২০১৪ সালে নির্বাচনী ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বদমেজাজি সমালোচকদের চটজলদি প্রতিক্রিয়া ছিল যে, বিজেপি তো মাত্র ৩১ শতাংশ ভোট পেয়ে জিতেছে। ২০১৯-এ ভারতীয় নির্বাচকমণ্ডলী দু’একটি রাজ্য বাদ দিয়ে নরেন্দ্র মোদীর দেশজোড়া তুমুল বিজয় বার্তা দিয়েছেন, তারপর আগামী পাঁচ বছর শতাংশের হিসেব করে ওই সব হেঁদো বক্তব্য যে আর শোনা যাবে না তা নিশ্চিত। অবশ্য বিধ্বস্ত বিরোধীদের মধ্যে ছুটকো ছাটকা কেউ কেউ EVM সংক্রান্ত কিছু মিউ মিউ চালালেও এই দ্বিতীয় দফায় মোদীর অবিসংবাদিত নির্বাচনী মান্যতা ও দেশব্যাপী প্রতিষ্ঠা নিয়ে উচ্চবাচ্য করেন না। ৩০৩ জন বিজেপি সাংসদের ভোট শতাংশের হিসেবে ৪১ এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে জোট সঙ্গীদের ৪৭ জন সাংসদ ও তাদের সংগৃহীত ৭ শতাংশ ভোট। দুয়ে মিলে ৪৮ শতাংশ ভোট ও ৩৫০ জন সাংসদ সন্দেহতীতভাবে বিজেপিকেই ২০১৯-এর সেরা বিজয়ীর মর্যাদা দিয়েছে। সাধারণত চুপচাপ থাকা নির্বাচকমণ্ডলী যে বিপুল সাফল্য মোদীকে এনে দিয়েছেন তাতে রাজনৈতিক পণ্ডিতরা ভয়ার্তভাবে হতবাক হয়ে গেছেন। সদা এই হট্টগোলের দেশে হম্বিতম্বিটা সব সময় মেনে চললেও রাজনৈতিক ঝড় ওঠার একটা চোরা স্রোত কিন্তু দৃশ্যমান হচ্ছিল। এক শ্রেণীর সমালোচক মোদী বিতৃষ্ণায় আটকে থেকে চোখ বন্ধ রেখে তার সমালোচনা করে যাচ্ছিলেন। এই দলভুক্তরাই এখনও দেশবাসীর দেওয়া এই বিপুল জনমতকে তাদের তৈরি Idea of India-র বিরোধী বা সংবিধানের সঙ্গে সাযুজ্য রক্ষাকারী নয় বলে হাহুতাশ করছেন। তার কারণ বোঝা যায়। বাস্তবে মানুষ যে ভঙ্গুর জোট ও পরিবারবাদী রাজনীতিকে সমূলে প্রত্যাখ্যান করেছে সেই সত্যকে অস্বীকার করে জনতার এই সিদ্ধান্তকে বিভ্রান্ত ভোটদাতাদের ন্যায়ের পথকে পরিত্যাগ করা বলে চাউর করা হচ্ছে। এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায় আমেথিতে রাহুল গান্ধী যে ঔদ্ধত্যের মাধ্যমে তার পরাজয় স্বীকার করলেন তার বহিঃপ্রকাশের মাধ্যমে। গণনা শেষ হওয়ার আগেই তার এই ঘোষণার মধ্যে যতটা ঔদার্যের না পরিচয় ছিল তার থেকে ঢের বেশি ছিল আমেথিবাসীর ওপর তীব্র বিশ্বাসঘাতকতাজনিত চাপা ধিক্কার।
একজন দৃঢ়চেতা নেতা ও শক্তিমান জাতির নির্বাচনের মাধ্যমে ক্রমবিকাশ যথার্থই এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর পরবর্তী ২৫ বছর ধরে ভারত কিছুটা তাল মিলিয়ে চলতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। শুধু তাই নয়, এটিকেই প্রায় জাতীয় দর্শনের পর্যায়ে তুলে এনেছিল। এই দায়সারা ভাবকে মোদী মুখোমুখি চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। বিমুদ্ৰীকরণ, জিএসটি চালু করা বা দুর্নীতিবাজদের ওপর বজ্ৰ-আঁটুনি লাগানো সহজ কাজ নয়। এতে যে হিম্মত লাগে রাজনৈতিক ঝুঁকি নিতে অপারগ বহু নেতারই তা ছিল না।
