ভারতীয় সংবিধানের রূপকার ডঃ বি আর আম্বেদকর

ভারতীয় সংবিধানের রূপকার, জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক নেতা, চিন্তাবিদ ও দার্শনিক ডঃ বি আর আম্বেদকর ছিলেন ভারতের দলিত আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা। আম্বেদকর কে ১৯৯০ সালে মরণোত্তর ‘ভারতরত্ন’ – ভারতের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় উপাধিতে ভূষিত করা হয়। বহু সামাজিক-অর্থনৈতিক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে ভারতে কলেজ শিক্ষা অর্জনে আম্বেদকর প্রথম ‘দলিত ব্যক্তি’ হিসেবে স্বীকৃতি পান। অবশেষে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং লন্ডন অর্থনীতি বিশ্ববিদ্যালয় (লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্স) থেকে আইনের ডিগ্রী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ উপাধি লাভ করেন।
ভীমরাও রামজী আম্মেদকর ভারতের গরিব ‘মহর’ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। সেই সময় ভারতীয় সমাজে অস্পৃশ্য জাতি হিসেবে ‘মহর’ সম্প্রদায় গণ্য হত। বর্তমানে মধ্যপ্রদেশে অন্তর্গত ‘মোহ’ অঞ্চলের এবং কেন্দ্রীয় সামরিক সেনানিবাসে ব্রিটিশ কর্তৃক স্থাপিত শহরে আম্বেদকর জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন রামজী মালজি শাকপাল এবং ভীমাবাই এর ১৪ তম তথা কনিষ্ঠ পুত্র। তাঁরা হিন্দু সম্প্রদায়ের অধিভুক্ত ‘মহর’ জাতির সদস্য ছিলেন। সেই সময় এই মহর জাতি অস্পৃশ্য জাতি হিসাবে প্রচন্ড অর্থ ও সামাজিক বৈষম্যের শিকার হত। আম্বেদকরের পরিবার মারাঠি অধ্যুষিত বর্তমানে মহারাষ্ট্রের রত্নগিরি জেলার ‘আম্বোভাদ’ শহরে বাস করতেন। তাঁর পূর্ব পুরুষেরা ছিলেন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনা এবং তাঁর পিতা রামজী শাকপাল ‘মোহ’ সেনা নিবাসে ভারতীয় সেনা হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। রামজী শাকপাল তাঁর সন্তানদের হিন্দু সংস্কৃতি সম্পর্কে অধ্যয়ন করতে উদ্বুদ্ধ করতেন। ভীমরাও শাকপাল আম্বেদকরের বংশ পরিচয় সূচক নামটি এসেছে ‘রত্নগিরি’ জেলায় অবস্থিত নিউ গ্রাম ‘আম্বভাদ’ (Ambavade) থেকে।
নিচু জাতের সন্তান হওয়ার কারণে তাঁকে সামাজিক বৈষম্যের শিকার হতে হয়। তিনি ভারতের অস্পৃশ্যদের সামাজিক অধিকার ও স্বাধীনতার জন্য সারাজীবন লড়াই করে গিয়েছেন। ভারতবর্ষের অস্পৃশ্যতা প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। ২০১২ সালে হিস্ট্রি টি.ভি ১৮ আয়োজিত একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে ভারতীয়দের ভোটের দ্বারা তিনি “শ্রেষ্ঠ ভারতীয়” হিসেবে নির্বাচিত হন। তিনি স্বাধীন ভারতের প্রথম আইন মন্ত্রী ও ভারতীয় সংবিধানের খসড়া কার্যনির্বাহক সমিতির সভাপতি ছিলেন।
আম্বেদকর প্রথম ভারতীয় যিনি বিদেশ থেকে অর্থনীতিতে ডক্টরেট অর্জন করেন। এছাড়াও তিনি দক্ষিণ এশিয়া মহাদেশের প্রথম পি এইচ ডি ডিগ্রিধারী। তিনি দু’বার ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করেন। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকাঅনুযায়ী, পৃথিবীর সেরা ১০০ পাণ্ডিতের মধ্যে তিনি একজন।
