কোভিড-১৯ এর অর্থনৈতিক তাৎপর্য : পরিস্থিতি মোকাবিলায় ভারতের প্রয়োজন পাঁচ লক্ষ কোটি টাকারও অধিক রাশি

করোনাভাইরাস (Coronavirus) মহামারী পৃথিবীর সব দেশেই আতঙ্কের পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। আস্ত আস্ত শহর এই ভাইরাসের প্রকোপ রোধ করার উদ্দেশ্যে লকডাউনের মধ্যে। সামাজিক দূরত্ব রক্ষা – যা এই মহামারীর গতি রোধে অতি জরুরী – এর অর্থ হল বাড়িতে থাকা, আপিস-দোকান-কারখানা প্রভৃতি জায়গায় বা অন্যত্র কোনোরকম জটলা না করা।

এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই অর্থনৈতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া প্রায় স্তব্ধ এবং তাতে অর্থনীতি ভয়ানক এক বাধার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এবং এই অবস্থা যে আরও বেশ কিছুকাল চলবে তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। কবে অবস্থা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হবে তা কারুর পক্ষেই বলা সম্ভব নয়।

চলতি আর্থিক বছরে পৃথিবীব্যাপী অর্থনৈতিক বৃদ্ধি শূন্য অথবা তারও কম হতে পারে। প্রায় সাতাশ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের ‘স্টক’ শেয়ার বাজারে এর মধ্যেই সম্পূর্ণ মুছে গেছে।

বহু দেশই এই পরিস্থিতিতে চেষ্টা করছে ইকনমিক স্টিম্যুলাস প্যাকেজ তৈরি করার যাতে করে এই মহামারী সম্পূর্ণ দূর হওয়া পর্যন্ত এবং সব পুনরায় স্বাভাবিক হওয়া পর্যন্ত দেশের নাগরিকদের হাতে বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট টাকা থাকে। বিশ্বের এক বিশাল সংখ্যক মানুষ, যাঁরা স্বনিযুক্ত, অথবা ছোট পুঁজির ব্যবসায়ী, রোজকার ব্যবসা বাণিজ্যে টাকাকড়ির লেনদেনের উপরেই যাঁদের উপার্জন দাঁড়িয়ে, তাঁরা পুরোপুরি উপার্জনহীন হয়ে পড়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এর মধ্যেই বেকারত্বের দাবি প্রচুর বেড়ে গেছে।

জীবিকার উপর সবচাইতে বড়ো প্রভাব এই যে, অর্থনৈতিক কাজকর্ম এভাবে থমকে যাওয়ার ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ কাজ হারাবেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (United States) এমনই এক দুই ট্রিলিয়ন ডলারের প্যাকেজের ব্যবস্থা করছে। নাগরিকদের অ্যাকাউন্টে সোজাসুজি টাকা পাঠানো, কর পিছিয়ে দেওয়া; বিমান পরিবহন, বিমানবন্দর, রেস্টুরেন্ট, হসপিটালিটি চেইনস প্রভৃতি শিল্প, যেগুলিতে প্রভাব সরাসরি পড়ার আশঙ্কা, সেগুলিকে বেইল আউট করা ইত্যাদি সবই এই প্যাকেজের মাধ্যমে করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

একইভাবে, কানাডা ঘোষণা করেছে বিরাশি বিলিয়ন মার্কিন ডলারের এক প্যাকেজ যার মধ্যে আর্তদেরকে সাপ্তাহিক অর্থসাহায্যও ধরা আছে

সংযুক্ত যুক্তরাজ্যও ঘোষণা করেছে ৩৫ কোটি পাউন্ডের প্যাকেজ যাতে প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত শিল্প এবং ব্যবসাগুলির জন্য কর ছাড়, এবং করোনা প্রভাবিত পরিবারগুলির জন্য মাসে ২৫০০ পাউন্ডের অর্থসাহায্যও ধরা আছে

