থানে অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে দামোদর এবং তাঁর ভাই বালকৃষ্ণ চাপেকার গুলি করে হত্যা করে তাঁদের। লেফটেন্যান্ট আয়ার্স্ট সঙ্গে সঙ্গে মারা যান। গুরুতর আহত অবস্থায় রান্ডকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কয়েকদিন পর রান্ডের মৃত্যু হয়।
ভারতে বিপ্লবীদের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ সম্বন্ধে অনুসন্ধান করে রিপোর্ট দেওয়ার জন্য স্যার রাউলাটের অধীনে একটি কমিশন গঠিত হয়। রাউলাট কমিটি এই হত্যাকে ভারতের প্রথম বৈপ্লবিক হত্যা বলে অভিহিত করে।
বিদেশী শাসকদের মধ্যে আলোড়ন পড়ে যায়, কারা রান্ড ও আয়ার্স্টের হত্যাকারী! এত সাহস কার? শুরু হয় পুলিশি গোয়েন্দাগিরি। ধরা পড়েন দামোদর চাপেকার! তাও তাঁর এক সহকর্মীর বিশ্বাসঘাতকতায়! গণেশ শংকর বিদ্যার্থী সব কিছু ফাঁস করে দেয় বৃটীশ সরকারের কাছে। দামোদরকে পুলিশ গ্রেফতার করে কিন্তু বালকৃষ্ণ অধরাই থেকে যান পুলিশের কাছে। দামোদরকে যখন কোর্টে বিচারের জন্য আনা হয়, তিনি বিচারকের সামনে মাথা উঁচু করে জবাব দেন যে, তিনি অত্যাচারী অফিসার রান্ডকে হত্যা করে কোন ভুল করেননি। এর জন্য তাঁর কোন অনুতাপ নেই। দেশের মানুষকে অত্যাচারীর হাত থেকে রক্ষা করার জন্যই এই হত্যা।
বলা বাহুল্য, বিচারে দামোদর চাপেকারের মৃত্যুদণ্ডাদেশ হয়। জেলে থাকাকালীন বালগঙ্গাধর তিলক দামোদরকে শ্রীমদ্ভগবৎ গীতা উপহারস্বরূপ পাঠিয়েছিলেন। ১৮৯৮ সালের ১৮ই এপ্রিল পুণের ইয়েরওয়াড়া জেলে দামোদর চাপেকারের ফাঁসি হয়। সেই সময় তাঁর হাতে ছিল গীতা এবং তিনি আবৃত্তি করছিলেন গীতার শ্লোক।
ইতিমধ্যে, বালকৃষ্ণ চাপেকার এতদিন নিজাম রাজ্যের জঙ্গলের মধ্যে আত্মগোপন করেছিলেন। তিনি মহারাষ্ট্রে ফেরার সময়ই পুলিশের হাতে ধরা পড়লেন। ভাই বাসুদেবও ধরা পড়লেন পুলিশের জালে। কিন্তু বাসুদেব পুলিশের সংগে একটা কৌশল করলেন। তিনি পুলিশকে বোঝালেন যে যদি তারা তাঁকে ছেড়ে দেন, তা হলে বালকৃষ্ণের অপরাধের পক্ষে তিনি প্রমাণ সংগ্রহ করবেন। পুলিশ বাসুদেবের জালে পা দিল। কারাগার থেকে মুক্ত করে দিল তাঁকে। আসলে বাসুদেব তাঁর দাদা দামোদরের ফাঁসির বদলা নিতে চেয়েছিলেন। দামোদরকে যে ধরিয়ে দিয়েছিল সেই গণেশ শংকরকে ১৮৯৯ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি বাসুদেব কয়েকজন বন্ধুর সহায়তায় গুলি করে হত্যা করে। বিশ্বাসঘাতকের শাস্তি মৃত্যু!
