ডোল রাজনীতি কি এই প্রথম দেখছে রাজ্যবাসী? নাকি অনেক পুরোনো খেলা? ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী থেকে ডঃ মনমোহন সিং সবাই এই ডোল রাজনীতি করেছেন l কিছু ডোল মোদীজিও বন্ধ না করে এগিয়ে নিয়ে গেছে l কিন্তু ইন্দিরাজি বা রাজীবজি ডোলের সঙ্গে মনমোহন সিংজি বা মোদীজির এর ডোলের পরিস্থিতিগত একটা বড় পার্থক্য আছে l
1980 তে দ্বিতীয়বার ফিরে এসে, ইন্দিরাজি ষষ্ঠ প্লানিং কমিশন গঠন করে তাতে গরিবি হাঁটতে তিনটি পরিকল্পনা করলেন, যখন সরকারের হতে বলতে গেলে পয়সা নেই l এর দুই বছর আগেই আর্থিক বৃদ্ধির হার ঋণাত্মক ছিল l তিনটি পরিকল্পনা হল, এক, ইন্টিগ্রেটেড রুরাল ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান (IRDP), দুই, ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট প্রোগ্রাম (NREP ), তিন রুরাল ল্যান্ডলেস এমপ্লয়মেন্ট জেনারেশন প্রোগ্রাম (RLEGP )l এখন, যে দেশে কোন নতুন অ্যাসেট তৈরি হচ্ছে না, তাঁরা কিভাবে এই ধরনের প্রোগ্রাম নেবে? এরজন্য সরকারের টাকা দরকার l ইন্দিরা গান্ধীর রাজত্বকালে, FERA আইনের বলে আমদানি রফতানি প্রায় বন্ধ l বেসরকারী ব্যবসা লাইসেন্স রাজ, কোটা রাজের গেরোয় আটকে l কোথা থেকে আসবে এই টাকা? উনি কিন্তু এমন সিদ্ধান্ত নিলেন যাকে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত না বলে অনর্থনৈতিক বলাই শ্রেয় l
এক, করের হার বাড়ালেন ভীষনভাবে
দুই, বিদেশী মুদ্রার ভান্ডার খরচ করা শুরু হল
তিন, রিজার্ভ ব্যাংক টাকা ছাপানো শুরু করলো l
বলাই বাহুল্য, দেশে সমস্যা বাড়লো l একের পর এক রাজ্যে বিধানসভা ভোটে হারতে থাকল কংগ্রেস l কিন্তু 1984 তে তাঁর হত্যার পর কংগ্রেস আবার রেকর্ড ভোটে ফিরল তাঁর অনভিজ্ঞ পুত্র রাজীব গান্ধীর হাত ধরে l দেশের আর্থিক হাল খারাপ হতে হতে 1991 তে দেউলিয়া হবার পথে, তখন নরসিমা রাওয়ের রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন এবং তারপর ইতিহাস l
অন্যদিকে, ডঃ মনমোহন সিং ঘোষিত 100 দিনের কাজ বা নরেগা কিন্তু একটা শক্ত ভিতের উপর দাঁড়িয়ে ছিল l সেই সময় নরসিমা রাওজি, অটলজি দেশকে এক শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করিয়ে রেখে গেছেন l এমনকি মাঝে দুই বছর দেবেগৌড়াজি ও গুজরাল সাহেবও আর্থিক দিক থেকে দুর্দান্ত ইনিংস খেলে গেছেন l দেশে তখন জিডিপি বাড়ছে 8% থেকে 10% হারে l দেশ সফটওয়্যার, ওষুধ, টেক্সটাইল রপ্তানি করে বিলিয়ন ডলারে আয় করছে বিদেশী মুদ্রা l ব্যাঙ্কিং, টেলিকম, পরিকাঠামো সংস্কারে বেড়েছে অভ্যান্তারীন ব্যবসা এবং পরোক্ষ কর l