দ্বারকা শব্দের ‘দ্বার’ অর্থ দরজা আর ‘কা’ অর্থ স্বর্গ কিংবা মোক্ষ। সে অর্থে দ্বারকা শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘স্বর্গের দ্বার’ কিংবা মোক্ষ লাভের উপায়। এছাড়াও দ্বারকা ভারতের সপ্তপুরী নামে পরিচিত সাতটি বিখ্যাত প্রাচীন শহরের একটি। এখানে অবস্থিত ৮০০ বছর পুরানো ও ৫৭ মিটার উঁচু কৃষ্ণ মন্দির। তবে বর্তমানের এই দ্বারকা শহর মূলত শ্রীকৃষ্ণের প্রতিষ্ঠিত সেই প্রাচীন নগরীর জন্যই বেশি প্রসিদ্ধ, যা একসময় ডুবে গিয়েছিল সমুদ্রের অতল গহবরে। অতীতে এটিকে শুধু পৌরাণিক গল্প হিসেবে মনে করা হলেও ২০০০ সালে এই স্থানে এক প্রত্নতত্ত্বীয় অভিযানে সমুদ্রের নিচে খোঁজ মেলে প্রাচীন এক নগরীর ধ্বংসাবশেষের, যা সেই প্রাচীন নগরী দ্বারকাকেই নির্দেশ করে।খুব ভালোভাবে পরিকল্পনা করেই দ্বারকা নগরী নির্মাণ করা হয়েছিল। পুরো শহরটি মোট ৬টি ভাগে বিভক্ত ছিল। আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকা, চওড়া রাস্তা, নগরচত্বর, সোনা, রূপা ও দামী পাথর দিয়ে নির্মিত বিশাল বিশাল প্রাসাদ, জনগণের সুযোগ সুবিধার জন্য নানা স্থাপনা সহ নানা উদ্যান ও লেক ইত্যাদি নিয়ে গড়ে উঠেছিল দ্বারকা নগরী। প্রায় ৭ লক্ষ ছোটবড় প্রাসাদ ছিল এ নগরীতে। এখানে ছিল ‘সুধর্ম সভা’ নামের এক বিশাল হলঘর, যেখানে নানা ধরনের আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হতো। গোটা নগরীটি ছিল জলবেষ্টিত। এটি ছিল মূলত একটি দ্বীপ-নগর। চারপাশে বেষ্টিত জলরাশি দ্বারকাকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করতো। দ্বারকা নগরী ছিল দু’ভাগে বিভক্ত। একটি মূল দ্বারকা নগরী ও অন্যটি দ্বীপ-দ্বারকা, যা মূলত ‘বেট-দ্বারকা’ নামেই বেশি প্রচলিত ছিল। বিভিন্ন সূত্রানুযায়ী এই দুই দ্বারকার মাঝে ছিল অগভীর সমুদ্র। মূল অংশের সাথে দ্বীপ শহরটি নানা ব্রিজ ও বন্দর দ্বারা যুক্ত ছিল। জোয়ারের সময় মূল দ্বারকা থেকে দ্বীপ দ্বারকা বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। আবার ভাটার সময় যুক্ত হয়ে যেত এ দুটি।অনুসন্ধানে দেখা যায়, বাস্তবেই বর্তমান দ্বারকা নগরীর সামনের সমুদ্রের নিচে প্রায় ৩৬ মিটার গভীরে রয়েছে প্রাচীন সেই নগরীর বিভিন্ন ধ্বংসাবশেষ। এর মধ্যে রয়েছে পাথর নির্মিত বিভিন্ন আকৃতির নোঙর, ভবন ও দুর্গ তৈরিতে ব্যবহৃত নানা পাথরের ব্লক। গবেষণায় দেখা গেছে, এসব ধ্বংসাবশেষের সবগুলোই মহাভারতে বর্ণিত শ্রীকৃষ্ণ নির্মিত সেই দ্বারকা নগরীর সাথে মিলে যায়। এটি প্রমাণ করে তৎকালীন সময়ে দ্বারকা ভারতের অন্যতম ব্যস্ত একটি বন্দর নগরী ছিল। এই আবিষ্কারের ফলে পৌরাণিক দ্বারকা নগরীর অস্তিত্ব কিন্তু চাইলেই আর গল্প বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বাস্তবেই কোনো এক সময় সমুদ্রের কিনারে এই নগরীটির অস্তিত্ব ছিল। হয়তো এটিই একসময় মানুষের কোলাহলে পরিপূর্ণ হয়ে থাকতো, যা এখন হারিয়ে গিয়েছে নীল সমুদ্রের অতল গহ্বরে!