ঠিক এই মানসিকতা থেকেই জঙ্গি মনোভাবসম্পন্ন পড়শীর মোকাবিলা করতে এক ধরনের নিরাপদ কূটনৈতিক কৌশল প্রয়োগ করে চলার যে ছলনা চলছিল তার বদলে বলদৃপ্ত প্রত্যাশা যে অনেক বেশি ফলদায়ী তা আজ প্রমাণিত। দেশের লালাট লিখন সম্পর্কে মোদীর এক গভীর অনুভব ও অভিনিবেশ আছে। বিগত ৫ বছরে এই ভাবনা যে তার মধ্যে সদা জাগরিত ছিল তার প্রমাণ তার সাম্প্রতিক প্রচার স্লোগানের সূত্র ধরেই বলা যায়—‘মোদী আছে বলেই সম্ভব’ (মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়)। ১৯৭১ সালে ইন্দিরা গান্ধী প্রথম দৃঢ়চেতা হয়ে দেশ শাসনের ইঙ্গিত রেখেছিলেন। মানুষ তাকে ঢেলে ভোট দিয়েছিল।
এই নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে বড় ধরনের শক্তিশালী নির্বাচনী জোটকে ধ্বস্ত করার পাশাপাশি এযাবৎ অপরিচিত পূর্বভারতের রাজ্যে গিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে সাফল্য কুড়িয়ে নিতে মোদী সক্ষম হয়েছেন। অবশ্যই এর জন্য দলের অত্যন্ত সুশৃঙ্খল নির্বাচনী কার্যকর্তাদেরও ভূমিকা অনস্বীকার্য। চিরচারিতভাবে ক্ষমতাসীন সরকার তার আমলাতান্ত্রিকতার মাধ্যমে সরকার পরিচালনা করে রাজনৈতিক ভাবে জনতাকেন্দ্রিক হতে তাদের সচরাচর দেখা যায় না। অটলবিহারী বাজপেয়ী ও তার শাসনকাল নিশ্চিতভাবেই প্রশংসার দাবি রাখে। তিনি কিন্তু এই পথই অনুসরণ করেছিলেন। মোদী অমিত শাহকে পাশে নিয়ে রাজ্যপাটের গুণগত পরিবর্তনগুলিকে সরাসরি জনতার মধ্যে নিয়ে গিয়ে ফেলেছেন। পরিবর্তনজনিত উত্তেজনাকে তাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চেয়েছেন। এক্ষত্রের দল ও সরকার পরিপূরক হিসেবে কাজ করেছে। বিশেষ করে তরুণ ভোটারদের মধ্যে বিপুল গ্রহণযোগ্যতা থাকায় তারা উজ্জীবিত বোধ করেছে। যে সমস্ত রাজ্যগুলিতে বি জে পি বিগত নির্বাচনেই সাফল্যের শীর্ষ সীমা ছুঁয়েছিল, এবারেও সেখানে একই অবিশ্বস্য সাফল্যের পুনরাবৃত্তি হয়েছে। এ থেকে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, সব রকমের ভোট ম্যানেজমেন্ট ছাড়াও এই নির্বাচন ছিল মানুষের স্বতঃপ্রণোদিতভাবে মনোমতো। মানুষটিকে কাজের সুযোগ করে দিতে এক উন্মাদনার নির্বাচন।