ধরা পড়েন বাসুদেব। বালকৃষ্ণ, বাসুদেব এবং বাসুদেবের এক বন্ধু রানাড়ের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। পুণেতে ১৮৯৯ সালের ৮ই মে বাসুদেব চাপেকার এবং ১২ ই মে বালকৃষ্ণ চাপেকারের ফাঁসি হয়। সারা দেশে ঝড় বয়ে যায়। কারণ, একই পরিবারের তিন ভাইয়ের স্বাধীনতা যুদ্ধে ফাঁসির মঞ্চে জীবন উৎসর্গ করা বিরল ঘটনা। আর কি –ই বা বয়স তাদের! সদ্য যুবক!
স্বামী বিবেকানন্দ চাপেকার ভ্রাতাদের আত্মত্যাগের প্রশংসা করেছিলেন। তিনি তাদের সোনার মূর্তি নির্মাণ করে বোম্বের জাহাজঘাটে স্থাপন করতে বলেছিলেন। সিস্টার নিবেদিতা ভারত ভ্রমণের সময় যখন পুণে শহরে যান, তিনি ভক্তিতে বিগলিত হয়ে চাপেকার জননীর সামনে দাঁড়ালেন। তারপর ভূমিষ্ঠ হয়ে তাঁর পা ছুঁয়ে প্রণাম করলেন। ভারতের আর কোন মহিলাকে দেখে তিনি বিস্ময়ে এতটা অভিভূত হননি। এই মা ভারতবর্ষকে এমন সাহসী সন্তান উপহার দিয়েছেন! রান্ড ও আয়ার্স্ট হত্যা নিবেদিতা ভারতে আসার সাত মাস আগের ঘটনা।
যেদিন ইয়েরওয়াড়া জেলে দামোদর চাপেকরের ফাঁসি দেওয়া হলো , সেই রাত্রে মহারাষ্ট্রের নাসিক জেলার ভাগুর গ্রামে একটা ১৩ বছরের ছেলে একা ঘরে তলোয়ার দিয়ে নিজের আঙুল কেটে শপথ নিল , তোমাদের পবিত্র কাজ শেষ না করা পর্যন্ত আমি শান্তির মুখ দেখব না ! চাপেকরদের রক্ত থেকে উঠে আসা এই ছেলেটির নাম বিনায়ক দামোদর সাভারকার।
গত শতাব্দীর গোড়ার দিকে যে-কটি বিপ্লবী কার্যকলাপ হয়েছে , তার অনেকগুলির পেছনেই রয়েছে বীর বিনায়ক সাভারকরের সক্রিয় উৎসাহ। বাংলার বিপ্লবীরা যখন বোমা তৈরির মালমশলা শেখার জন্য একজন প্রতিনিধিকে লন্ডনে পাঠায় — তখন সাভারকার তাকে সাহায্য করেছিলেন। মদনলাল ধিংড়া সাভারকারের হাতে গড়া ছেলে। আবার মহারাষ্ট্রের “অভিনব ভারত” দলের যুবকদের কাছেও তিনি গোপনে পাঠিয়েছিলেন কুড়িটি রিভলবার। এই জ্বলন্ত পুরুষ চেয়েছিলেন তখনকার রুশ বিপ্লবীদের মতন সারা ভারতে গুপ্ত সমিতি স্থাপন করে নিজেদের প্রস্তুত হয়ে নিতে হবে। তারপর এক সময় হবে অভ্যুত্থান। কিন্তু তার আগেই সাভারকার ধরা পড়ে গেলেন।
সাভারকার শুধু অস্ত্র সংগ্রহই করতেন না, রণকৌশলও তিনি ঠিক করতেন।এ বিষয়ে তাঁর ছিল তীক্ষ্ণবুদ্ধি। এবং এই জন্যই সাভারকারের পক্ষে প্রয়োজন ছিল একটু আড়ালে থাকার। কিন্তু ভারতের কোনো একজন তরুণ বিপ্লবী নিজের ফাঁসির হুকুম শোনার পর একটু ক্ষোভের সঙ্গে বন্ধুদের কাছে বলেছিলেন , সাভারকার আমাদের মরণের দিকে ঠেলে দিয়ে নিজের প্রাণ বাঁচিয়ে আড়ালে লুকিয়ে থাকেন !