প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, জরাসন্ধ সেই সময়ের অন্যতম শক্তিশালী মাহরথী ছিলেন। অনেকটা ওই চীনের মতো। জরাসন্ধ চেয়েছিলেন সসাগরা পৃথিবীকে নিজের পায়ের তলায় পিষতে। সেইজন্য নানা রাজ্য থেকে রাজা, রাজকুমারদের নিয়ে এসে ওনার আরাধ্যা কুলদেবীর কাছে উৎসর্গ করতেন। অধিকাংশ রাজরাই ওনার করদ রাজ্যে পরিণত হন। ওনার একমাত্র প্রতিপক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ এবং তাঁর প্রসাদ প্রাপ্ত রাজ্যগুলি। জরাসন্ধ ১৭ বার মথুরা আক্রমণ করে ১৭ বারই পরাজিত হন। যে কারণে জরাসন্ধ কালযবনকে প্রেরণের সিদ্ধান্ত নেন। ঋষি গার্গ্য পুত্র কালযবন জন্মের পর যবন রাজার কতৃক দত্তক ও পালিত হন। এখন যবনকুল যেমন যযাতির বংশ ছিলেন, যাদবরাও যযাতির বংশ ছিলেন। এদিকে কালযবনের মাতৃকুল ছিলেন যাদব। কালযবন কেবলমাত্র পরাক্রান্ত রাজাই ছিলেন না , ভগবান শিবের বরপ্রাপ্ত ছিলেন। অস্ত্র, পশু, দেব, মানবসকলের নিকট কালযবন অবধ্য ছিলেন।
তিনি অত্যন্ত অত্যাচারী এবং অহংকারী ব্যক্তি ছিলেন । এই কালযবন একটা সময় নিজের রাজ্যে দাপিয়ে বেরিয়ে ছিলেন। সম্মুখে কোন ব্রাহ্মণকে দেখলেই জিজ্ঞেস করেতেন , “এমন বীর কে আছে যার সঙ্গে যুদ্ধ করা যায় ? ” ……..একদিন নারদ কে সামনে পেয়ে সেই প্রশ্ন করলেন..তখন তার প্রশ্নের উত্তরে নারদ মুনি বলেছিলেন ” তোমার উপযুক্ত যুদ্ধবীর হলেন বৃষি যাদবেরা…” ” বৃষ্ণয়ন্ধককুলং তস্য নারদেন নিবেদিতম”।
এই কৃষ্ণই ছিলেন বৃষিযাদব কুলের প্রধান প্রতিভূ । সৌভপতি শাল্ব জরাসন্ধের আদেশ বয়ে নিয়ে এসেছিলেন কালযবনের কাছে- যাতে কালযবন মথুরা আক্রমণ করেন। কৃষ্ণ বলরাম সে কথা জানতেন । তাঁরা লোকক্ষয় চান নাI।তাই তাঁরা চলে যান দ্বারবতী বা দ্বারকায়। সে নগরী তখনও নির্মিত হয় নি।
কালযবন ইতিমধ্যেই শাল্ব রাজের দৌতজালে আবদ্ধ হয়ে মথুরা আক্রমণ এর তোড়জোড় করছেন এবং তা কৃষ্ণ কে উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য । সভায় উপনীত জ্ঞাতিমুখ্যদের কৃষ্ণ জানালেন যে , পররাষ্ট্রনীতির নীতিজ্ঞতায় তিনি সমাদি উপায় প্রয়োগ করে কালযবনকে শান্ত করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তা বিফলে গিয়েছে জরাসন্ধের কারণে ।
কংস বধ এর কারণে কংস পক্ষপাতী রাজারা কৃষ্ণের বিরোধিতা করার জন্যই সকলে জরাসন্ধের পক্ষে জুটে গিয়েছিলেন – কেচিৎ কংসবধাচচাপি বিরক্তাস্তদগতা নৃপাঃ… এবং তার ফল হিসাবে কালযবন বৃষি অন্ধক যাদব কুলের বিরোধিতায় নেমেছিলেন। এতদিন তাঁরা সরাসরি মথুরা আক্রমণ করেননি বটে কিন্তু কিন্তু চোরাগোপ্তা গুপ্তচরের আক্রমণে সেইসব জরাসন্ধ পক্ষপাতী রাজা কৃষ্ণের জ্ঞাতিগোষ্ঠীর বেশ কয়েকজন কে হত্যা করেছেন….
