দীপাগ্নিশিখা

অনেক হাজার বছরের

মরু-যবনিকার আচ্ছাদন

যখন উৎক্ষিপ্ত হল,

দেখা দিল তারিখ-হারানো লোকালয়ের

বিরাট কঙ্কাল;–

ইতিহাসের অলক্ষ্য অন্তরালে

ছিল তার জীবনক্ষেত্র।

মহারাষ্ট্র হতে বরোদা হয়ে বিপ্লবী কর্মপ্রেরণা বঙ্গের যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় , অরবিন্দ ঘোষ , চারু দত্ত প্রমুখের হাত ধরে। বঙ্গ এবং মাহরাট্টার ( মহারাষ্ট্র) মধ্যে বিপ্লবী ভাবধারা , কর্মপদ্ধতি ও যুবক কর্মীর আদানপ্রদানও তারপর বহু বহু কাল চলেছিল। বিহারের অধিবাসী , বাঙ্গালা সাহিত্য ও সংবাদপত্ৰ সেবী একজন

 মাহরাট্টা ব্রাহ্মণ এই বিপ্লব বোধন যজ্ঞের বিশিষ্ট ঋত্বিক ছিলেন। তাঁর নাম #সখারামগণেশদেউস্কর। তাঁর লেখা #দেশের_কথা সেদিন বঙ্গের বুকে ব্রিটিশ বিরোধী আগুন ছড়িয়ে দিয়েছিল।  তাছাড়াও তিনি বৈপ্লবিক কেন্দ্রে যুবকগণকে দেশের ইতিহাস ও অর্থনীতি পড়াতেন। তার সঙ্গে ব্রিটিশ শাসনে ভারতবাসীর শোষণের কথা শোষণের কথা অগ্নিময়ী ভাষায় বর্ণনা করতেন।  বঙ্গের রাজনৈতিক জন চেতনা উন্মেষের ইতিহাসে এই মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণের অবদান অপরিসীম।

বঙ্গে বিপ্লব বহ্নি প্রজ্জ্বলনে দুইজন বিদেশীরও ( যদি আমি তাঁদের একজন কে তো কোনোদিনই বিদেশী ভাবি না ) অবদান ছিল। প্রথমজন হলেন – জাপানী অধ্যাপক ওকাকুরা । তিনি হেরো নামক এক ছাত্র সমভিব্যাহারে এই সময় কিছুকাল ভারতে অবস্থান করেন এবং আইডিয়ালস্ অব্ দি ইষ্ট্  ইত্যাদি পুস্তক রচনা করেন। 

দ্বিতীয়জন হলে একজন মহিয়সী মহিলা। তিনি অদ্বিতীয়া । স্বামী বিবেকানন্দের স্বনামধন্যা শিষ্যা ভগিনী #নিবেদিতা। এই বহুগুণান্বিতা তেজস্বিনী দেবী আইরিশ হয়েও ভারতকেই নিজ মাতৃভূমিরূপে গ্রহণ করেছিলেন এবং ভারত তথা ভারতবাসীর সেবায় নিজেকর নিঃশেষে বিলিয়ে দেন।

ধর্ম, শিক্ষা , সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ভগিনী নিবেদিতা ভারতবর্ষকে বহুমূল্য রত্নরাজি উপহার দিয়েছেন। বিস্ময়ের বিষয় যে , দেশে বিপ্লব চিন্তাধারার উন্মেষ ও স্বাধীনতা – স্পৃহার জাগরণেও ভগিনী নিবেদিতার দান বিশাল। পি. মিত্র তাঁর খুব ভালো বন্ধু ছিলেন। মিত্র মহাশয় তাঁকে গভীর ভাবে শ্রদ্ধা করতেন এবং সকল কাজে তাঁর উপদেশ ও সাহায্য নিতেন। প্রসঙ্গত হেমচন্দ্রের রচনা থেকে জানা যায় যে মেদিনীপুরে এই পি.মিত্রের সহযোগিতায় অরবিন্দেরও পূর্বে মেদিনীপুরে ১৯০২ সালে একটি গুপ্ত সমিতি গড়ে ওঠে ,কিন্তু কিছুদিন পর বিষয়টি স্তিমিত হয়ে যায়।

বরোদায় মহারাজার আমন্ত্রণে ভগিনী নিবেদিতা ১৯০১ সালে বরোদা যান এবং সেখানেই তাঁর সাথে অরবিন্দ ঘোষের পরিচয় হয়। পরে অরবিন্দ ঘোষ কলকাতায় গুপ্ত সমিতির প্রতিষ্ঠা করলে ভগিনী নিবেদিতা ওই সমিতির সঙ্গে ওতঃপ্রোতভাবে জড়িত হন। নানাদেশের বৈপ্লবিক কর্মধারার ইতিহাসের একটি মূল্যবান পুস্তক সংগ্রহ ভগিনী নিবেদিতার ছিল। বিপ্লবী যুবকদের শিক্ষা এবং সংগঠনের জন্য ওই পুস্তকাবলী তিনি অকাতরে দান করেন। 

বঙ্গে বিপ্লববাদের  অঙ্কুরাবস্থায় ভগিনী নিবেদিতার স্থান ও দান সম্বন্ধে ডাঃ ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত রচিত  ” ভারতের দ্বিতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম” গ্রন্থ হতে বহু তথ্য প্রাপ্ত হয়। –

