ভারতে ৫ রাজ্যের নির্বাচনী ফলাফল, বিশ্বজুড়ে এর চর্চা ও মোদির জনপ্রিয়তার ঝড়ে উড়ে গেল বিরোধীরা

গত ৩ই ডিসেম্বর ভারতের ৫ রাজ্যের (মধ্য প্রদেশ, রাজস্থান, ছত্রিশগড়, তেলেঙ্গানা ও মিজোরাম) নির্বাচনী ফলাফল হয়ে গেল। এই নির্বাচন রেজাল্ট বলে দিচ্ছে ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনে আবারও নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসতে যাচ্ছেন। আমি গত এক মাস ধরে ভারতের এই ৫ রাজ্যের বিভিন্ন দলীয় প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারণা ও সেখানের জনতার ভোট গ্রহন দেখে আসছি, দেখছি অবশেষে কে বিজয়ী হন?

ভারতের নির্বাচন ব্যবস্থা এতোটা নিখুঁত ও সাবলীল যে, যেকোনো রাজ্যে যদি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে জনতার মধ্যে এক রকম আনন্দমুখর উৎসব উৎসব ভাব চলে আসে। আর এটাই হলো একটা গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য। একটা গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত গন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সুষ্ঠু ধারায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা। আর ভারতের নির্বাচন কমিশন তা শত ভাগ দায়িত্ব ও স্বচ্ছতার সাথে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করেছেন। কার পার্টি কত আসন পাবে, কে এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করবে, রাজ্যের অলিতে গলিতে এই নিয়ে চলে আলোচনা। তাছাড়া একসাথে এই ৫ রাজ্যের নির্বাচন কংগ্রেস ও বিজেপির জন্য বড় একটা চ্যালেঞ্জও ছিল বটে। বিশেষ করে কংগ্রেসের জন্য এই নির্বাচন ছিলো বাঁচা মরার লড়াই। চলুন দেখে আসি এই ৫ রাজ্যের নির্বাচনী ফলাফল কেমন হলো?


মধ্য প্রদেশে বিধানসভার আসন সংখ্যা হলো ২৩০টি। সেখানে বিজেপি একাই আসন পেয়েছেন ১৬৪টি, কংগ্রেস পেয়েছে ৬৬টি ও অন্যান্য পেয়েছেন ১টি আসন।


রাজস্থানে বিধানসভার আসন সংখ্যা হলো ১৯৯টি। এখানেও বিজেপি একাই পেয়েছে ১১৫টি আসন, কংগ্রেস পেয়েছেন ৬৯টি আসন ও অন্যান্য দল পেয়েছেন ১৫টি আসন।


ছত্রিশগড় রাজ্যে বিধানসভার আসন সংখ্যা হলো ৯০টি। সেখানে বিজেপি পেয়েছে ৫৪টি আসন, কংগ্রেস ৩৫টি আসন ও অন্যান্য একটি আসন পেয়েছে।


দক্ষিন ভারতের তেলেঙ্গানা রাজ্যে বিধানসভার আসন সংখ্যা ১১৯টি। কংগ্রেস পেয়েছে ৬৪টি আসন, স্থানীয় দল BRS (কেশব চন্দ্রশেখর রাওয়ের দল ভারত রাষ্ট্র সমিতি) ৩৯টি আসন, আর এই রাজ্যে বিজেপি গতবারের ১ আসন থেকে সোজা এক লাফে পেয়েছে ৮ আসন! আর আসাদউদ্দিন ওয়েসির দল পেয়েছেন ৭ টি আসন। আগে ওয়েসির ৯টি আসন ছিলো।


উত্তর পূর্ব ভারতের মিজোরাম রাজ্যে বিধানসভার আসন সংখ্যা ৪০টি। সেখানে স্থানীয় দল ZPM পেয়েছে ২৭টি আসন, MNF পেয়েছে ১০টি আসন, বিজেপি ২টি আসন ও কংগ্রেস পেয়েছে ১টি আসন।

এই ৫ রাজ্যে বিজেপি একাই তিনটি রাজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে এককভাবে সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। আর কংগ্রেস এককভাবে সরকার গঠন করতে যাচ্ছে তেলেঙ্গানায়। তবে আমি এই নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ইন্টারেস্ট ছিলাম তেলেঙ্গানা রাজ্য নিয়ে। তেলেঙ্গানায় কিভাবে কংগ্রেস পার্টি স্থানীয় দল BRS কে হারিয়ে ক্ষমতায় চলে আসলো এই সমীকরণ আমি কোনোভাবেই মেলাতে পারছিলাম না। তেলেঙ্গানায় একদিকে কট্টরপন্থী মুসলিমদের নেতা আসাদউদ্দিন ওয়েসি, আরেক দিকে বিজেপির ফায়ার ব্র‍্যান্ড নেতা টাইগার রাজা সিং, ওদিকে কংগ্রেসের হয়ে লড়েছে সাবেক ইন্ডিয়ান ক্রিকেটার ও অধিনায়ক মোঃ আজহার উদ্দিন। যে যার জায়গা থেকে নির্বাচনী খেলাটা ভাল জমেছে। তবে তেলেঙ্গানায় কংগ্রেস আসায় ভাল হয়েছে। কংগ্রেস এন্ট্রি নেয়ায় এই রাজ্যে আসাদউদ্দিন ওয়েসির ভোট ও BRS এর ভোট অনেক কমেছে। আর বিজেপির ভোট সংখ্যা তো ৭% থেকে এক লাফে ১৪% চলে গিয়েছে।