ইপিএফও (EPFO) /ইএসআই (ESI) -এর মাসিক জীবিকা সংক্রান্ত রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রায় ৩০ কোটি ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মধ্যে প্রায় ১১ কোটি মানুষকে মাইনে দেয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা সরকার। এই ১১ কোটির প্রায় পাঁচ কোটি চুক্তির শ্রমিক যাদের চাকরি যখন তখন চুক্তি বাতিলের মাধ্যমেই কেড়ে নেওয়া সম্ভব এবং এটাই এখন হচ্ছে। ভারসাম্য তাও রক্ষিত হচ্ছে অপ্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রগুলিতে, ছোট ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলিতে (এমএসএমই), এবং ব্যক্তিগত ভাবে উপার্জনে জীবন নির্বাহ করা মানুষদের ক্ষেত্রে এবং এঁদের দৈনিক উপার্জন ভয়ানক রকম কমে যাওয়ার সম্ভাবনা।

ভারতকেও খুব শীঘ্রই এই পথে হাঁটতেই হবে। দেশের কাজ করে খাওয়া ৫২.৫ কোটি মানুষের মোটামুটিভাবে ২২.৬ কোটি কৃষিকাজে যুক্ত আর অবশিষ্টাংশ শিল্পসংস্থাগুলি এবং চাকরিবাকরিতে। ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে যে, দেশের কাজ করে খাওয়া মানুষের অন্ততঃ ১০ কোটি এই লকডাউনের ফলে প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত হতে পারেন। যাঁরা অর্থের দৈনিক স্রোতের উপর নির্ভরশীল তাঁরা হঠাৎ করেই জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ অর্থের থেকে বঞ্চিত হবেন। ভারত এই মুহূর্তে এক অভূতপূর্ব সমস্যার মুখোমুখি এবং কোনোরকম আশার আলোও চোখে পড়ছে না।

দেশের এই বিশাল কর্মী-শক্তির জীবনধারণকে আগামী তিন মাস স্থিতিশীলতা দিতে এই অতি লাভজনক অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞকে মসৃণ ভাবে পরিচালিত করতে হবে। এখন তাই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ক্ষতির দিকে লক্ষ্য রাখা এবং এমন এক আপৎকালীন ধনরাশির ব্যবস্থা করা যা একাধারে বিপদে পড়া দেশবাসীদেরকে রক্ষা এবং প্রত্যক্ষভাবে ভাইরাসের কবলে পড়া শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলিকে রক্ষা করতে পারবে। এই ধনরাশি প্রস্তুত করার সময় নিম্নলিখিত বিষয়সমূহ সংক্রান্ত তথ্যাদি মাথায় রাখতে হবে।

কৃষি: ভারতের কর্মজীবী মানুষের মোটামুটিভাবে ৪৩% কৃষির উপর নির্ভরশীল এবং জাতীয় জিডিপিতে এর অবদান ১৭.৬%। এই মুহূর্তে রবি ফসলের চক্র রেকর্ড রকমের তুঙ্গে চলছে এবং আশা করা যায় দু এক সপ্তাহেই তা বাজারে ঢুকবে।

অসংগঠিত ভাবে কাজকর্মের অভ্যাস, প্রায় শূন্য আন্তর্জাতিক ভ্রমণ, এবং সম্ভবতঃ করোনা ভাইরাস সম্পর্কে অজ্ঞতা দেশের কৃষিনির্ভর গ্রামাঞ্চলকে প্রাথমিকভাবে এই মহামারীর বাইরে রেখেছে। এর মধ্যেই উত্তরপ্রদেশ ও কর্ণাটক সরকার ঘোষণা করেছে যে, প্রধানমন্ত্রী কিষাণ সম্মাননিধি প্রকল্পের আওতায় কেন্দ্রের দ্বারা কৃষকদের দেয় ৬০০০ টাকার পর তারা আরও রাশি যোগ করবে

