একুশে ছিল রাষ্ট্রভাষার সংগ্রাম, মাতৃভাষার নয়: পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই

দেশ বা রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজন একটি বা কখনো একাধিক ভাষা। সে ভাষার প্রয়োজন হয় সরকারি কাজেকর্মে, সরকারী বিজ্ঞপ্তিতে, আইনী কাজে। এই ভাষাকে বলা হয় অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ বা দাপ্তরিক ভাষা বা সরকারী ভাষা বা রাষ্ট্রভাষা। হিন্দীতে বলা হয় রাজভাষা। ভারতে কেন্দ্রীয় সরকারের দাপ্তরিক ভাষা বা রাজভাষা হল হিন্দী ও ইংরাজী। রাজ্যগুলির সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য আদান প্রদান হয় রাজভাষায়। সেজন্য সর্বভারতীয় স্তরে কাজ করতে হিন্দী বা ইংরাজী জানা অবশ্য প্রয়োজনীয়। তার মানে এই নয় যে সরকারী দু’টি ভাষা ছাড়া অন্য আরও কুড়িটির বেশী প্রাদেশিক ভাষা ভারতে অপাংক্তেয়। ভারতের সংবিধানে হিন্দীসহ ২২টি ভাষাকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। রাজ্যগুলি তাদের রাজ্যের সরকারী ভাষা ঠিক করে। সর্বভারতীয় স্তরে সরকারী চাকুরির পরীক্ষায় এই ভাষাগুলির ব্যবহার করা যায়। ভারত সরকারের রাজভাষা থাকলেও ভারতের কোনো ন্যাশনাল ল্যাঙ্গুয়েজ বা জাতীয় ভাষা নেই। মনে রাখা দরকার ভারতের মতন এতগুলি উন্নত ভাষা নিয়ে একটি রাষ্ট্র পৃথিবীতে আর নেই। অনেক দেশে দু’টি তিনটি সরকারী ভাষা ব্যবহৃত হয়, বাকী বিভিন্ন অঞ্চলে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহৃত হয়। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতার অংশীদার হতে হলে রাষ্ট্রের সরকারী ভাষা বা রাষ্ট্রভাষায় দখল প্রয়োজন। মাতৃভাষা রাষ্ট্রভাষা হলে সহজেই সেই ক্ষমতার অঙ্গনে প্রবেশ করা যায়। একুশে ফেব্রুয়ারী প্রসঙ্গে এই আলোচনার অবতারণার কারণ একুশে ফেব্রুয়ারী ছিল রাষ্ট্রভাষার সংগ্রাম, মাতৃভাষার নয়। পাকিস্তানের জন্মলগ্নের সময় থেকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে তা আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। মনে রাখতে হবে, একটি মাত্র পাকিস্তান তৈরী করা পাকিস্তান আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল না। পাকিস্তান গঠনের ভিত্তি লাহোর প্রস্তাবে একাধিক মুসলিমপ্রধান স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের দাবী ছিল। সুতরাং সেই সব মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্র গঠিত হলে সেই সব অঞ্চলের মুসলমানদের প্রধান ভাষা সেই সব রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গৃহীত হওয়াই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গঠিত হল একটি রাষ্ট্র পাকিস্তান। একক পাকিস্তানের জন্ম রাষ্ট্রভাষার বিতর্ক সৃষ্টি করল।