দেশের আর্থিক বৃদ্ধির সঙ্গে আসম্য বাড়ছিল l ডঃ সিং কিছু মানুষের হতে টাকা দিয়ে গরিব মানুষের বেতন নিয়ে দরাদরি করার ক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, যা সঠিক সিদ্ধান্তই ছিল l পরবর্তীকালে, মোদীজি এই প্রকল্প এগিয়ে নিয়ে যান, সঙ্গে খুলে দেন সবার ব্যাংকের খাতা এবং যোগ করেন বিভিন্ন বীমা, পেনশন ও ক্ষুদ্র লোনের প্রকল্প l এই ব্যাংকের খাতা না খুললে, কোভিডের সময় রাতারাতি 80 কোটি টাকা দেয়া অসম্ভব হয়ে যেত l নেতা ও বাবুদের পকেটে চলে যেত 85% (রাজীব গান্ধীর মন্তব্য ) l এই সময় রাষ্ট্রের সেই এই দানধ্যানের ক্ষমতা তৈরি হয়েছে l
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কি সেই ক্ষমতা আজ আছে?পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে ইন্দিরা গান্ধীর এই জনমুখী রাজনীতি এবং তাঁর ব্যর্থতা থেকে শিখতে হবে l এটা ভুললে চলবে না যে ইন্দিরাজিকে এই সব বুদ্ধি দিয়ে যারা দেশকে দেউলিয়া হবার দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই প্রেসিডেন্সি বা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা বাঙালী l যেমন অশোক মিত্র, অর্জুন সেনগুপ্ত, সিদ্ধার্থ রায় থেকে প্রণব মুখার্জী l যদিও আর ভেঙ্কটরামনও বা পি এন হাস্কররাও ছিলেন l ইন্দিরাজির সবচেয়ে প্ৰিয় অর্থনীতিবিদ ছিলেন আমাদের সকলের প্রণম্য ডঃ অমর্ত্য সেন, যাকে অর্থমন্ত্রী হতে অনুরোধ করেছিলেন ইন্দিরাজি l (উনি রাজি হন নি এবং নিন্দুকেরা বলে ওঁনার এই সিদ্ধান্ত নাকি নিজের দেশের প্রতি সবচেয়ে বড় অবদান l ) আজকের, পশ্চিমবঙ্গকে বাঁচাতে গেলে এই জনমুখী রাজনীতির রাস্তা কিন্তু ত্যাগ করতে হবে l শোনা যাচ্ছে, সরকার নাকি পূর্ত দপ্তরের বাজেট কমিয়ে সামাজিক প্রকল্পে বরাদ্দ বাড়াচ্ছে l শিক্ষা ও স্বাস্থ্য দপ্তরে প্রচুর খালি পদ l পশ্চিমবঙ্গ আগামীদিনে একটা 1991 এর ভারত বা 2021 এর শ্রীলঙ্কার মত জায়গায় চলে যাচ্ছে না তো? আমাদের প্রজন্মের ‘অরাজনৈতিক’ সাধারণ মানুষদের একটা অংশ চলে গেছে দেশের বা রাজ্যের বাইরে আর একটা বড় অংশ বাবা মার পেনশন বা রেখে যাওয়া পয়সার সুদে দিন কাটাচ্ছে l কিন্তু তাঁরা তো কিছু রেখে যাচ্ছেন না পরের প্রজন্মের জন্য? এরপর? শিয়ালদহ থেকে 30 কিমি দূরে জমির যে দাম আর ছাত্রপতি শিবাজী টার্মিনাল থেকে বা নিউ দিল্লি স্টেশন থেকে 30 কিমি দূরে জমির দাম তুলনা করলে আমরা বুঝতে পারি আমাদের অ্যাসেটের অবমূল্যায়ন কিভাবে হচ্ছে l এরপরে উত্তরপূর্বাঞ্চলের সেভেন সিস্টারের সঙ্গে আমাদের যোগ করে এইট সিস্টার করে দেয়া হবে না তো?
সুদীপ্ত গুহ