যদি প্রতিটি প্রদেশের সরকার সমবেত উদ্যোগে এই ৬০০০-কে অন্ততঃ বার্ষিক ১০০০০-এ বাড়িয়ে দিতে পারে তবে, তা দেশের ৯ কোটি কৃষিজীবী পরিবারের উন্নতিতে দীর্ঘমেয়াদী উপকার করতে পারে।

ভারতের (India) কর্মী-শক্তির মোটামুটি ২৫ শতাংশ শিল্পের উপর নির্ভরশীল এবং এঁদের জাতীয় জিডিপিতে অবদান প্রায় ২৭.৪ শতাংশ। আর্থিক বছর ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১এ এই ক্ষেত্রের বৃদ্ধি নেমে দাঁড়াতে পারে শূন্যয়। যদিও শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছে, খুব বেশি চাকরি এখনও যায়নি। আসন্ন তিন মাসের লকডাউনে বিরাট পরিমাণে চাকরি যাওয়ার আশঙ্কা এই ক্ষেত্রে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী শ্রমিক ছাঁটাই না করতে আবেদন রেখেছেন এবং তাঁর এই আবেদনকে পূরণ করতে হলে অর্থের জোগান চাই।

শিল্পের উপর নির্ভরশীল ১৩.১ কোটি মানুষের অর্ধেকই সম্ভবতঃ রয়েছে অপ্রাতিষ্ঠানিক অথবা ছোট ও মাঝারি শিল্পগুলিতে (এমএসএমই)। এই শিল্প পরিকাঠামোয় সরকারের, লগ্নির ক্ষেত্রে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের, এবং আবাসন নির্মাণ ও রিয়েল এস্টেট সংক্রান্ত ব্যাপারগুলিতে রিয়েল এস্টেট-ব্যবসায়ীদের অর্থের উপর বিপুলাংশে নির্ভরশীল। বর্ণিত এই সব ধরনের কাজকর্ম এখন প্রায় স্তব্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রত্যক্ষ জীবিকা সৃষ্টির ৫০-৬০% প্রভাবিত হচ্ছে।

নির্মাণশিল্পও রয়েছে আসন্ন বিপদের সামনে। কৃষির পর এই ক্ষেত্রই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষকে কাজ দেয়। সংগঠিত ক্ষেত্রে চুক্তিবদ্ধ শ্রমদান ও ছোট জোগানদারির সঙ্গে জড়িত ২৫-৪০ শতাংশ মানুষের কাজ হারাবার আশঙ্কা। শিল্পকে এই অচলাবস্থা থেকে বের করে আনতে শ্রমিকদেরকে ডাইরেক্ট বেনিফিট ট্রান্সফারের মাধ্যমে অর্থের জোগান দিতে হবে, পিএফ (PF) এবং ইএসআই (ESI) কর্তৃপক্ষের কাছে উপলব্ধ তথ্যাদিকে কাজে লাগিয়ে। এমএসএমই প্রভৃতির কাছ থেকে যাতে প্রয়োজনীয় অর্থ পাওয়া যায় তাও সুনিশ্চিত করতে হবে।

সমস্যাটা এখনও “সলভেন্সি” (Solvency) র না হলেও, “লিকুইডিটি” (Liquidity) র তো বটেই। কারণ এ এক এমন সময় যখন ব্যবসায়িক লাভ শূন্যয় পড়ে যেতে পারে। প্রতিটি ব্যাঙ্কেরই এরকম স্কীম নিয়ে এগিয়ে আসা উচিত যাতে এমএসএমই (MSME) সহ অন্যান্য “লিকুইডিটি চ্যালেঞ্জ” (liquidity challenge)-এর মুখোমুখি সংস্থাগুলির জন্য কার্যকরী পুঁজির ব্যবস্থা করা যায়।

এখানে স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার (State Bank of India), যার শীর্ষে রয়েছেন দূরদর্শী চেয়ারম্যান রজনীশ কুমার, ঘোষণাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁরা ঘোষণা করেছেন যে, যেসব গ্রাহকের এসবিআই-এ সমৃদ্ধ একাউন্ট রয়েছে তাঁদেরকে ২০০ কোটি টাকা পর্যন্ত লোন দিতে তাঁরা রাজী, যা ছয় মাসে ৭.২৫ শতাংশ সুদ সমেত ফেরতযোগ্য।