যাতে নিজের এবং নিজের চারপাশের ভালোবাসার মানুষগুলোর কোনো ক্ষতি না হয় সেই জন্যই বেশিরভাগ জ্ঞাতি ও প্রজাজনকে নিয়ে তিনি দ্বারবতী চলে এসেছিলেন। মথুরা ছাড়বার আগে কালযবনকে ভয়ে ভীত করার জন্য একটি ইঙ্গিতপূর্ণ কাজ করেছিলেন কৃষ্ণ । তিনি সেটি সভায় জানালেন……
কৃষ্ণ একজন দূত পাঠিয়েছিলেন কালযবনের কাছে এবং সেখানে একটি প্রতিকী আচরণ ছিল কৃষ্ণের। তিনি করেছিলেন কি ….একটি কলসির মধ্যে এক কালসর্প পুরে কলসির মুখ বন্ধ করে দূতের মাধ্যমে কালযবনের কাছে পাঠিয়ে ছিলেন। এইখানে ভাবটা হল এই – কৃষ্ণ হলেন কালসর্প, কখন কিভাবে এই সাপের ছোবল আসবে তা কেউ জানেন না… কৃষ্ণের বাইরেটা দেখলে মনে হবে কলসীর মতই শান্ত …কিন্তু শত্রুর বিরুদ্ধে কৃষ্ণ কালসাপের মতো ভয়ঙ্কর …কালসর্পপমঃ কৃষ্ণ…ভীষয়ামাস তং নৃপম।
কালযবন কৃষ্ণের অন্তর্নিহিত কৌশল উপলব্ধি করেছিলেন এবং সেই কৌশলকে নষ্ট করার জন্য, ভয় দেখানোর জন্য অসংখ্য বিষ পিঁপড়ে সাপের কলসীর মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে এর মুখ বন্ধ করে দিলেন।
অতি অল্প সময়েই জ্যান্ত সাপকে পিঁপড়ে কামড়ে অস্থির করে ফেলল । কিছু সময়ের মধ্যেই পিঁপড়েগুলো সাপ কে খেয়ে ধুলো বানিয়ে ফেলল । সাপ ধ্বংস হয়েছে দেখে কলসীটি কালযবন পুনশ্চ কৃষ্ণের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। বোঝাতে চাইলেন কৃষ্ণ তুমি যত বড়ই হও না কেন তুমি একা আমায় কিছু করতে পারবে না…. কারণ আমার শত সহস্র শক, তুষার, দরদ, পারদ সৈন্য সবাই পিঁপড়ের মত এসে তোমাকে ও মথুরাকে ছারখার করে দেবে…
কিন্তু কৃষ্ণ শুধুমাত্র বুদ্ধিমান ব্যক্তিই ছিলেন না ….তার সঙ্গে তিনি একজন বাস্তববাদীও ছিলেন বটে। নিজের পূর্ব কৌশল ব্যর্থ হয়েছে এটি তিনি মেনে নিলেন ও সেই নিতী আঁকড়ে থাকলেন না। অযথা নিজের মধ্যে মাহাত্ম্য বোধকে স্ফীত করলেন না । “বাসুদেবস্তু তং দৃষ্টা যোগং বিহতমাতমং”।
কৃষ্ণ এটা ভালো করে বুঝেছিলেন যে, ভারতবর্ষের প্রত্যন্ত পশ্চিমে ও উত্তরে অবস্থিত শক, পারদ, দরদ ইত্যাদিরা যুদ্ধক্ষেত্রে ভয়ঙ্কর । জরাসন্ধকে বা কালযবনকে আটকানো নিমিত্ত মাত্র। কিন্তু এই উপজাতিরা ভয়ঙ্কর।