ব্যাপক নির্বাচনী হিংসা এবং অধিকাংশ জায়গায় প্রায় অস্তিত্বহীন দলীয় সংগঠন নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে এক ধাক্কায় ৪০ শতাংশ জনতার ভোট ও ১৮টি আসন জিতে নেওয়া এর অকাট্য প্রমাণ। নির্বাচনী সাফল্যের সুর ছিল আকাঙ্ক্ষা ও জাতীয় গর্বের তালে বাঁধা। বালাকোটে ভারতীয় বায়ুসেনার সীমানা পেরিয়ে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ শিবিরে ঢুকে তাদের ধ্বংস করা ও মোদীর বারবার এই ধরনের প্রত্যাঘাতের প্রতিশ্রুতি দেওয়া নিশ্চিতভাবেই জাতির মধ্যে এক নতুন প্রাণসঞ্চার করেছিল। বলীয়ান হয়েছিল জাত্যাভিমান। তবুও শুধুমাত্র জাতীয়তাবোধের পতাকা বাতাসে উড্ডীয়মান রাখলেই দেশের অভ্যন্তরে শক্তিসঞ্চয় করে নতুন রাজনৈতিক জোটবন্ধন ধ্বংস করা যেত না। কখনই নির্মূল করা যেত না জাতি বর্ণের ভিত্তিতে একজোট হওয়া বিভিন্ন গোষ্ঠীগুলিকে। তৃণমূল স্তরে তাদের জীবনযাত্রার ওপর প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলতে পারার কারণেই এই ফল। গত ৫ বছর ধরে নিষ্ঠার সঙ্গে করা হয়েছে।
নরেন্দ্র মোদী নিশ্চিত আশার বাণী শুনিয়েছিলেন। কিন্তু সমস্ত রাজনীতিবিদরাই তো চরিত্রগতভাবে প্রতিশ্রুতির কথা, আশার কথা বলে থাকেন। তফাত হচ্ছে মোদী বলেছিলেন তিনি যা যা ইতিমধ্যেই মানুষের জন্য করতে পেরেছেন তার ওপর দাঁড়িয়ে। মানুষ তার নিজস্ব অর্জনের সঙ্গে মিলিয়ে। দেখেছিল এই প্রবীণ নেতার কথাগুলি অধিকাংশই সত্য। তাই ভরসা রাখা। প্রয়োজন। বিজেপি-র নির্বাচনী ইস্তাহার কিন্তু আদৌ কংগ্রেসের মতো ভুরি ভুরি প্রতিশ্রুতির সমাহার নয়। কংগ্রেস দলের মতো মাসে ৬ হাজার টাকা দেওয়ার আকর্ষণীয় কিন্তু অলীক কোনো উপঢৌকনের হাতছানি দলের ইস্তাহারে ছিল না। বিজেপির তরফে এমন গালভরা প্রতিশ্রুতির আভাস কিছু রাজনৈতিকভাবে কোনো ক্ষতি করেনি। কেননা ভোটদাতারা সরকারের কাজকর্মকে বিচার করেছিলেন দলের সর্বাঙ্গীণ আচার আচরণের ভিত্তিতে। সরকারের উদ্দেশ্যের সততার নিক্তিতে। প্রধানমন্ত্রী তার প্রচারসভাগুলিতে বারবার বলেছিলেন | দেশবাসী যেন তার কাজের ন্যায়পরায়ণতাকে বিচার করে। আজকের এই অতুল নির্বাচনী সাফল্যের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে অনাগত ভবিষ্যতের দিকনির্দেশ করা বিপজ্জনক। বাস্তবে দেশবাসী নতুন এক ভারত নির্মাণের একচ্ছত্র ক্ষমতা নির্ভয়ে সমর্পণ করেছে মোদীর হাতে। এই বিষয়টা নিয়েই তুমুল আতঙ্কিত তার ছিদ্রান্বেষীরা। কিন্তু তাঁকে এই ন্যস্ত বিশ্বাসের মর্যাদা দিতেই হবে। আগামীদিনে এই ভারতভূমি আরও কতটা সুজলা সুফলা হয়ে উঠল তার ওপরই নির্ভর করবে তার ভবিষ্যৎ মূল্যায়ন।
স্বপন দাশগুপ্ত
2019-05-31