এই কথা ঘুরতে ঘুরতে একদিন সাভারকারের কানে গেল। তাঁর মতো তেজী পুরুষের পক্ষে একথা সহ্য করা সম্ভব নয়। হঠকারীর মতন তিনি তখুনি নিজের অজ্ঞাতবাস থেকে চলে এলেন লন্ডনে। আর প্রায় তার সঙ্গে সঙ্গেই ধরা পড়ে গেলেন ভিক্টরিয়া স্টেশনে।
সাভারকারের নাম ভারতে তখন দু’ দুটো কেস ঝুলছে। বিচারের জন্য তাঁকে নিয়ে আসতে হবে ভারতে। কঠোর পাহারায় তাঁকে তোলা হলো মুরিয়া জাহাজে। সাভারকার সাংঘাতিক আসামী — রক্ষীরা এক মুহূর্তের জন্যও তাঁকে চোখের আড়াল করে না। এমন কি তাঁর বাথরুমের দরজার মাঝখানেও কাচ বসানো আছে। তিনি বাথরুমে গেলেও রক্ষীরা কাচে চোখ লাগিয়ে নজর রাখে। কিন্তু এতো করেও তাঁকে আটকে রাখা গেল না। সাভারকার বাথরুমের দরজা বন্ধ করেই সেই কাছের ওপর তোয়ালে চাপা দিয়ে দিলেন। তারপর পোর্ট হোলের মধ্য দিয়ে লাফিয়ে পড়লেন সমুদ্রে।
জাহাজ তখন মার্সেই বন্দরের কাছে এসে ভিড়েছে। সাভারকার প্রানপনে সাঁতরে তীরের দিকে যেতে লাগলেন —- ততক্ষনে রক্ষীরা টের পেয়ে গুলি চালাতে শুরু করেছে। তবু সাভারকার ঠিক পৌঁছে গেলেন।
আগে থেকেই খবর পাঠানো ছিল, সাভারকার এইখানে জাহাজ থেকে পালাবেন। বীরেন চট্টোপাধ্যায় এবং মাদাম কামা আগে থেকেই গাড়ি নিয়ে উপস্থিত থাকবেন সেখানে। কিন্তু শেষরক্ষা হলো না। আসবার পথে গাড়ি খারাপ হয়ে যাওয়ায় বীরেন চট্টোপাধ্যায় আর মাদাম কামা ঠিক সময়ে পৌঁছতে পারেননি। সাভারকার একজন ফরাসী পুলিশকে জড়িয়ে ধরে বললেন , আমায় থানায় নিয়ে চল। ফরাসী দেশের মাটিতে ইংরেজ আমায় গ্রেপ্তার করতে পারে না।
ফরাসী পুলিশ কিছুই বুঝতে পারলো না। সারা গা ভিজে , একজন বিদেশী মানুষ হাত পা ছুঁড়ে বলছে কি ? সাভারকার ফরাসী ভাষা ভালো জানতেন না। ততক্ষনে ইংরেজ রক্ষীরা এসে পৌঁছে গেছে। তারা ফরাসী পুলিশকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে সাভারকারকে আবার জাহাজে তুললেন। আন্তর্জাতিক কানুন অনুসারে এই কাজটা বে-আইনি। আন্তর্জাতিক আদালতে এই নিয়ে মামলাও উঠেছিল। কিন্তু এশিয়ার কলোনির ব্যাপারে তখন ইংরেজ আর ফরাসী সরকারের খুব ভাব। একজন ভারতীয় বন্দিকে ইংরেজের হাতে তুলে দিতে ফরাসী সরকার আপত্তি করলেন না। সাভারকারকে এনে ভরা হলো ভারতের জেলে। নাসিক ষড়যন্ত্র মামলায় আলাদা ভাবে সাভারকারকে দু বার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হলো।
দণ্ডাদেশ শুনে সাভারকার কারারক্ষীকে বললেন, আমার জীবন তো একটাই। দুবার যাবজ্জীবন দণ্ড ভোগ করবো কি করে ?
