মহালয়া থেকেই কলকাতার বিভিন্ন থিমের পুজোর দেখার জন্য ভিড় জমে রাস্তায়। তবে শুধুমাত্র পুজো প্যান্ডেলই নয় কলকাতার পুজোর মধ্যে শামিল বনেদি বাড়ির পুজোও। এইসব বাড়ির পুজোগুলি বেশি জাঁকজমকপূর্ণ না হলেও প্রতিটি বাড়িই বহন করছে নিজ নিজ ইতিহাস ও পরম্পরা।
সাবেকি বাড়ির মধ্যে অন্যতম হল বেহশুধু দুর্গা পুজোই নয় রায় বাড়ির সঙ্গে রয়েছে এক দীর্ঘ ইতিহাস। সতেরো শতকের শুরুতে গজেন্দ্র নারায়ণ চট্টোপাধ্যায় এই পুজোর শুরু করেন। তিনি ছিলেন সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজধানী সপ্তগ্রামের কোষাধ্যক্ষ। তিনি ‘রায় চৌধুরী’ উপাধি গ্রহন করেছিলেন। তবে পরে সম্রাট জাহাঙ্গীর পূর্ববঙ্গে স্থানান্তর করলে তিনি উত্তর ২৪ পরগণারর মধ্যমগ্রামে বসবাস শুরু করেন। আর সেখানেই গজেন্দ্র নারায়ণ ও তাঁর বংশধরেরা দুর্গা পুজো শুরু করেন।
তবে ১৭৮২ সালে বর্গী আক্রমণের সময় রায় পরিবার সেই জায়গা ত্যাগ করেন। এবং বেহালাতে আসেন। তার পরেই ১৭৫৬ সাল থেকে পুনরায় বেহালাতে ওই পরিবারের মা দুর্গএকটু বিস্তারিত বলি – মোগল বাদশা জাহাঙ্গীরের (১৬০৫ – ১৬২৭ ) ভূমি রাজস্ব বিভাগের প্রধান সচিব ছিলেন বেহালা রায় পরিবারের আদি পুরুষ গজেন্দ্র নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়। তাঁকে বাদশা, “রাজা” এবং “রায়চৌধুরী” উপাধিতে ভূষিত করে আদিসও গ্রামের খাজাঞ্চী (দেওয়ান ) নিযুক্ত করেন। গজেন্দ্র নারায়ণ তাঁর গৃহদেবতা হিসাবে শ্রীশ্রী লক্ষ্মী জনার্দন দেবকে প্রতিষ্ঠা করেন ও দুর্গাপূজা ও অন্নপূর্ণা পূজার প্রচলন করেন। পরবর্তীকালে তার পরিবার হালিশহর ও মধ্যমগ্রামে বসবাস শুরু করেন ও দুর্গাপূজা ও অন্নপূর্ণা পূজা করতে থাকেন।
আনুমানিক ( ১৭৪২ ) সালে বাংলায় মারাঠা বর্গীদের আক্রমণ হলে, রায় পরিবারের দেবী- কানন্দনের (১৭০০) পুত্র জগৎগ্রাম ও রাজারাম গৃহদেবতা লক্ষ্মী জনার্দনকে সঙ্গে নিয়ে। মারাঠা খাল পার হয়ে বেহালায় নতুন বসতি স্থাপন করেন। “রাজার বাগান” নামে ৫৬ বিঘা জমি ও কয়েকটি পুষ্করিণী ক্রয় করে ভদ্রাসন ও ঠাকুরদালান নির্মান করেন। এই ঠাকুর দালানে (১৭৫৬) থেকে দুর্গাপূজার প্রচলন করেন। (২০০০ সালে এই প্রাচীন ঠাকুর দালান ভাঙা হয়।)
জগতরাম রায়ের পুত্র দুর্গাপ্রসাদ রায় স্বল্পায়ু ছিলেন। তাঁর পাঁচ পুত্র – ভগবতীচরণ যিনি জজ হন, অভয়াচরণ, অম্বিকাচরণ, গৌরীচরণ ও বামাচরণ। কনিষ্ঠ পুত্র বামাচরণ রায়ের ভাগে পুরনো জমিদারী ও অন্নপূর্ণা পূজার দায়িত্ব আসে।