তবে এই ৫ রাজ্যের নির্বাচনে বিজেপি এবার কোনো মুখ্যমন্ত্রী বা স্থানীয় লিডারকে সামনে রেখে নির্বাচন করেননি। এবার বিজেপি শুধু জনগণের কাছে মৌদির নামেই ভোট চেয়েছেন। কারণ নরেন্দ্র মোদি এই পর্যন্ত তাঁর নির্বাচনী ইশতেহারের জনগণকে যা যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছেন তা অক্ষরে অক্ষরে তিনি পালন করেছেন। তাই মধ্য প্রদেশ, রাজস্থান, ও ছত্রিশগড় রাজ্যের জনগন নরেন্দ্র মোদি উপর আস্থা রেখেই ভোট দিয়েছেন। এই তিন রাজ্যের পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী কে হবেন বিজেপির নীতি নির্ধারকরা হেডকোয়াটারে বসে ঠিক করবেন। তবে মধ্য প্রদেশে জোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া ও রাজস্থানে যোগী বাবা বালক নাথকে মুখ্যমন্ত্রী পদে বসানো হতে পারে বা বসুন্ধরা রাজেকে বসানো হতে পারে। আর ওদিকে রাহুল গান্ধী পরাজয় হওয়ার কারণ হলো, সেই এই পর্যন্ত জনগণকে যে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তার একটাও ঠিকভাবে রক্ষা করতে পারেননি। কংগ্রেস উলটো জনগণের সাথে প্রতারণা করে এসেছেন বার বার। জনগনের সাথে প্রতারণা করলে জনগণ কেন ভোট দেবে বলুন?

এই ৫ রাজ্যের নির্বাচনে কংগ্রেস চারটিতে হারার পর তাদেরই গড়া “ইন্ডিয়া জোট”-এর কাছে দলটির একরকম অগ্নি পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে! কারণ যে কংগ্রেস ২৬টি দল সঙ্গে নিয়ে যে বিরোধী জোট ইন্ডিয়া গঠন করেছিলেন, সেই ২৬ টি দল থেকে এখন একে একে কংগ্রেসের দিকে সমালোচনার তীর ছুটে আসছে। সমাজবাদী পার্টির লিডার অখিলেশ যাদব তো রাহুল গান্ধীর সমালোচনা গত ১ মাস আগে থেকে শুরু করেছেন। নির্বাচনের পর গতকাল কংগ্রেসের আয়োজনে দিল্লিতে ইন্ডিয়া জোটের একটি বৈঠক ডাকা হয়। সেখানে মমতা ব্যানার্জি যায়নি, অখিলেশ যাদব যায়নি, আর সম্ভবত বিহারের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী নিতিশ কুমারও এই বৈঠকে সামিল হননি। কারণ তারা বিরোধী জোটের লিডারশীফ হিসেবে আর কংগ্রেসকে চাইছেন না। এদিকে পশ্চিম্বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা চাই জোটে নিজে লিডার হতে। উত্তর প্রদেশের অখিলেশ যাদবও চান লিডার হতে, বিহারের নিতিশ কুমারও চান বিরোধী জোটের লিডার হতে। কারণ ২৪-এ নরেন্দ্র মোদিকে হারানোর জন্য যে ২৬টি দল এক জোট হয়েছে, এখন দেখা যাচ্ছে তাদের মধ্যেও কোনো মতানৈক্য নেই! যদি মতানৈক্য না থাকে তারা নরেন্দ্র মোদিকে হারাবে কি করে? ভারতের লোকসভার আসন সংখ্যা হলো ৫৪৫টি, বর্তমানে বিজেপির একাই দখলে আছে ৩০৩টি আসন। আর বিজেপির জোট এনডিএর আছে আরো ৩৫টি আসন। সেখানে ২৬টি দল মিলে নরেন্দ্র মোদিকে হারানোর কোনো রাস্তাই তো দেখা যাচ্ছে না। যেখানে বিরোধী দল কংগ্রেসের আসন সংখ্যা মাত্র ৫২টি!