“উপসৃজয় মথুরামাশু দ্বারকাম অভিজগমিবান।”
এরপর বন্ধু জ্ঞাতি আত্মীয়দের সবাইকে দ্বারকায় রেখে কৃষ্ণ ফিরে এলেন পুনরায় মথুরায় । কারণ কালযবনের অঙ্ক তাকে শেষ করতে হবে। মথুরায় কৃষ্ণকে না দেখলে কালযবন দ্বারকার দিকে অগ্রসর হবেন এটা কৃষ্ণ জানতেন ।
কলসীর মধ্যে অসংখ্য বিষ পিঁপড়ে ঢুকিয়ে কৃষ্ণসর্পকে নষ্ট করে কৃষ্ণের কাছে পাঠিয়ে… কালযবন নিজের সৈন্য শক্তির যে ইঙ্গিত পাঠিয়েছিলেন কৃষ্ণ কিন্তু তা মনে রেখেছিলেন। কৃষ্ণ একবারও তার সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে ভাবনা ভাবেননি । কালযবনের শক্তির প্রতি সম্মান দেখিয়ে তাকে একা বিচ্ছিন্ন করে ফেলে তবেই হত্যার করার বুদ্ধি করেছিলেন কৃষ্ণ।
তাই কূটনীতি অনুযায়ী কৃষ্ণ একা মথুরা বিচরণ করতে লাগলেন। তিনি এমনভাবে বিচরণ করতে লাগলেন যে বারবার যেন তিনি কালযবনের পথে সুমুখে পড়েন। কৃষ্ণকে একা পেয়ে তার পিছনে কালযবন যেন একা ছটেন।
কালযবন এদিকে মথুরায় ঢুকে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি মথুরাপুরী ঢুকলেন কিন্তু একদমই ফাঁকা… সেখানে কোন শক্তি নেই …কেউ তাকে বাধা দিচ্ছে না ….যে কৃষ্ণের ভয়ে শাল্বরাজ জরাসন্ধের মতো বিশাল শক্তি পুরুষের দৌত কর্ম করছেন ..সেই কৃষ্ণের তরফ থেকে কোনো উদ্যোগ নেই! তাকে প্রতিরোধ করার কোনো চেষ্টা নেই ! তবে কি বিনা যুদ্ধে মথুরা পেয়ে যাবেন?
অথচ কৃষ্ণ নামক পুরুষটিকে তিনি মাঝে মাঝেই চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন ।তিনি ভাবলেন তাহলেই কৃষ্ণকে অন্তত শেষ করে দেওয়া যাক ।তাহলে মূল শত্রু নিপাতিত হবে। তিনি এক সময় সুযোগ বুঝে কৃষ্ণের পিছু নিতে শুরু করলেন।কৃষ্ণ কে বারবার ধরার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না । কৃষ্ণ ক্ষিপ্র হরিনের ন্যায় ছুটতে থাকলেন।
শেষে ক্লান্ত হয়ে কৃষ্ণ কে বললেন , “আজ থেকে তোর নাম হল রনছোর” কৃষ্ণ হেসে বললেন, ” তা বেশ !আমাকে কত লোকে কত কথা বলেছে ….কেউ মাখন চোর ….কেও চিতচোর তুমি আমার নতুন নাম দিলে, রনছোর”… কৃষ্ণ তাকে আকর্ষন করে নিয়ে চলে দূরে দূরে , অনেক দূরে, শহরের প্রত্যন্ত পাহাড় গুলোর কাছে….