বেহালা রায় পরিবারে ইতিহাস মোগল যুগ থেকেই বেশ পোক্ত। তথাপি এই পরিবারের অন্যতম কৃতী পুরুষ হলেন রায় বাহাদুর অম্বিকাচরণ রায় (১৮৩৪- ১৯০১)। বিভিন্ন ভাষাবিদ অম্বিকাচরণ তৎকালীন কলকাতার উচ্চ আদালতে ব্রিটিশ বিচারপতিদের আরবী, ফরাসী ও অন্যান্য ভাষায় লিখিত আইনের তর্জমা করে সহায়তা করতেন । বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ও জাতির নিজস্ব রীতি নীতি ও আইন প্রণয়ন ক্ষেত্রে সহায়তা করতেন তৎকালীন চিহ্ন জাষ্টিস তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করে রানী ভিক্টোরিয়াকে চিঠি লেখেন।
বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সঙ্গে তার বিশেষ হৃদ্যতা ছিল। স্ত্রী শিক্ষার ব্যাপারে অগ্রণী ছিলেন ও বিধবা বিবাহ আইন পাশের ক্ষেত্রে বিদ্যসাগার মহাশয়ের পক্ষে দ্বিতীয় সই তিনিই করেনি । প্রথম সই করান নিজের জামাইকে দিয়ে।
রায় বাহাদুর অম্বিকাচরণ নিজের যোগ্যতায় অনেক জমিদারী ক্রয় করে প্রভূত ভূ-সম্পদের অধিকারী হন। পুরানো ভদ্রাসন সংলগ্ন নতুন বাসভবন ” অম্বিকা মন্দির নির্মাণ করেন। পরিবারিক দুর্গাপূজার ভার নিজের স্কন্দে তুলে নেন। ঠাকুরদালানে সব ভ্রাতার উপস্থিতিতে দুর্গাপূজা হতো জগৎ রাম রায়ের ভদ্রাসনে। কুলদেবতা লক্ষ্মী জনার্দন দেব আজও পুজিত হচ্ছএক বিশেষ রীতির জন্য পরিচিত এই পরিবার। পুজোর সব কার্যাবলী ও রীতিনীতি একটি খাতায় লিপিবদ্ধ করা হয়। যা ‘খেরোর খাতা’ নামে পরিচিত। এতে জন্মাষ্টমী থেকে বিজয়া দশমী পর্যন্ত সমস্ত হিসেব নিকেশ ও কার্যাবলী নথিভুক্ত করা হয়। এছাড়াও তাদের আর এক রীতির প্রচলন আজও চলে আসছে। সেটি হল, শিউলি গাছের নিচে সারারাত নতুন শাড়ি পেতে রেখে শিউলি ফুল সংগ্রহ করা হয় এই বাড়িতে। যাতে পুজোর দিনে ওই সতেজ ফুল্গুলি মা দুর্গার পায়ে নিবেদন করা হয়।
আজও একই রকমভাবে পুরনো রীতি নীতি নিষ্ঠার সঙ্গে মেনে চলেছে এই পরিবার। আজও প্রথা মেনে কাঠামোতে মাটি লাগানোর কাজ জন্মাষ্টমী থেকেই শুরু হয়ে যায়। মা এখানে একচালায় ডাকের সাজে সজ্জিত। এছাড়াও এখানে পুজোর সময় ভোগ দেওয়ার ও রীতি রয়েছে।
একঘেয়ে থিম পুজো ছেড়ে একটু অন্যরকম বনেদি বাড়ির পুজো দেখতে চাইলে একবার ঘুরে আসতেই পারেন বেহালার রায় বাড়িতে।