এই ৫ রাজ্যের নির্বাচন-ফলাফলের চর্চা শুধু ভারতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, এর চর্চা সুদূর আমেরিকা থেকে ইউরোপ, রাশিয়া, পাকিস্তান ও আরব রাষ্ট্রগুলোতেও হচ্ছে। আর বাংলাদেশে চর্চা করার জন্য তো আমি প্রথম সারিতেই আছি। তবে এই নির্বাচনে একটা বিষয় আমার সবচেয়ে ভাল লেগেছে, নরেন্দ্র মোদির মুসলিম ভোট আগের থেকে দ্বিগুণ বেড়েছে। আগে এই রাজ্যগুলিতে কংগ্রেসে মুসলিম ভোট পড়তো ৯৫%! এখন কংগ্রেসে মুসলিম ভোট পড়ে ৭০%। কংগ্রেসের ২৫% মুসলিম ভোট এখন বিজেপির দখলে। কারণ মুসলিমরা আস্তে আস্তে সভ্য হচ্ছে। ভারতের মুসলমানরা বুঝে যাচ্ছে যে, এতকাল কংগ্রেস শুধু তাদের ভোটকে ব্যবহার করেছে মাত্র, তাদের জীবন ও শিক্ষার কোনো উন্নতি করেনি। উলটো মুসলমানদের তুষ্টি করণ করে, ধর্মীয় ভাবাবেগে সুড়সুড়ি দিয়ে তাদের জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের সমর্থন করার এক অন্ধকার পথে ঠেলে দিচ্ছে কংগ্রেস। আর বিজেপি আইন করে মুসলিম নারীদের মৌখিক তালাক পাওয়ার রীতি থেকে মুক্তি দিয়েছেন। আর নরেন্দ্র মোদি এই পর্যন্ত রাষ্ট্রের জনগনের হিতের জন্য যে যে যোজনা ঘোষণা করেছেন, তার ফল দিনশেষে হিন্দু মুসলিম সবাই তো পাচ্ছেন। তো তারা কোন দুঃখে কংগ্রেসকে ভোট দিতে যাবেন? তবে এই ক্ষেত্রে তেলেঙ্গানার মুসলিমরা ব্যতিক্রম। এইবার তেলেঙ্গানার ৮৩% মুসলিম ভোটাররা কংগ্রেসকে ভোট দিয়েছেন।

১৪ সালে যখন নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসছিলেন, তখন গোটা উপমহাদেশ জুড়ে মোদি বিরোধী এমন একটা নেতিবাচক প্রোপাগাণ্ডা তৈরি করা হয়েছিল যে, মোদি মাত্রই যেন মুসলমান বিরোধী৷ শুধু তাই নয়, তখন গোটা উপমহাদেশের নাস্তিকরাও মোদি বিরোধী শক্ত অবস্থান নিয়েছিলেন। তখন কে জানতো ভারত এমন কি পুরো বিশ্বকে পরিবর্তন করার জন্য ১৪ সালে একজন মহাকাল ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিচ্ছেন। সেই মহাকালের দাপটে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সন্ত্রাসবাদী চেতনা আজ কোমায় চলে গেছে। মুসলমানরা নরেন্দ্র মোদিকে কতটা ভালবাসেন, তা জানতে হলে আপনাকে গুজরাটের মুসলমান এলাকাগুলোতে যেতে হবে। সেখানে যদি আপনি অযথা মোদির বিরুদ্ধে মিথ্যাচার বা প্রোপাগাণ্ডা ছড়ান, সেখানে গুজরাটের মুসলমানরাই জবাব দিয়ে দেবে মোদি মুখ্যমন্ত্রী থাকা কালীন তাদের জন্য কতটা মহান নেতা ছিলেন। কারণ গুজরাট রায়টের পেছনে মোদির হাত ছিলো না, ছিলো কংগ্রেসের হাত। কংগ্রেস যদি উগ্রবাদী মুসলমানদের দিয়ে গোধরা স্টেশনে সবরমতি রেল-এ ৬০ জন কর সেবকদের যদি জ্যান্ত পুড়িয়ে না মারতো, তাহলে ২০০২ সালে গুজরাটে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়তো না। আর প্রধানমন্ত্রী মোদি যে মুসলমান বিরোধী নয়, সেটা তিনি মুসলমানদের হিতের পক্ষে কাজ করেই গত ৯ বছরে প্রমান দিয়েছেন। হ্যাঁ মোদি মুসলমান বিরোধী নয়, তবে হ্যাঁ, মোদি অবশ্যই ইসলামিস্ট সন্ত্রাস বিরোধী। ভারতে প্রধানমন্ত্রী হয়ে মোদি আসার পর পাকিস্তানে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। এই ৫ রাজ্যের নির্বাচনের বিষয়ে একটা জিনিস জেনে আমার খুব লাগছে যে, ভারতের মুসলমানরা আগে মোদির প্রতি যে হিংসা ও ঘৃণা প্রকাশ করতো, আজ সেই মুসলমানরাই নরেন্দ্র মোদিকে নির্বাচনে দুই হাতে ভোট দিয়ে বিজয়ী করছেন। এই নির্বাচনে মুসলমানদের প্রতি কংগ্রেসের ধর্মীয় সুড়সুড়ি দেয়ার ভাবাবেগে কোনো কাজেই আসেনি।

–মোদি গত সাড়ে ৯ বছর প্রধানমন্ত্রী থেকে ভারতকে বিশ্বের যে উঁচু স্থানে নিয়ে গেছেন, তা দেখে পাকিস্তানেও নরেন্দ্র মোদির চর্চা হয়। অনেক পাকিস্তানি জনগণ তো বলেই ফেললেন মোদির মতো প্রধানমন্ত্রী আমাদের পাকিস্তানেও চাই।

লেখক, রাজীব ধর

৬/১২/২৩ইং

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.