বাংলায় বিজেপি কি বাড়ছে, নাকি রুখে দিয়েছে তৃণমূল, আজ তিন আসনে উপ নির্বাচন বড় ইঙ্গিত দিতে পারে

উপ নির্বাচনের ভোট নিয়ে কবে উত্তেজনা ছিল বাংলায়? হাতে গুণে কয়েক বারই তা হয়েছে। কিন্তু লোকসভা ভোটের পর পর আজ বাংলায় তিন আসনে উপ নির্বাচন নিয়ে শাসক-বিরোধী দুই শিবিরেই উৎকণ্ঠার স্রোত বইছে।

কেন?

সেই কারণ অনুসন্ধানের আগে জেনে নেওয়া যাক, কোন কোন আসনে উপ নির্বাচন হচ্ছে। খড়্গপুর সদর বিধানসভা থেকে বিধায়ক ছিলেন রাজ্য বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ। তিনি মেদিনীপুর লোকসভা থেকে সাংসদ পদে নির্বাচিত হওয়ার কারণে খড়্গপুর উপ নির্বাচন হচ্ছে। একই ভাবে করিমপুরের বিধায়ক মহুয়া মৈত্র কৃষ্ণনগর লোকসভায় জেতায় উপ নির্বাচন হচ্ছে সেখানে। আর উত্তরবঙ্গের কালিয়াগঞ্জের কংগ্রেস বিধায়কের মৃত্যুর কারণে সেখানেও উপ নির্বাচন হচ্ছে।

এমনিতে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে আম ধারণা হল, উপ নির্বাচনে রাজ্যের শাসক দলই জেতে। অনেকের মতে, প্রশাসন ও পুলিশ সে ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা নেয়। বাংলায় বাম শাসনে সেটাই ছিল রীতি। তৃণমূল শাসনেও তার ব্যতিক্রম বিশেষ হয়নি। সেই ট্রাডিশন অনুযায়ী তিন আসনে জেতাই তৃণমূলের কাছে চ্যালেঞ্জ। অথচ বাস্তব পরিস্থিতি মোটেই তেমন নয়।

রায়গঞ্জ লোকসভা আসনে এ বার জিতেছে বিজেপি। হিসেব অনুযায়ী লোকসভা ভোটে কালিয়াগঞ্জ বিধানসভায় বিজেপি-র জয়ের ব্যবধান ছিল প্রায় ৫৭ হাজার। বড় কথা হল, তার পর থেকে কালিয়াগঞ্জে তৃণমূলের সংগঠন আরও মজবুত হয়েছে এমন নজির নেই। বরং লোকসভা ভোটের পর কালিয়াগঞ্জে সাংগঠনিক শক্তি বাড়িয়েছে বিজেপি। ৫৭ হাজারের ব্যবধান ঘোচানো শুধু কঠিন নয়, বড় কঠিন লড়াই তৃণমূলের।

এ ক্ষেত্রে একটা পরিসংখ্যান তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলায় অবাধ ও শান্তিপূর্ণ ভোট যে হয় না সে ব্যাপারে বারবার অভিযোগ করে বিজেপি। সে জন্য নির্বাচন কমিশনের কাছে বারবার দাবি জানায় যে একশ শতাংশ বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করতে হবে। কিন্তু কালিয়াগঞ্জে কাল উপ নির্বাচনে হিসাব মতো ৪০ শতাংশ বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হচ্ছে। তাতেও বিজেপি-র হেলদোল নেই।

অন্যদিকে করিমপুর বিধানসভা আসনে তৃণমূলের লিড ছিল ১৪ হাজার। করিমপুরের একটি ব্লক সংখ্যালঘু অধ্যুষিত। তৃণমূলের সাফল্যের রসায়ন ছিল সেটাই। কিন্তু এ বার কংগ্রেস-সিপিএম জোট বেঁধে সেখানে প্রার্থী করেছেন ডিওয়াইএফআইয়ের প্রাক্তন জেলা সম্পাদক গোলাম রাব্বিকে। অনেকের মতে, বাম-কংগ্রেসের উদ্দেশ্য পরিষ্কার। তা হল, সংখ্যালঘু ভোটে ভাগ বসিয়ে তৃণমূলের যাত্রাভঙ্গ করা। আর তাতে যদি এ বার তাঁরা সফল হয়ে যান, তা হলে একুশের বিধানসভা নির্বাচনে সেই ফর্মুলা আরও ভোগাতে পারে তৃণমূলকে।