রিজার্ভ ব্যাঙ্কের (Reserve Bank) ভূমিকা এখনও পর্যন্ত খুব আশাব্যঞ্জক নয়। মুখে তারা সহানুভূতিসূচক অনেক কথা বললেও কার্যক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেওয়ার সদিচ্ছা দেখাচ্ছে না। তাদের উচিত অবিলম্বে বিভিন্ন ব্যাঙ্কের সঙ্গে একযোগে কাজ করে লোন শোধের সময়সীমা পিছিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা। আগামী ছয় মাসের জন্য নন পার্ফর্মিং এসেট ঘোষণা না করে কনজ্যুমার লোনের ইএমআই শোধও পিছিয়ে দেওয়া উচিত। সমস্ত এমএসএমইকে লোন শোধের জন্য বাড়তি সময় দিলে তা এই কঠিন সময়ে এই সব ব্যবসাকে টিকে থাকতে প্রচুর শক্তি যোগাবে।

চাকরি: এই ক্ষেত্রটিতে দেশের সামগ্রিক কর্মী-শক্তির ৩২ শতাংশ কাজ করে। জাতীয় জিডিপিতে এর অবদান ৫৫%। এই ক্ষেত্রটিতেই করোনা মহামারীর প্রভাব ভয়াবহতম।

বিনোদন ও ইভেন্ট জাতীয় শিল্প এর মধ্যেই মুখ থুবড়ে পড়েছে। বলিউড গভীর সমস্যায়। সেখানে প্রায় ৫ কোটি মানুষের জীবিকা বিপদের মুখে পড়তে পারে।

সৌভাগ্যবশতঃ এর এক বড়ো অংশ সরকারি এবং সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানসমূহতে কাজ করার দরুন সরকারের খাজনা বাবদ লাভের অঙ্ক থেকেই মাইনে পেতেই থাকবে।

কিন্তু অন্যান্য প্রকৃতির চাকরি যাঁরা করেন তাঁদের অবস্থা আশাব্যঞ্জক নয়। বড়ো ও খুচরো বাণিজ্য ২৫-৩০% ক্ষতির সম্মুখীন। পর্যটন শিল্প ৭০-৮০% এবং, ভ্রমণ, রেস্টুরেন্ট ও আতিথেয়তা জাতীয় শিল্প প্রায় ৮০-৯০% ক্ষতির মুখোমুখি।

প্রোফেশনাল সেক্টর যেটাকে বলা হয়, সেখানে প্রোফেশনালরা আরও মাস তিনেক চালিয়ে নিতে পারবেন যদি তাঁদের ইএমআই কিছুকালের জন্য পিছিয়ে দেওয়া যায়। আইটি, ব্যাঙ্কিং, এবং অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রগুলি বড়ো বড়ো কাম্পানির হাতে থাকায় এদের হাতে টাকা এখনও আছে। কিন্তু, তা সত্ত্বেও টিকে থাকার জন্য কিছু সাহায্যের প্রয়োজন এদেরও হতে পারে।

ঋণের কিস্তি সব পিছিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি, কার্যকরী পুঁজিও ছাড় দিতে হবে এই শর্ত সহ যে, যদি তারা শেষ পর্যন্ত ঋণ মেটাতে না পারে তবে কেউই তাদের পাশে দাঁড়াবে না

বিমান পরিবহন শিল্পকে আগামী তিন থেকে ছয় মাসের জন্য সব কর থেকে ছাড় দিতেই হবে এবং, এভিয়েশন টার্বাইন ফ্যুয়েল সাপ্তাহিক ভাবে যাতে মোটামুটি চার সপ্তাহ তারা স্বল্পমূল্যে পেতে পারে, বিশ্ব-বাজারে হ্রাস পাওয়া মূল্যে তা পাওয়া পর্যন্ত, তা সুনিশ্চিত করতে হবে।