অদ্ভুত কৌশলে কৃষ্ণ কালযবনের স্বর্গ প্রাপ্তি ঘটালেন। ত্রেতা যুগে এক রাজা ছিলেন …তার নাম ছিল মুচকুন্দ। দেবাসুরের যুদ্ধে মুচকুন্দ দেবতাদের সাহায্য করেন ও জয়ী হয়েছিলেন। যখন দেবতারা তাকে বরদান করতে চেয়েছিলেন রণ-ক্লান্ত মুচকুন্দ বলেছিলেন “আমি ঘুমোতে চাই, নিশ্চিতভাবে, আমার সেই সুখ নিদ্র যে নষ্ট করবে সে আমার চোখের সামনে পড়ে ভস্ম হয়ে যাবে …”
মুচকুন্দ মথুরার প্রত্যন্ত দেশে অবস্থিত পাহাড়ের গুহায় সেই নিশ্চিন্তে যুগান্তরের ঘুম ঘুমিয়ে ছিলেন… সেই মুচকুন্দ কাল মহাকাল পাথর হয়ে গিয়েছিলেন ঘুমিয়ে।
যুগান্তরের ঘুমে তার সারা শরীরে গাছপালা জন্মে গিয়েছিল। এর মধ্যে কত ঘটনা ঘটে গেছে । ভগবান শ্রী কৃষ্ণের জন্ম হয়েছে। কংস বধ হয়েছে। কত দুষ্টের বিনাশ ঘটেছে । মথুরায় এসেছে কালযবন । কৃষ্ণ ছুটে গিয়ে যেখানে মুচকুন্দ যে পর্বতের গুহায় ঘুমোচ্ছিলেন সেই পর্বতের গুহায় দাঁড়ালেন যুগান্তরের ঘুমন্ত রাজার মাথার কাছে এসে ।
কালযবনও পৌছলেন ছুটতে ছুটতে ।আলো আঁধারের মধ্যে ঠাহর করতে পারলেন না কে দাঁড়িয়ে আছে ?কেইবা শুয়ে আছে ? মুচকুন্দকে কৃষ্ণ ভেবে সজোরে লাথি মারলেন কালযবন। “বাসুদেবং তু তং মত্বা ঘট্টায়মাস পার্থিবম।”
কোন ত্রেতা যুগের সুপ্ত আগুন জ্বলে উঠলো । মুচকুন্দ রাজার ঘুম গেল ভেঙে আকস্মিক পদাঘাতে । দেবতার আশীর্বাদে ক্রোধ বহ্নি উত্থিত হল আপন ইচ্ছে। কাল যবন মুহুর্তের মধ্যে ভস্মীভূত হয়ে গেলেন শুষ্ক বৃক্ষের মত।
মাথার কাছ থেকে ডাকলেন কৃষ্ণ । “হে মহারাজ …আপনি আমার একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কাজ করে দিয়েছেন। আপনি যেই বহুকাল ধরে গুহায় সুপ্ত হয়ে রয়েছেন। এ কথা আমি দেবর্ষি নারদের কাছে শুনেছি।”
যুগান্তরের ঘুম ঘুমিয়ে উঠে অদ্ভুত সব কাণ্ড দেখে অবাক হয়েছিলেন মুচকুন্দ। একজন হয়ে ভস্ম গেল । অন্যজন তাকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন ” কে তুমি? আমি এখানে কত কাল ঘুমিয়ে? যদি জানো তো বলো… “
কৃষ্ণ বললেন ,” আমি চন্দ্রবংশের মহারাজ যযাতি জ্যেষ্ঠ পুত্র যদুর বংশের অধঃস্তন পুরুষ …আমার পিতা বসুদেব তাই আমাকে সবাই বসুদেব কৃষ্ণ বলে জানে…. আপনি যুগ থেকে যুগান্তরে ঘুমিয়ে আছেন… আপনি ত্রেতাযুগে ঘুমিয়ে ছিলেন …এখন দ্বাপর যুগ চলছে আর বেশ বেশ কিছু বছর পর তা শেষ হয়ে কলিকাল আরম্ভ হবে। আপনি আমার উপকার করেছেন । আপনি যাকে ভস্ম করেছেন সে যাদব কুলের পরম শত্রু ছিল। দেবাদিদেব মহাদেবের কৃপায় সে এমন বর পেয়েছিল যে শত বছর যুদ্ধ করলেও কেউ তাকে হারাতে পারত না…ধন্যবাদ..”