সর্বোপরি খড়্গপুর সদর বিধানসভা কেন্দ্রে আলোকপাত করা যাক। লোকসভা ভোটে এই কেন্দ্রে ৪৫ হাজার ভোটে এগিয়েছিলেন দিলীপ ঘোষ। এমনিতেই তৃণমূল শাসনেও খড়্গপুর শাসক দলের কাছে অধরাই ছিল। তার উপর ৪৫ হাজারের ব্যবধান কমানোটা কম কথা নয়। কিন্তু পর্যবেক্ষকদের অনেকের মতে, খড়্গপুরে দিলীপবাবুর বিরুদ্ধে স্থানীয় স্তরে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা রয়েছে। তৃণমূলের প্রার্থী প্রদীপ সরকারও এলাকার দাপুটে নেতা। তার থেকেও বড় হল, খ্ড়্গপুরে ভোটের দায়িত্ব পরিবহণ ও সেচমন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারীকে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দুই মেদিনীপুরের রাজনীতি মূলত যিনি নিয়ন্ত্রণ করেন।

সার্বিক এই প্রেক্ষাপটে ২৫ নভেম্বরের উপ নির্বাচন তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে বলেই পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন। তাঁদের মতে, এই তিন আসনের ফলাফল অনেক ইঙ্গিত বহন করতে পারে। যেমন: এক, খড়্গপুর ও কালিয়াগঞ্জ আসন বিজেপি স্বস্তিজনক ব্যবধানে জিত পারলে বোঝা যাবে যে লোকসভা ভোটের পর তাদের জনভিত্তি অটুট রাখতে পেরেছে গেরুয়া শিবির।

দুই, একই ভাবে করিমপুরে তৃণমূল জয় নিশ্চিত করতে পারলে বোঝা যাবে তৃণমূলের জনভিত্তিতে আর ক্ষয় হয়নি। অন্তত সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় তাদের রসায়ন অটুট।

তিন, খড়্গপুর ও কালিয়াগঞ্জে বিজেপি-র জয়ের ব্যবধান যদি কমে যায় বা কোনও একটা আসনে যদি হেরে যায়, তা হলে সংশয় নেই তৃণমূল যারপরনাই অক্সিজেন পাবে। বিশেষ করে খড়্গপুরে বিজেপি-র ব্যবধান কমলে তৃণমূল এই বার্তা দিতে পারবে যে তারা অনেকটাই ক্ষতপূরণ করতে পেরেছে। আর বিজেপি সেখানে যদি পর্যুদস্ত হয়, তা হলে কথাই নেই। তা প্রবল উদ্দীপনা যোগাতে পারে তৃণমূল নেতা কর্মিদের। দলের মধ্যে শুভেন্দু অধিকারীর কদর ও মর্যাদা দুই-ই তাতে বাড়ার কথা।

চার, একই ভাবে করিমপুরে তৃণমূলের জয়ের ব্যবধান কমলে তা শাসক দলের জন্য প্রবল উদ্বেগের কারণ হবে বইকি। তখন দেখতে হবে, বাম-কংগ্রেস কতটা ভোট পেয়েছে সেখানে। সংখ্যালঘু ভোটের ভাগাভাগিই বা কী হারে হয়েছে। বাম-কংগ্রেস যদি করিমপুরে উল্লেখযোগ্য হারে ভোট পায় তা হলে একুশের দেওয়াল লিখন এখনই বলে দেওয়া যাবে। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত রাজ্যের সব আসনে বাম-কংগ্রেসের জোট তখন সংখ্যালঘু প্রার্থী দিয়ে তৃণমূলকে হারাতে চাইবে। করিমপুরে বিজেপি জিততে পারলে তা হবে তাদের মাইলফলক সাফল্য। কারণ, তখন বাংলায় সংখ্যালঘুদেরও বিজেপি বার্তা দিতে পারবে।

তিন আসনে উপ নির্বাচনের ফল ঘোষণা হবে ২৮ নভেম্বর। সেদিন তিন কেন্দ্রওয়াড়ি বিস্তারিত ফলাফল জানার পর তার প্রভাব আরও সুস্পষ্ট করে বোঝা যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.