প্রায় ১৫ কোটি পরিবার – যাদের মধ্যে রয়েছে কৃষক, অপ্রশিক্ষিত শ্রমিক, নির্মাণ শিল্পের মজুর, অসংগঠিত ক্ষেত্র, এমএসএমই প্রভৃতি; তাদের জন্য ডিবিটির ব্যবস্থা করা। এতে খরচ পড়তে পারে ছয়মাসের জন্য পরিবার পিছু দুহাজার টাকা হিসেবে সর্বমোট ১.৮ লক্ষ কোটি

সরকারের উচিত হোটেল, বিনোদন, ভ্রমণ এবং এরকম আরও বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা বিভিন্ন শিল্পে যেসব সংগঠন রয়েছে তাদের সঙ্গে কথা বলে একই ধরণের প্যাকেজের ব্যবস্থা সেখানেও করা। বহু ছোট ছোট দোকান এবং ছোট ব্যবসা রয়েছে যাদের একইরকম সাহায্যের প্রয়োজন। আতিথেয়তা শিল্প, বিমান পরিবহন ইত্যাদি ক্ষেত্রে কর পিছিয়ে দিলে তা আগামী কয়েক মাসে মোটামুটি ৫০,০০০ কোটি অর্থ সাহায্যের ব্যবস্থা করতে পারে। সামগ্রিক ভাবে উপরিউক্ত অর্থনৈতিক পরিকল্পনাকে সামনে রেখে ভারতের এখন প্রয়োজন প্রায় ৫.৪ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজ যা তদারক ও খরচের দায়িত্ব নেবে সরকার

প্রত্যক্ষ ভাবে প্রভাবিত শিল্প, যেমন বিমান পরিবহনকে সম্পূর্ণ ছাড় দিলে আগামী ছয় মাসে তা ১০,০০০ কোটি টাকার সাহায্য করতে পারে। কৃষক, প্রশিক্ষণহীন শ্রমিক, নির্মাণকর্মী, অসংগঠিত কর্মক্ষেত্র ও লঘু ও মাঝারি উদ্যোগের সবাইকে মিলিয়ে প্রায় ১৫ কোটি পরিবারের জন্য সরাসরি ব্যাঙ্কের খাতায় পয়সা পাঠানো এবং ছয় মাসের জন্য পরিবার প্রতি মাসে দুই হাজার টাকায়, এটির সামগ্রিক পরিমাণ ১.৮ লক্ষ কোটি টাকা। পর্যটন সম্বন্ধীয় ক্ষেত্র ও বিমান চলাচল ইত্যাদির মতো অনেক বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে কর স্থগিত বা মকুব করে পরবর্তী ছয় মাসে প্রায় ৫০,০০০ কোটি টাকার রেহাই সরকার দিতে পারে। তাছাড়া ছয় মাসের জন্য বিমান পরিষেবার মতো প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত শিল্পের ক্ষেত্রে যদি আর্থিক সাহায্য দিতে হয় তা প্রায় মোট দশ হাজার কোটি টাকা হতে পারে।