তাছাড়াও কালযবনের পিতা গার্গ্য ঋষি ছিলেন পূর্বেই বলেছি। গার্গ্য ঋষি বৃষি অন্ধকদের মধ্যেই ছোট থেকে বর্ধিত হয়েছিলেন । তাই বৃষি অন্ধকরা গুরু গোত্রীয় কালযবনকে প্রহার করতে চাননি। মহাকাল অত্যাচারী অহংকারী কালযবনের হত্যা করার জন্য বিধি নির্ণয় করেই রেখেছিলেন । কৃষ্ণ এতটাই বুদ্ধিমান ছিলেন এবং এমন ব্যক্তিত্ব ছিলেন যাকে তিনি নিজে যুদ্ধ করে বধ করতে পারবেন না এ কথা তিনি স্বীকার করেছিলেন…কিন্তু মুচকুন্দ পারবেন…এটিই তার বুদ্ধির স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া।
কালযবনের ঘটনা ও তার হত্যার মধ্যে এক অলৌকিকতা নেই ।”হরিবংশ ” বা ” বিষ্ণুপুরাণে” কোথাও কিন্তু কালযবনকে কালের প্রতিরূপ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় নি। বরং যুগান্তরের ঘুমন্ত রাজা মুচকুন্দ কালের প্রতিরূপ হিসাবে চিহ্নিত হয়েছেন।
ত্রেতা যুগের যে পৃথিবীকে মুচকুন্দ দেখেছিলেন , দ্বাপর যুগে পৃথিবীকে তিনি দেখলেন অন্যরকম ।তিনি উপলব্ধি করলেন আরো বেশ বেশ বেশ বছর পর যখন কলি আসবে তখন পৃথিবী আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে। তাই তিনি তপস্যা করার জন্য চলে গেলেন গন্ধমাদন পর্বতে।
মথুরাপুরীতে কালযবনের হত্যার সঙ্গে সঙ্গে জরাসন্ধ – শাল্ব- শিশুপাল বলয়ের অন্যতম এক শত্রুর বিনাশ ঘটল কৃষ্ণের অনুকূলে । গুহামুখ থেকে বেরিয়ে মুচকুন্দ চলে গেলেন তপস্যায় । অন্যদিকে কৃষ্ণ সম্পূর্ণ অস্ত্র সজ্জিত হয়ে মথুরাপুরী তে কালযবনের সৈন্য সামন্ত এর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন ।
যুদ্ধের প্রধান নায়ক গত হওয়ায় কারনে কালযবনের সৈনিকরা কিছুই করতে পারল না। কৃষ্ণ তাদের পরাস্ত করে কালযবনের সমস্ত কিছু অধিকার করে নিলেন। কালযবনের ভয় মথুরা থেকে দ্বারকায় আসতে বহু সম্পত্তি , গবাদি ও অর্থ নষ্ট হয়েছিল … তাই সবই তিনি নিয়ে গিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্বাহী নায়ক উগ্রসেনের কাছে সঁপে দিলেন…”আনীয় চোগ্রসেনায় দ্বারব্যতাং ন্যবদয়েত।”
©দুর্গেশনন্দিনী