কারারক্ষী বললো , তুমি এমন সাংঘাতিক অপরাধী যে শুধু এ জন্মে নয় , পরের জন্মেও তোমাকে জেলে পুরে রাখা হবে।
সাভারকার হাসতে হাসতে মন্তব্য করলেন, যাক , আমার জন্য তাহলে খ্রীস্টান ইংরেজদেরও পরজন্মে বিশ্বাস করতে হল।
বেঁচে থাকলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মেয়াদ হয় পঁচিশ বছর। সেই হিসেবে করে সাভারকার পরমুহূর্তেই ব্যাঙের সুরে কারারক্ষীকে বললেন , তোমার কি ধারণা , পঞ্চাশ বছর পরেও ইংরেজ এ দেশে টিকে থাকবে ? দেখা যাক !
সাভারকার জেলে গিয়েছিলেন ১৯১১ সালে। আমরা জানি, তার পর আর পঞ্চাশ বছর ইংরেজ এদেশে থাকতে পারেনি।
আন্দামান জেলে কি অসহ্য অত্যাচার ও নিপীড়ন সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে , তার বিবরণ আছে সাভারকারের আত্মজীবনীতে। তাঁর দাদা গণেশও তখন আন্দামানে। ওঁদের আর এক ভাইও কারারুদ্ধ।
আন্দামান জেলে অধিকাংশ ওয়ার্ডার এবং রক্ষীই ছিল উত্তর ভারতের অশিক্ষিত মুসলমান। এদের নৃশংস উৎপীড়নে অনেক রাজনৈতিক বন্দী আত্মহত্যা করেছে। অনেকে পাগল হয়ে গেছে। অনেকটা এদের জন্যই দুঃখের বিষয়, সাভারকারের মতন সংস্কারমুক্ত , তেজস্বী মানুষের মধ্যেও পরবর্তী জীবনে ধর্মীয় গোঁড়ামি এসে গিয়েছিল।
জেলখানায় বসে তিলক , শ্রীঅরবিন্দ, গান্ধীজি , নেহেরু , সুভাষচন্দ্র , সরোজিনী নাইডু প্রভৃতি অনেকেই উৎকৃষ্ট সাহিত্য সৃষ্টি করে গেছেন। কিন্তু সাভারকার যদিও কবি ছিলেন , তবু তাঁকে এক টুকরো কাগজও দেওয়া হয়নি। তাতেও নিরস্ত হননি তিনি। তাঁর ছোট্ট কুঠুরির দেওয়ালেই তিনি কাঠকয়লা দিয়ে লিখতে শুরু করলেন একটি গাথা কাব্য। কারারক্ষীরা কিছুদিন অন্তর অন্তর ঘরে ঢুকে দেখতে পেলেই সেই লেখা মুছে দিয়ে যেত। তার আগেই সাভারকার সেই অংশটুকু মুখস্ত করে ফেলতেন। ঘরের দেওয়াল যেন তাঁর কাছে স্লেটের মতন। এই ভাবে তিনি সমাপ্ত করেছিলেন ‘কমলা’ মহাকাব্য — যা মারাঠী ভাষায় একটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি।
১৮৫৭ সালে হিন্দু-মুসলমানের মিলিত প্রয়াসে সিপাহী অভ্যুত্থানের যে সার্থক ইতিহাস সাভারকার লিখেছিলেন , তা বহুদিন ধরে ভারতীয় মুক্তিকামীদের প্রেরণা জুগিয়েছে। গদর পার্টির লালা হরদয়াল, ভগৎ সিং এবং নেতাজি সুভাষ সেই বইয়ের বিভিন্ন সংস্করণ বার করে প্রচার করেছিলেন।
আজ মে মাসের ২৮ তারিখ, সেই বিনায়ক সাভারকারের জন্মদিবস। স্মরণ করি শ্রদ্ধায়।
প্রীতম চট্টোপাধ্যায়
তথ্যঋণ :
১) আনন্দবাজার আর্কাইভস
২) অগ্নিপুত্র — সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়