ব্যাঙ্কগুলিকে আগামী ছয় মাসের জন্য ঋণের সবধরণের কিস্তি পিছিয়ে দিতে রাজী করতে হবে শুধু সেসব গ্রাহকের জন্য যাদের প্রয়োজনীয় লিক্যুইডিটি নেই। এ ব্যাপারে রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে নির্দেশ জারি করে বলতে হবে যে, এই ছয়মাসের জন্য পিছিয়ে যাওয়াকে এনপিএ হিসেবে দেখা হবে না এবং ব্যাঙ্ককে এই অর্থ দিতে হবে না। ওপেন মার্কেট অপারেশন্সের মাধ্যমে আরবিআই বাজারে লিক্যুইডিটি সুনিশ্চিত করেছে। বাজারে টাকা আছে কিন্তু ব্যাঙ্ক তা ধার দিচ্ছে না। তাই আরবিআই, বিভিন্ন ব্যাঙ্ক, এবং সরকারকে একসঙ্গে ঘোষণা করতে হবে যে, যাদের প্রয়োজন তাদের জন্য সমস্ত ব্যাঙ্ক কার্যকরী পুঁজিতে ২০% ও ব্যক্তিগত লোন ২০% একটা সীমা পর্যন্ত বাড়িয়ে দেবে এই শর্তে যে, তাঁরা ছয় মাস পর থেকে পরিশোধ শুরু করবেন। এতে কিছুকালের জন্য কিছু ক্ষতি হতেই পারে এবং তা সরকারকে পূরণ করতে হবে “প্রথম ক্ষতি” হিসেবে ১০% অর্থ তাদের দিয়ে। এইসব পদক্ষেপ সবমিলিয়ে মোটের প্রায় ৫০,০০০ কোটির ব্যবস্থা করতে পারে।

লোকেদের এবং বাণিজ্যিক সংস্থাগুলির ইতিমধ্যে আইটি এবং পণ্য ও পরিষেবা কর (জিএসটি) রিফান্ডগুলি তাত্ক্ষণিকভাবে করা উচিত যাতে লোকেরা তাদের নিজস্ব আর্থিক যোগান বাড়িয়ে নিতে পারে। একইভাবে, গ্যারান্টিযুক্ত ১৪ শতাংশ জিএসটি রিটার্ন অনুসারে রাজ্যগুলির বকেয়া ৩০,০০০ কোটি টাকার ঘাটতি রাজ্যগুলিকে মিটিয়ে দেওয়া যাতে নাগরিকদের জন্য সরবরাহ করার জন্য নগদ প্রদানের প্রক্রিয়া শুরু করা যেতে পারে। এগুলো জনগণ এবং বাণিজ্যিক সংস্থাগুলির কাছে বকেয়া ছিল কারণ কেন্দ্র সরকার অর্থবছরের শুরুর দিকে যথেষ্ট পরিমাণ আর্থিক যোগান না থাকার কারণে বাকি রেখেছিল এবং নতুন সঙ্কটের কথা মাথায় রেখে দ্রুত সেই পয়সা ফেরতের প্রক্রিয়া চালু করা উচিত। এটি পুরোপুরি এক লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি হতে পারে।

চিকিত্সা পরীক্ষা: প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষের ভাইরাসের পরীক্ষার জন্য ২,০০০-৫,০০০ টাকা ব্যয় করার উপায় নেই। তবে, লক্ষণগুলি প্রদর্শন করে এমন যে কোনও ব্যক্তির পরীক্ষা করা জরুরি এবং সরকারকে তার ব্যয় বহন করতে হবে। এমনকি যদি আমরা পরের তিন মাসে ১ কোটি লোককে পরীক্ষা করি – যা প্রায় অসম্ভব কাজ – এটির জন্য প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার ব্যয় প্রয়োজন।

হাসপাতালে ভর্তি: দুই মাস ধরে যদি ২ লক্ষ লোক হাসপাতালে ভর্তি হন, তাদের জন্য ৫০০ কোটি টাকার চিকিত্সা ব্যবস্থার অধীনে রাখতে প্রতি মথাপিছু ২৫,০০০ টাকা লাগতে পারে। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক বড় জনগোষ্ঠীকে গ্রহণ করে, সমস্ত স্বাস্থ্য ব্যয় দায়িত্ব নেওয়ার জন্য ২০০০০ কোটি টাকা আলাদা রাখতে হবে

