ধর্মই বলুন আর দর্শনই বলুন, মহা বিশ্বের যাবতীয় চিন্তাভাবনা অর্জনের লক্ষ্যেই ধাবিত হয়েছে। সে ব্যক্তিগত স্তরে জ্ঞান অর্জন, বোধি অর্জন, মোক্ষ লাভ, অথবা আধ্যাত্মিকতা অর্জন হতে পারে, অথবা সমগ্র জাতির অস্তিত্ব রক্ষা তথা আধিপত্য অর্জনের প্রেরণাও হতে পারে। আধ্যাত্মিকতাটি যেমন বৈদিক অর্জন, আধিপত্য তেমনই রাজনৈতিক ইসলামের মাইলস্টোন, যা এক অর্থে অর্জনই বলা যায়। অর্জন কাকে বলব? অর্জন বলতে ঠিক কি বুঝি? এক কথায় খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান, ভোগ বিলাস ইত্যাদিকে গৌণ লক্ষ্য হিসেবে চিহ্নিত করে মানুষ তথা মনুষ্যত্বকে কুকুর বিড়ালের মত ইতর প্রাণির উর্ধ্বে স্থাপন করা। কারণ ভাত রুটির লক্ষ্যটি আর যাই হোক কোনো মহৎ অর্জন হতে পারেনা। বেদ উপনিষদই বলুন, মহাজ্ঞানী জরাথুস্ট্রই বলুন, যুগ পুরুষ বিবেকানন্দই বলুন এমনকি আধুনিক ইংরাজি কবিতা তথা সাহিত্যের পথিকৃৎ নোবেলজয়ী টি এস এলিয়টই বলুন প্রত্যেকেই এই মহান অর্জনের কথাই বলে গেছেন। আধুনিকতার সঙ্গে এর কোনো বিবাদ নেই। কবিতার জগতে অত্যাধুনিক ভাষ্য এবং পরীক্ষা নিরীক্ষার আলোকসামান্য প্রতিভা টি এস এলিয়টই তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান এই কবি তাঁর কবিতায় কেবল বাইবেলের অনুষঙ্গ ব্যবহার করেই ক্ষান্ত হননি। সোচ্চারে বলেছেন বিশ্বের যাবতীয় শিল্প সাহিত্যের বিষয় এবং মূলই হল ধর্ম।
“I am convinced that we fail to realize how completely, and yet how irrationally, we separate our literary from our religious judgements. If there could be a complete separation, perhaps it might not matter: but the separation is not, and never can be, complete”
“কতটা পূর্ণাঙ্গ কিন্তু অযৌক্তিকভাবে আমরা সাহিত্যকে ধর্মীয় বিচার থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চাই, অথচ আমি নিশ্চিত আমরা এটি উপলব্ধি করতে পারিনা। যদি সত্যিই এটি সম্ভব হত, তবে হয়ত কোনো সমস্যা ছিলনা। কিন্তু এই বিচ্ছিন্ন করার প্রয়াস এখনও সফল হয়নি, এবং ভবিষ্যতেও কখনও সফল হবেনা।”
তাঁর সমস্ত সাহিত্য কীর্তিই এই অর্জনটিকেই আলোকিত করে। ভোগবাদী, আদর্শহীন এবং অন্তঃসারশূন্য মানুষকে তিনি বারবার এই বিপদ সম্পর্কে অবহিত করেছেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর Hollow Men এবং Waste Land শীর্ষক মাস্টারপিসের সারমর্ম লক্ষণীয়। প্রখ্যাত Waste Land কবিতাটি তো বৃহারণ্যক উপনিষদের সেই মহান উচ্চারণ “ওম শান্তি, ওম শান্তি ওম শান্তি” সমাপ্ত হয়েছে। সুদূর পাশ্চাত্যের এই সাহিত্যিকটির বেদ উপনিষদ থেকে শুরু করে হিন্দু সংস্কৃতি তথা দর্শনের