পাকিস্তান আন্দোলনের মূল কাণ্ডারী মুসলিম লীগ এ ব্যাপারে প্রথম থেকেই পরিস্কার ছিল যে উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এতে যে খুব একটা অন্যায় ছিল তাও নয়। খ্রিস্টান আক্রমণ সমগ্র লাতিন আমেরিকার স্থানীয় সব ভাষাকে অবদমিত করে আক্রমণকারী খ্রিস্টানদের ভাষা স্প্যানিশভাষী (কেবল ব্রাজিলে পর্তুগীজ) করেছে। ইসলামী আক্রমণ উত্তর আফ্রিকার পশ্চিমপ্রান্ত মরোক্কো থেকে একেবারে পূর্বে ইরাককে আরবী ভাষার শাসনে এনেছে। পারস্য বা ইরানে এসে ইসলাম পারস্যের ভাষা ফার্সিকে আরবীর অনেকটাই দখলে এনেছে, ফার্সির আদি লিপি আরবীতে পাল্টে দিয়েছে। ভারতবর্ষে এসে ইসলাম কোন ভাষাকে পাল্টাতে না পারলেও জন্ম দিয়েছে এক মিশ্রভাষা উর্দু যা হিন্দী ভাষায় আরবী ফার্সির খিচুড়ি। উর্দুর ব্যাকরণ হিন্দীর কিন্তু বর্ণমালা আরবী। এক কথায় ইসলামী ভারতীয় ভাষা। একসময় পশ্চিম ভারতে হিন্দুরাও ইসলামি শাসনের চাপে উর্দু চর্চা করত। কিন্তু উর্দু অখণ্ড ভারতের সব মুসলমানের ভাষা নাহলেও উর্দু কেবলমাত্র মুসলমানেরই ভাষা। ভাষা দখলে পারস্যের মত ইসলাম সফল হয়েছে পশ্চিম সীমান্তে – ভারতীয় ভাষা পাঞ্জাবী, সিন্ধির বর্ণমালা আরবীতে পাল্টে। পাঞ্জাবী ভাষা আরবী লিপিতে লেখা শুরু হয় চতুর্দশ শতাব্দী থেকেই কিন্তু হিন্দু ও শিখ পাঞ্জাবীরা ভারতীয় লিপি গুরমুখী ব্যবহার করে। ফলে এখন পাকিস্তান পাঞ্জাবে (পশ্চিম পাঞ্জাব) ও ভারতীয় পাঞ্জাবের (পূর্ব পাঞ্জাব) পাঞ্জাবীভাষী মানুষেরা এক ভাষাভাষী হয়েও একে অন্যের লেখা পড়তে পারেন না। কিন্তু যখন ভারতবর্ষ ভেঙে ইসলামী দেশ পাকিস্তানের জন্ম হয়েছে তার রাষ্ট্রভাষারও ইসলামী যোগ থাকাটাই স্বাভাবিক এবং সেখানে একমাত্র দাবীদার উর্দুই। সেখানে কার মাতৃভাষায় কত শতাংশ মানুষ কথা বলেন তা অর্থহীন। আজকের পাকিস্তানে (প্রাক্তন পশ্চিম পাকিস্তান) পাঞ্জাবীভাষী ৫৭ শতাংশ, পোস্তু ১৮ শতাংশ, সিন্ধী ১৫ শতাংশ, উর্দু ৭ শতাংশ। কিন্তু ইসলামী গৌরবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কেবলমাত্র উর্দু। সুতরাং ১৯৪৭-এর পাকিস্তানে বাংলাভাষীর সংখ্যা শতাংশে সর্বোচ্চ হলেও ইসলামী গৌরবে পাকিস্তানী শাসকেরা উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করেছিলেন। ১৯৪৮-এর ২৩শে ফেব্রুয়ারী পাকিস্তানের গণপরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী তুলেছিলেন কেবলমাত্র হিন্দুরাই। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাবে তাঁকে সমর্থন জানিয়েছিলেন তিনজন সদস্য, প্রেমহরি বর্মণ, ভূপেন্দ্রকুমার দত্ত ও শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তীব্র বিরোধিতা করেন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত খান (পূর্ব বাংলা থেকে নির্বাচিত সদস্য), পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নিজামুদ্দিন। পূর্ব বাংলার কোন মুসলমান সদস্য এই দাবীকে সমর্থন করেননি।