দীর্ঘমেয়াদি সঙ্কট ব্যবস্থাপনা: সঙ্কটের এই সময়ে, সরকারকে সমস্ত রাজ্য এবং জেলাগুলিতে চিকিত্সা স্বাস্থ্য উপলব্ধ রয়েছে তা নিশ্চিত করার জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গিও গ্রহণ করতে হবে। প্রায় সারা দেশে ভারতে প্রায় ৭১৮ টি জেলা রয়েছে যার মধ্যে উন্নত মানের প্রায় ২১৮ টি (শহরাঞ্চলে বা দক্ষিণের আরও উন্নত অঞ্চলে) উপরের সমপরিমাণ চিকিৎসা সেবা রয়েছেবাকী ৫০০ জেলায় ভারসাম্য রাখার জন্য, এই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে যে সরকার ভবিষ্যতের স্বাস্থ্য সংকট থেকে ভারতীয় জনগণকে উত্তোলন করতে এই কর্মসূচির অংশ হিসাবে প্রতিটি জেলায় ৫০০ জনের শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল তৈরি করবে। ২.৫ লক্ষ শয্যাগুলির জন্য প্রতি বিছানায় প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা হারে, পরবর্তী তিন বছরে এটির জন্য ব্যয় হতে পারে ১.২৫ লাখ কোটি টাকা। এই পদক্ষেপটি অপরিহার্য কারণ প্রত্যেককে সুদূর ভ্রমণের পরিবর্তে অবশ্যই তাদের নিজস্ব জেলায় চিকিত্সা করতে হবে এবং স্বাস্থ্যসেবা দিতে সক্ষম হতে হবে। এটি পরবর্তী প্রজন্মের প্রয়োজনীয়তার জন্য স্বাস্থ্য অবকাঠামো নির্মাণে ভারতকে সক্ষম করতে পারবে।

এই বিপুল ৫.৪ লক্ষ কোটি টাকার মধ্যে রাজ্যগুলি ২০ শতাংশ বোঝা ভাগ করতে পারে এবং বিভিন্ন উপায়ে বাকি ৮০ শতাংশ কেন্দ্রের জোগাড় করা উচিত।

ভারতের ৫.৪ লক্ষ কোটি টাকার অর্থনৈতিক সাহায্যর পরিমাণ আপাত দৃষ্টিতে এরকম দেখাচ্ছে:

১৫ কোটি পরিবারের জন্য ডিবিটি প্রতি মাসে ২০০০ টাকা করে ১২,০০০ = ১.৮ লক্ষ কোটি টাকা

কর স্থগিত = ৫০০০০ কোটি টাকা

বেলআউট = ১০০০০ কোটি টাকা

ব্যাঙ্ক ঋণ আদায়ে দেরীর জন্য প্রথম ক্ষতির জন্য ব্যাকস্টপ = ৫০০০০ কোটি টাকা

আইটি / জিএসটি / রাজ্য জিএসটি ফেরত = ১ লাখ কোটি টাকা

স্বাস্থ্য ও পরীক্ষার জন্য স্বাস্থ্য ব্যয় = ২৫০০০ কোটি টাকা

স্বাস্থ্য ক্ষমতার জন্য দীর্ঘমেয়াদী ব্যয় = ১.২৫ লক্ষ কোটি টাকা

১৩৭ কোটি শক্তিশালী জনসংখ্যার আস্থা ফিরিয়ে আনতে একটি বিস্তৃত আর্থিক সাহায্যর প্রকল্প নিয়ে আসতে ভারত সরকারের অবশ্যই আর দ্বিধা করা উচিত না। এটি একটি পরিষ্কার সঙ্কেত প্রেরণ করবে যে সরকার তার নাগরিকদের জীবন-জীবিকা ও সুরক্ষার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ

আর্থিক সংস্থানগুলি বাড়ানোর জন্য, প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে যে সরকার এই উদ্দেশ্যে বাজার থেকে প্রায় ৬.৫ শতাংশ সুদ দিয়ে ২০/৩০ বছরের সময় অবধি বন্ড দিয়ে আর্থিক উপস্থাপনা করবে