একবার মাদাম হার্বাট নামক একজন ফরাসী মহিলা ভগ্নী নিবেদিতার জীবনী রচনার নিমিত্ত ভারতে সকল তথ্য সংগ্রহ করতে আসেন। অবশ্যই তাঁকে সে জন্য পন্ডিচেরীর আশ্রমেও যেতে হয়েছিল। তাঁকে শ্ৰীঅরবিন্দ বলেন , ” যখন বাঙ্গালায় বৈপ্লবিক কর্ম পরিচালনার জন্য একটি জাতীয় পরিষদ সংগঠিত হয় , তখন পরিষদের পাঁচজন নির্বাচিত সদস্যের মধ্যে ভগ্নী নিবেদিতা ছিলেন অন্যতম। “

ভগিনী নিবেদিতার নিকট  ” ম্যাটসিনির আত্মজীবনী ” নামক ছয় খণ্ডের পুস্তক ছিল। এগুলি ছিল তাঁর নিজস্ব সম্পত্তি।  এই গ্রন্থের প্রথম খন্ডটি তিনি বৈপ্লবিক সমিতিকে প্রদান করেন। এই গ্রন্থটি সমস্ত বঙ্গে ঘুরত এবং পঠিত হত। এই পুস্তকের শেষে #গেরিলা_যুদ্ধ কি প্রকারে হয় সেবিষয়ের একটি অধ্যায় আছে। টাইপ করে তার নতুন নতুন কপি করে চারিদিকে প্রেরণ করা হত। উদ্দেশ্য ছিল গেরিলা যুদ্ধ প্রণালী শিক্ষণ করা। এই যুদ্ধ পদ্ধতি বিপ্লবীদের মূল লক্ষ্য ছিল। 

১৯০৩ সালে ভগিনী নিবেদিতা মেদিনীপুর শহরে বিপ্লবীদের প্রথম আখড়ার উদ্বোধন করেন । উদ্দেশ্য ছিল শহরের যুবকদের কুস্তি, লাঠিখেলা ইত্যাদির মাধ্যমে বলশালী ও সাহসী করা । ভগিনী নিবেদিতা প্রায় এক সপ্তাহ মেদিনীপুরের হেমচন্দ্র মহাশয়ের গৃহে বাস করেছিলেন। পাঁচদিন ধরে প্রত্যহ সন্ধ্যায় স্থানীয় বেলী হলে নিবেদিতা বক্তৃতা দিতেন এবং প্রাতঃকালে অভ্যাগতদের সঙ্গে ধর্ম , রাজনীতি , শিক্ষা , সাহিত্য এবং বিশেষভাবে ভারতের অতীত গৌরব ও ইতিহাস আলোচনা করতেন। নিবেদিতার আগমনে সারা মেদিনীপুর জুড়ে এক অদ্ভুত উদ্দীপনার সঞ্চার ঘটেছিল। কলকাতার শ্ৰীভূপেন্দ্রনাথ দত্তও এই সময়ে মেদিনীপুর জেলার নানা স্থানে ঘুরে বিপ্লববাদ প্রচার করতেন। 

তোর   আপন জনে ছাড়বে তোরে,

              তা ব’লে    ভাবনা করা চলবে না।

          ও তোর          আশালতা পড়বে ছিঁড়ে,

              হয়তো রে ফল ফলবে না ॥

আসবে পথে আঁধার নেমে,       তাই ব’লেই কি রইবি থেমে–

          ও তুই      বারে বারে জ্বালবি বাতি,

              হয়তো বাতি জ্বলবে না ॥

১৯০২ সালের প্রথমে মেদিনীপুরে যে বিপ্লবের প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করেছিলে কয়েকজন তা কিন্তু শীঘ্রই স্তিমিত হয়ে এসেছিল। নিবেদিতা পূত হস্ত স্পর্শে দীপাগ্নিশিখা পুনরায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল মেদিনীপুরের বুকে। তারপর এল রুশ জাপান যুদ্ধে এশিয়ার নব জাগ্রত জাপানের বিজয় বার্তার উত্তেজনা। আর এলো ১৯০৫ ও বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবের প্রতিবাদে বঙ্গের রাজনৈতিক ভূকম্পন।  

ঐ নির্মল নিঃশব্দ আকাশে

অসংখ্য কল্প-কল্পান্তরের

হয়েছে আবর্তন।

নূতন নূতন বিশ্ব

অন্ধকারের নাড়ি ছিঁড়ে

জন্ম নিয়েছে আলোকে,

ভেসে চলেছে আলোড়িত নক্ষত্রের ফেনপুঞ্জে;

দুয়ার ভেঙে জোয়ার এল।  জন সমুদ্রে ডাকল প্রবল বন্যা। তড়িৎ বেগে গ্রাম হতে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়ল বিদেশী বর্জন ও স্বদেশী গ্রহণের মহামন্ত্র। ধ্বনিত হল বঙ্গের পথে-  ঘাটে – মাঠে জাতির নবজীবনে মহাহুঙ্কার #বন্দেমাতরম্।

©দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যঃ  ১) বাংলায় বিপ্লবের প্রচেষ্টা

২) ভারতের দ্বিতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম

৩) অগ্নিযুগের অস্ত্রগুরু হেমচন্দ্র

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.