আম্বেদকরকে বিদ্যালয়ে অন্যান্য অস্পৃশ্য শিশুদের ন্যায় আলাদা করে দেখা হত। তাঁকে পানীয় জল পর্যন্ত দূর থেকে খাতে দেওয়া হত। শ্রেণি কক্ষের ভেতরে বসার অনুমতি ছিল না। এই সামাজিক বৈষম্যের মধ্যে স্কুলের একজন ব্রাহ্মণ শিক্ষক তাঁকে খুব স্নেহ করতেন। মূলত তাঁর অনুপ্রেরণা ও ভালোবাসাতেই তিনি জ্ঞানের আলোর পথে হাঁটতে পেরেছিলেন। তাঁর ব্রাহ্মণ শিক্ষক মহাদেব আম্বেদকর যিনি তাঁর(আম্বেদকর) প্রতি অত্যন্ত স্নেহ পরায়ন ছিলেন। প্রাথমিক বিদ্যালয় তালিকায় তিনি নিজের গ্রাম ‘আম্বোভাদকর’ (Ambavadekar) থেকে পরিবর্তন করে ‘আম্বেদকর’ রাখেন।
১৯০৩ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে নয় বছরের দাপলির মেয়ে রামাবাই-এর সঙ্গে আম্বেদকরের এর বিবাহ হয়। এই সময় তিনি পরিবারসহ মুম্বাইয়ে চলে আসেন। ১৯১৯ সালে ভারতের শ্রেষ্ঠ পন্ডিত হিসেবে আম্বেদকরকে সাউথ বোরো কমিটিতে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। আম্বেদকর পৃথক নির্বাচক মন্ডলী ও অন্ত্যজদের জন্য কোটা সংরক্ষণ এবং অন্য সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অধিকারের সপক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করেন। সংরক্ষণের বিষয়ে তিনি দাবি তুললেও পরবর্তী ক্ষেত্রে সংরক্ষণ নিয়ে যে ভতের রাজনীতি সুরু হয়েছিল তা তিনি দৃঢ় ভাবে প্রতিবাদ করেন। কারন তিনি মনে করতেন দুর্বলও অনুন্নত শ্রেণীর মানুষদের বাক্তি সত্তার প্রতিষ্ঠা সমাজে অনৈক্য তৈরি করার জন্য সংরক্ষণ রাজনীতিকে তিনি কখনোই সমর্থন করেন নি। ১৯২০ সালে তিনি মুম্বাইয়ের একটি সাপ্তাহিক ‘মুখ্য নায়ক – মৌনদের নেতা’ প্রকাশ করেন। সমাজ ও জাতির জাগরণের জন্য তিনি বক্তৃতা দেওয়া ও আলোচনা করার পাশাপাশি সংবাদপত্রের সম্পাদক ও লেখক হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। বি আর আম্বেদকরকে অনেকে বাবা সাহেব আম্বেদকর নামেও ডাকতেন।
আম্বেদকর ছিলেন স্বপ্নদর্শী। তিনি একাধারে সুবক্তা, বিশিষ্ট লেখক, আইনজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ, ঐতিহাসিক পন্ডিত পাশাপাশি ছিলেন জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ ও বাস্তববাদী। ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠতর প্রশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ওকালতি পেশায় তিনি কম সময় দেন। তিনি বিহার ও মধ্যপ্রদেশকে ভাগ করার প্রস্তাব দেন যার প্রতিফলন ঘটে ২০০০ সালে। বিহার ভেঙে ঝাড়খন্ড এবং মধ্যপ্রদেশ ভেঙে ছত্রিশগড় গঠন করা হয়। তিনি ভারতবর্ষের জল ও বিদ্যুৎ নীতির প্রবর্তক। কেন্দ্র ও রাজ্য স্তরের সেচ প্রকল্প গুলির উন্নতির জন্য তিনি কেন্দ্রীয় কমিশন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি কেন্দ্রীয় প্রযুক্তিগত বল পরিষদ এবং কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি একটি শক্তিশালী ভারত গঠনের উপর জোর দিয়েছিলেন
১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে তিনি বহু সংখ্যক বই, ক্ষুদ্র পুস্তিকা প্রকাশ করেন। ‘থটস অন পাকিস্তান’ বইটিতে তিনি ভারতে মুসলমানদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন তিনি সেখানে উল্লেখ করেন যদি মুসলমানেরা সত্যিই পাকিস্তান চায়, তাদের সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া উচিত। যদি তারা পাকিস্তানে বশ্যতা স্বীকার করে তবে তাদের অবশ্যই সে অধিকার দেয়া হবে। ভারতের প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীতে নিয়োজিত মুসলমানদের বিশ্বাস করা যায় কিনা তা