কিন্তু বাংলাভাষী মুসলমান সমাজ একটা কথা দ্রুত বুঝেছিল যে মাতৃভাষা বাংলা যতই অ-ইসলামী হোক না কেন পাকিস্তানে সরকারী পদে থাকতে গেলে, সরকারী কাজেকর্মে নিজেদের অধিকার বুঝে নিতে হলে, পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতার অংশীদার হতে হলে বাংলা ভাষাকে সরকারী মর্যাদা পেতে হবে। নইলে পাকিস্তান চালাবে যারা উর্দু জানে। দীর্ঘদিন ধরেই পাঞ্জাবী মুসলমানরা উর্দু ভাষা ব্যবহারেই অভ্যস্ত, সুতরাং উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করবার পক্ষেই তারা ছিল এবং থাকবে। তারাই চালাবে পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তান ও পরবর্তীকালে বাংলাদেশের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও লেখক আবুল মনসুর আহমদের ভাষায়, “উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করিলে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত সমাজ রাতারাতি ‘অশিক্ষিত’ ও সরকারী চাকুরির ‘অযোগ্য’ বনিয়া যাইবেন। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ফারসীর জায়গায় ইংরাজীকে রাষ্ট্রভাষা করিয়া বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ মুসলিম শিক্ষিত সমাজকে রাতারাতি ‘অশিক্ষিত’ ও সরকারী কাজের অযোগ্য করিয়াছিল।” এই ছিল পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলনের মূল কথা। ফলে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করবার আন্দোলন জোরদার হয়েছিল তার কারণ পুরোটাই অর্থনৈতিক। ১৯৪৭-এর ডিসেম্বরে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে প্রখ্যাত ভাষাবিদ মহম্মদ শহীদুল্লাহ লেখেন, “মাতৃভাষার পরই স্থান ধর্মভাষার। এই জন্য আমি আমার প্রাণের সমস্ত জোর দিয়া বলিব, বাঙলার ন্যায় আমরা আরবী চাই। …. সেদিন পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম সার্থক হইবে যে দিন আরবী সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে গৃহীত হইবে।….. কিন্তু বর্তমানে আরবী পাকিস্তান রাষ্ট্রের বৈকল্পিক ভাষা ভিন্ন একমাত্র রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণের যথেষ্ট অন্তরায় আছে।” ফলে মাতৃভাষা বাংলা ভাষার প্রতি বিশেষ কোন প্রীতি নয় পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতার অংশীদার হবার জন্যই পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষার আন্দোলন।

দেশভাগ হওয়ার পর পূর্ব বাংলায় যে সব বাংলা পত্রিকা প্রকাশিত হয় ও বাংলা ভাষার পক্ষে বক্তব্য রাখে তাদের নাম পয়গাম, দৈনিক আজাদ, ইত্তেফাক, ইনসান, ইনসাফ। কোন বাংলা নাম দেখতে পাচ্ছেন? আর সেই সময়েই গঠিত যে সংগঠনটি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রচারে সক্রিয় ছিল তার নাম তমদ্দুন মজলিস। এই হচ্ছে বাংলা ভাষা প্রীতির ইসলামী উদাহরণ। বাংলাভাষী মুসলমান এখনো সন্তানের নাম রাখে আরবীতে। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর দুই পুত্রের বাঙ্গালী নাম রেখেছিলেন, সব্যসাচী ও অনিরুদ্ধ। বাংলাদেশ কাজী নজরুল ইসলামকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে যায় এবং এই চিন্তাশক্তি রহিত মানুষটিকে বাংলাদেশী নাগরিক বানিয়ে দেয়। ফলে পশ্চিমবঙ্গে যাঁর জন্ম ও কর্মভূমি তিনি উইকিপিডিয়ার সৌজন্যে বাংলাদেশী হিসাবে বিশ্বে পরিচিত। কিন্তু নজরুলের পুত্রদের নামকরণের উদাহরণ তারা গ্রহণ করে নি। ভাষাপ্রীতি নয় বাংলাভাষী মুসলমানের ধর্মপ্রীতিই প্রধান, যে কথা ভাষাবিদ মহম্মদ শহীদুল্লাহ অকপটে বলে গেছেন।

– মোহিত রায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.