সরকারের বর্তমান বাজেটের ব্যয়ের একটি অংশও পুনর্নির্ধারণ করা যেতে পারে।

সরকারের এই অর্থ ঋণ আর্থিক ঘাটতির বাইরে হওয়া উচিত এবং ভাইরাস সংকট মেটাতে একটি বিশেষ অনুশীলনের জন্য একটি আপাতকালীন বন্দোবস্ত হিসাবে আলাদাভাবে দেখানো উচিত। এই বন্ড গুলিকে করোনা ভাইরাসের সাপেক্ষে হিসাবে করুণা বন্ড বলা যেতে পারে।

সরকার বিশ্বব্যাঙ্ক এবং /অথবা এশীয় উন্নয়য় ব্যাঙ্কের কাছেও যেতে পারে যাতে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৭৫০০০ কোটি টাকা বিশেষ ঋণ পেতে বা টোকিওর মতো বিদেশী আর্থিক বাজারে উল্লেখযোগ্য উদ্বৃত্ত তহবিলের সাহায্যে জোগাড় করতে পারে।

সংকট হওয়ার জন্য ভারতের আর্থিক মূলধনের অভাব নেই তবে কার্যকর করার জন্য বিস্তৃত দৃষ্টি এবং দৃঢ় সংকল্পের প্রয়োজন। এই বিশেষ সংস্থান সামগ্রিক জিডিপির মাত্র ২.৫ শতাংশ

এটি বড় মনে হতে পারে তবে অন্যান্য দেশগুলিও কী প্রস্তুতি নিচ্ছে তার তূলনায় ভারতের ঐ পরিমাণ ব্যয় সীমারেখা মধ্যেই রয়েছে। তুলনামূলকভাবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে (US) এই লক্ষ্যে ২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করতে দেখছে যা জিডিপির ১০ শতাংশ ছাড়িয়েছে এবং এমনকি এর পরিমাণ ৪ ট্রিলিয়ান মার্কিন ডলার পর্যন্তও যেতে পারে

ব্রিটেন এই অর্থবছরে ৩৫ কোটি পাউন্ডের সাহায্যের পরিকল্পনা করছে। তবে এর জিডিপি ২.২২ ট্রিলিয়ন, সাহায্য জিডিপির ১৫ শতাংশ। ভারতকে এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে দ্বিধা করা উচিত নয়।

ভারতীয় নাগরিকগণ অস্তিত্বের সংকটে পড়েছেন; তাদের স্বাস্থ্য এবং জীবিকা উভয়ই খাদের কিনারায়। কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারকে প্রয়োজনীয় মূলধন সংগ্রহের জন্য এই অসাধারণ পরিস্থিতিতে একসাথে কাজ করতে হবে এবং ভারতের ৬০% জনসংখ্যার যারা সরারসরি রোগের প্রকোপে সহায়তা করার জন্য একটি কার্যকর বিতরণ ব্যবস্থা একসাথে রাখতে হবে। কেরলে দৃশ্যমান সংস্থান না থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনীয়তা মেটাতে ২০০০০ কোটি টাকার প্যাকেজ তৈরি করেছে।

ইউপি সরকার দৈনিক মজুরি উপার্জনকারী এবং নির্মাণ শ্রমের যত্ন নিতে বৃহত আকারের প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। সমস্ত রাজ্যকে এটির উপরে কাজ করতে হবে এবং প্যাকেজগুলি ঘোষণা করতে হবে যেখানে ২০ শতাংশ রাজ্য অর্থায়নের ব্যবস্থা করতে পারে এবং বাকী ৮০ শতাংশ কেন্দ্র কর্তৃক অর্থায়ন করতে পারে। আমরা বিপজ্জনক সময়ে বেঁচে আছি, এবং সমগ্র ভারতবর্ষের নাগরিকরা এই সঙ্কটে তাদেরকে জোরদার করতে সরকারী সহায়তার অবিচল উদ্যোগের দিকে চেয়ে রয়েছে।

টিবি মোহনদাস পাই (T.V. Mohandas Pai) এবং নিশা হোলা (Nisha hola)

https://swarajyamag.com/economy/economic-impact-of-covid-19-india-needs-an-economic-stimulus-package-of-more-than-rs-5-lakh-crore

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.