১৯২০ সালে ভারতের সমস্ত মসজিদ থেকে দুটি বই বিনামূল্যে বিতরণ করা হত, তার মধ্যে একটি বইয়ের নাম ছিল “কৃষ্ণ তেরী গীতা জ্বালানী পড়েগী,” আর দ্বিতীয় বইটির নাম ছিল “উনিশ শতকের লম্পট মহর্ষি।”
দুটি বইই সম্পূর্ণ বেনামীতে প্রকাশিত হত, কোথাও কোনও লেখক বা প্রকাশকের নাম লেখা থাকত না! উভয় গ্রন্থেই অত্যন্ত অশ্লীল এবং চরম জঘন্য ভাষায় শ্রীকৃষ্ণ আর হিন্দুধর্মকে পাতায় পাতায় আক্রমণ করা হয়েছিল, শ্রীরামের পত্নী সীতাদেবীকে বেশ্যা বলা হয়েছিল এবং এই বইদুটির পাতায় পাতায় হিন্দুদের সমস্ত দেবদেবীদের খুব অশ্লীল স্কেচ আঁকা থাকত!
যখন এই বই দুটির দিকে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছিল, তখন মহাত্মা গান্ধী এটিকে বাকস্বাধীনতার অধিকার বলে বর্ণনা করেছিলেন এবং এর বিরোধীতা করার প্রস্তাব সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
তিনি বলেছিলেন “ভারতে কথা বলার ও মত প্রকাশের অধিকার সবার রয়েছে, তবে হ্যাঁ, এই দুটি বই ভারতের জনমনকে উত্তেজিত করতে পারে।”
এরই প্রতিক্রিয়ায় ১৯২৩ সালে লাহোরের রাজপাল প্রকাশনা থেকে মহেশ রাজপাল জিয়া রঙ্গীলা রসুল নামে একটি বই প্রকাশ করেছিলেন, সেই বইটিরও লেখকের নামটি গোপন রাখা হয়, লেখকের নামের জায়গায় “দুধ কা দুধ আউর পানি কা পানি” লেখা হয়েছিল। এই গ্রন্থটির আসল লেখক ছিলেন পণ্ডিত চম্পুপতি যিনি ছিলেন একজন ইসলামের সুপরিচিত আলেম। বইটির বিশেষত্ব হচ্ছে যে বইটির কোথাও কোন মিথ্যা কুৎসা রটানো হয় নি, কারণ প্রত্যেকটি বিতর্কিত তথ্যকে সমস্ত প্রমাণসহ নির্দিষ্ট হাদীসের পৃষ্ঠা সংখ্যা ও আয়াত সংখ্যা দিয়ে লেখা হয়েছিল। বিনামূল্যে নয়, রঙ্গিলা রসুল বইটি দেড় বছর ধরে সারা দেশে অর্থের বিনিময়ে বিক্রি হচ্ছিল, কোথাও কোনও হুড়োহুড়ি বা গণ্ডগোল হয় নি।
২৮শে মে ১৯২৪ সালে মহাত্মা গান্ধী তাঁর নিজস্ব পত্রিকা ইয়ং ইন্ডিয়ায় একটি দীর্ঘ এবং বিশাল প্রবন্ধ লিখেছিলেন এবং সেই প্রবন্ধে রঙ্গীলা রসুল বইটির তীব্র ভাষায় নিন্দা করেছিলেন।
প্রবন্ধটির শেষ তিন লাইনে তিনি লিখেছিলেন, “মুসলমানদের উচিত যারা এই জাতীয় বই লেখেন তাদের শাস্তি দেওয়া!”
গান্ধীর এই লেখাটি পড়ে সমগ্র ভারতবর্ষের মুসলমানরা ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল এবং রাজপাল প্রকাশকের মালিক মহেশ রাজপালকে পর পর পাঁচ বার আক্রমণ করা হয়েছিল, মহাত্মা গান্ধী একবারও একটি আক্রমণেরও কোন নিন্দা করেননি। এর পর রঙ্গীলা রসুল বইটির বিরুদ্ধে লাহোর হাইকোর্টে মামলা দায়ের করা হল। লাহোর হাইকোর্ট আদালতে বিচারক বাদী পক্ষের ভারত বিখ্যাত চারজন ইসলামিক পন্ডিতকে দাঁড় করিয়ে বলেছিলেন এই বইয়ের কোন কোন জায়গাগুলি ভুল এবং রেফারেন্স হিসেবে উল্লেখিত হাদীসের পৃষ্ঠা সংখ্যা ও আয়াতের সঙ্গে সমার্থক নয় সেগুলি দেখিয়ে দিতে। কিন্তু চারজন ইসলামী পন্ডিতই এইভাবে বইটির কোথাও কোনও তথ্যগত ভুল দেখাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। ফলে লাহোর হাইকোর্ট মহেশ রাজপালের বিরুদ্ধে মামলাটি খারিজ করে তাঁকে বেকসুর খালাস করে দিয়েছিলেন।
এর পর ১৯২৪ সালের ৩রা আগস্ট গান্ধীজী ইয়াং ইন্ডিয়ায় আর একটি উস্কানিমূলক প্রবন্ধ লিখেছিলেন।
এই প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, “যখন কোনও ব্যক্তি আদালত থেকে ন্যায়বিচার পান না তখন তাঁর নিজের চেষ্টায় ন্যায়বিচার আদায় করে নেওয়া উচিত!”