বিভিন্ন শাখায় সমীহ জাগানোর মত পাণ্ডিত্য ছিল। আপনি আধুনিক কবিতার কাণ্ডারি? “দুর্বোধ্য” কবিতা লেখেন বলে পাঠক গ্রহণ করতে পারেননা বলে কিঞ্চিৎ গর্ব অনুভব করেন? এলিয়ট পড়ে দেখুন ! জানিনা কতটা হজম করতে পারবেন। তবে নিশ্চিত হবেন এমন আধুনিক আঙ্গিক ব্যবহার করেও নিজের শেকড় বা আইডেন্টিটিতে অনড় থাকা যায়। তথাকথিত আধুনিকতার স্বার্থে শেকড়ের দর্শনটিকে বলি দেওয়ার কোনো মানেই হয়না।
যারা পেটের ভাতকে সবার উপরে রেখে সমাজ পরিবর্তনের শ্লোগান দেন, তাঁরাই মানুষকে গোরু, কুকুরে পরিণত করার প্রয়াস করেন। খাদ্যের উর্ধ্বে চিন্তা করতে সক্ষম হয়েছিল বলেই মানুষ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম প্রাণি। খাদ্য বস্ত্র বাসস্থানের উপর ভর করে অদ্যাবধি কোনো সভ্যতা বা দেশ স্থায়ী সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারেনি। তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়েছে। এই মুহূর্তে যে কতিপয় দেশ টিকে আছে তারা হয় কম্যনিজমের পথ থেকে সরে এসেছে ( মাও সে তুঙ-এর জীবদ্দশাতেই কমিউন গুলি ভেঙে দেওয়া হয়। চীনে এখন ব্যক্তিগত সম্পত্তি রাখার প্রথা রমরমিয়ে চলছে, কিউবার নতুন সংবিধানে ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে আইনসঙ্গত অধিকার দেওয়া হয়েছে৷ ) নয় তো সহায়তা, দানের উপর কোনমতে টিকে আছে। যেমন উত্তর কোরিয়া। নিছকই খাদ্যের সন্ধানে বেরোলে আপনি বড় জোর একটি হৃষ্টপুষ্ট সারমেয় হয়ে উঠতে পারেন, আইডেন্টিটির অন্বেষণই আপনাকে মানুষ করে। পর্বত কখনও মেঘ ছোঁয়ার চেষ্টা করেনা। সে জানে আকাশ ছুঁতে পারলে মেঘ এমনিতেই আসবে।
মুখ্য থাকলে যেমন গৌণ থাকে, প্রধান থাকলে যেমন অপ্রধান থাকে, তেমনই অর্জনের বিপরীতে থাকে উপ অর্জন। যাকে আমরা এক কথায় উপার্জন বলি। আধুনিক ভোগবাদী সভ্যতা এই উপ অর্জন বা উপার্জনের উপর ভিত্তি করেই দাঁড়িয়ে আছে। ভোগ্য বস্তু লাভের জন্য যে পথ তাকে কখনও অর্জনের সম্মান দেওয়া হয়নি। সে প্রাচ্যই বলুন আর পাশ্চাত্যই বলুন। “অর্জন” শব্দটির ইংরেজি অর্থ achieve/ attain কিন্তু উপ অর্জন / উপার্জন শব্দটির ক্ষেত্রে earn শব্দটি ব্যবহার করা হয়। অর্জন এবং উপার্জনের ফারাকটা আসলে লক্ষ্য এবং উপলক্ষ্যের মত। নিছক উপ অর্জনের উপর ভিত্তি করে বেঁচে থাকা সভ্যতার বিনাশ অনিবার্য। কারণ আপনি যখন উপ রাষ্ট্রপতি, উপ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছেন, তখন অন্য একটি সমাজ বা সম্প্রদায় রাষ্ট্রপতি কিম্বা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বৃহত্তর এবং মহত্তর লক্ষ্যটিকেই বেছে নিয়েছে। আপনার লক্ষ্য উপার্জন, তার লক্ষ্য অর্জন।