নিয়ে তিনি প্রশ্ন তোলেন। মুসলমানরা যদি ভারত আক্রমণ করে অথবা মুসলমান বিদ্রোহ হয় তবে ভারতীয় তবে ভারতীয় মুসলিম সেনারা কার পক্ষ নেবে? ভারতের সুরক্ষার কারণে মুসলমানরা যেভাবে চায় সেভাবে পাকিস্তানকে মেনে নেওয়া উচিত। আম্বেদকর এর মতে হিন্দুদের ধারণা যে, যদিও হিন্দু ও মুসলমান দুটি ভিন্ন জাতি তারা একটি রাষ্ট্রে একত্রে সহবস্থান করতে পারে – তাঁর মতে এটি ছিল একটি বিকৃত পরিকল্পনা কোন সুস্থ ব্যক্তি এতে সম্মত হতে পারেনা। আম্বেদকর দক্ষিণ এশিয়ায় ইসলাম চর্চারও সমালোচক ছিলেন। ভারত বিভক্তি সমর্থন করে তিনি মুসলিম সমাজে বাল্যবিবাহ চর্চা এবং নারীদের ভুল পথে পরিচালনার নিন্দা করেন। তিনি দৃঢ় কণ্ঠে মুসলিম সমাজে পীড়াদায়ক পর্দা প্রথার মাধ্যমে নারীদের উৎপীড়নের সমালোচনা করেন।
যাইহোক ধর্মের ভিত্তিতে শান্তির জন্য দেশ ভাগ হওয়ার পর স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনার সময় আম্বেদকর জী ভারতকে ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ হিসেবেই ভাবতেন। পাকিস্তান হল মুসলিম রাষ্ট্র আর ভারত ‘হিন্দুরাষ্ট্র’। ভারতে ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটিকে তিনি সমালোচনা করেছিলেন, তাই ভারতবর্ষের সংবিধানের প্রস্তাবনায় তিনি ভারতবর্ষকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ বা সেকুলার রাষ্ট্র বলেন নি। তিনি সংবিধানের প্রস্তাবনা উল্লেখ করেছিলেন, ভারতবর্ষ হল একটি ‘সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক, প্রজাতন্ত্র’। সেখানে তিনি ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ও ‘সমাজতান্ত্রিক’ শব্দ দুটি যুক্ত করেন নি। এর পরিবর্তে তিনি মৌলিক অধিকার হিসেবে ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার, সাম্যের অধিকার ও শোষণের বিরুদ্ধে অধিকারকে বেশি প্রাধান্য দেন। সামাজিক ন্যায়-নীতি প্রতিষ্ঠার জন্য ভারতবাসীর সমানাধিকারের বিষয়টির উপর জোর দেন। পাশাপাশি ধর্ম পালন নিয়ে যাতে সমস্যার সৃষ্টি না হয় তার জন্য তিনি ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকারের উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হওয়া ভারতবর্ষ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হতে পারে না – এটা তিনি মনেপ্রাণে মানতেন। তাই তিনি সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ভাবনাকে কোনও গুরুত্বই দেন নি। কারণ তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, ধর্মনিরপেক্ষতা ভারতের রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় ধাক্কা। ধর্মনিরপেক্ষতা ভারতবর্ষে হিন্দু সম্প্রদায়ের সবথেকে বড় অভিশাপ।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী, ভারতীয় সংবিধানের রূপকার বি. আর. আম্বেদকর এক শক্তিশালী, আত্মনির্ভর ভারত গঠন করতে চেয়েছিলেন। যে ভারত সমগ্র বিশ্বে আপন বৈভবে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকবে। তাই সব দেশের সংবিধানের ভালো অংশগুলিকে নিয়ে ভারতবর্ষের সংবিধান রচনা করেছিলেন। অস্পৃশ্যতা, অশিক্ষা, জাতিভেদ, ধর্মান্ধতা-কে পরাজিত করে বি. আর. আম্বেদকর এক বৈভবশালী ভারতবর্ষ গড়ার জন্য একজন একনিষ্ঠ সেবক, সেনাপতি ও শিল্পী ছিলেন – একথা বলাই বাহুল্য।

সরোজ চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.