শেষ পর্যন্ত গান্ধীজীর এবং মুসলিমদের চাপে ১৯২৭ সালে ব্রিটিশ সরকার কে একটি নতুন আইন প্রণয়ন করে বইটি নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হয় যাতে যে কোন ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা সম্পর্কে কিছু লেখা অপরাধ বলে ঘোষণা করা হয়।
এর পর মহেশ রাজপালকে আরও দুবার আক্রমণ করার চেষ্টা করা হয়েছিল এবং শেষ পর্য্যন্ত ১৯২৯ সালের এপ্রিল মাসে তাঁর ওপর প্রাণঘাতী আক্রমণটি নেমে আসে!
মহম্মদ ইলম দীন নামে এক যুবক মহেশ রাজপাল এর বিরুদ্ধে এই আক্রমণটি করেছিলেন যার ফলে তিনি মারা গিয়েছিলেন।
মহাত্মা গান্ধী তাঁর হত্যার পরের ৪ দিন ধরে লাহোরে উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু মহাত্মা গান্ধী তাঁর ইয়াং ইন্ডিয়ার কোনও সম্পাদকীয়তে মহেশ রাজপালের হত্যার কোন নিন্দা করেন নি বা শোক প্রকাশ করেন নি। এমন কি তিনি মহেশ রাজপালের বাড়িতে তাঁর পরিজনদের কাছে ন্যুনতম স্বাভাবিক সৌজন্য দেখাতে বা শোক প্রকাশ করতেও যাননি।
সুপরিচিত ব্যারিস্টার মহম্মদ আলী জিন্নাহ লাহোর হাইকোর্টে ব্যারিস্টার হিসাবে উপস্থিত হয়ে মহম্মদ ইলম দীনের হয়ে মামলা লড়তে গিয়ে বলেছিলেন, “যদিও অপরাধী একটি জঘন্য অপরাধ করেছেন কিন্তু তাঁর বয়স মাত্র ১৯ থেকে ২০ বছর, সুতরাং তার অল্প বয়স বিবেচনায় তাঁকে ফাঁসির সাজা না দিয়ে তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা উচিত। তাঁকে এই সাজা ভোগ করার জন্য কালাপানি বা আন্দামানের সেলুলার জেলেও প্রেরণ করা যেতে পারে।”
কিন্তু এই যুক্তি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বিচারকের আদেশে মহেশ রাজপালের খুনি মহম্মদ ইলম দীনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এর কারণ হল তখনকার পুরো হিন্দু সমাজ এই ঘটনায় অতিশয় ক্রুদ্ধ হয়েছিল এবং ব্রিটিশ সরকার মনে করেছিল যে তার যদি মৃত্যুদণ্ড না হয় এবং সেই দণ্ড যদি কার্য্যকর না করা হয় তবে ব্রিটিশ শাসন হুমকির সম্মুখীন হতে পারে।
১৯২৯ সালের ৪ঠা জুন মহাত্মা গান্ধী ব্রিটিশ ভাইসরয়কে একটি চিঠি লিখে মহেশ রাজপালের খুনীকে ক্ষমা করা এবং তাঁর ফাঁসির সাজা মকুব করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। তার পরের দিন ভাইসরয় এর ওপর চাপ সৃষ্টি করতে তিনি তাঁর পত্রিকা ইয়ং ইন্ডিয়ায় একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন।
এই প্রবন্ধে গান্ধীজি দাবী করেছিলেন, “এই হত্যাকারী নির্দোষ কারণ তিনি তাঁর ধর্মের অবমাননা সহ্য করেন নি এবং তিনি রাগের মাথায় এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।”
কিন্তু ব্রিটিশরা ১৯২৯ সালের ৩১শে অক্টোবর, ১৯২৯ সালে লাহোর কারাগারে মহেশ রাজপালের হত্যাকারী মহম্মদ ইলম দীনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে।
মহাত্মা গান্ধী ইয়াং ইন্ডিয়ায় মহম্মদ ইলম দীনকে ফাঁসি দেওয়ার জন্য ৩১শে অক্টোবর ১৯২৯ কে ভারতের ইতিহাসের একটি অন্ধকার দিন বলে ঘোষণা করেছিলেন।
মহম্মদ ইলম দীনের জানাজায় মোট ৬ লক্ষ মুসলিম অংশ নিয়েছিলেন।
বিখ্যাত উর্দূ কবি মহম্মদ ইকবাল বা আল্লামা ইকবাল সেই জানাজায় ভাষণ দিয়েছিলেন, “এই সামান্য ছুতোর মিস্ত্রী এত বড় একটি কাজ করেছেন ইসলামের জন্য আর আমরা শিক্ষিত ব্যক্তিরা শুধু কথাই বলে গিয়েছি!”
তাঁর এই কথায় সেই ভিড়ের অনেকেই চোখে জল রাখতে পারেন নি!
✍ Debal Dev Basu