ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে ধমকাচ্ছেন এক ডাক্তার, ভাবা যায় ! অথচ এটিই ঘটনা। আর ধমকাচ্ছেন এক দুর্মুখ, রাগী, নাস্তিক ডা: মহেন্দ্রলাল সরকার। আর শ্রীরামকৃষ্ণকে “তুমি” বলে এই একজন মানুষই ডাকতেন, তিনি এই মহেন্দ্র ডাক্তার। সেই ১৮৮৫ সালে যখন কলকাতার সাহেব ডাক্তারদের সর্বোচ্চ ফি ছিল ১৬ টাকা, তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় এম. ডি. মহেন্দ্র ডাক্তারের ফি ছিল তার দ্বিগুণ—৩২ টাকা। লোকে বলতো, ধন্বন্তরী।
অসম্ভব মেজাজী। নিয়মে কঠোর। বড়লোক রোগীদের এক টাকাও ছাড় ছিল না, কিন্তু আবার তিনি ছিলেন গরীবের ভগবান। বিনা পয়সায় চিকিৎসা করতেন তাদের।
শ্রীরামকৃষ্ণের গলায় তখন কর্কট রোগ ধরা পড়েছে। একদিন কাশীপুর থেকে ডাক্তারবাবুর ডাক পড়লো। মহেন্দ্রলাল এলেন আর শ্রীরামকৃষ্ণের বিছানায় সটান বসে পড়ে তাঁকে ধমকাতে শুরু করলেন, তুমি নাকি আজকাল পরমহংসগিরি করছো? …কথা বলা, নাচন-কোদন এসব চলবে না। তাহলেই রোগ বেড়ে যাবে।
শ্রীরামকৃষ্ণের চারপাশে তখন দাঁড়িয়ে রয়েছেন মা সারদা থেকে শুরু করে পরবর্তীকালের বিখ্যাত লোকজনেরা। কিন্তু ডাক্তারবাবুকে থামাতে সাহস পাচ্ছেন না কেউই। ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার সমানে শ্রীরামকৃষ্ণকে ধমক দিয়ে চলেছেন আর শ্রীরামকৃষ্ণ তা শুনে হাসছেন। নিজের ব্যস্ত চেম্বার ফেলে শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে ছুটে এসেছেন তখনকার ৩২ টাকার ডাক্তার। শ্রীরামকৃষ্ণকে বলছেন, শোনো, তুমি শুধু আমার সঙ্গে কথা বলবে।
এরপর থেকে ডা: মহেন্দ্রলাল সরকার প্রায়শই চেম্বার ফেলে শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে আসতেন। তবে দু’জনের মধ্যে কোনো ধর্মকথা আলোচনা হতো না। অন্য বিষয় নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা হতো দু’জনের মধ্যে। শ্রীরামকৃষ্ণ জিজ্ঞেস করতেন, কি ডাক্তার, চেম্বারে যাবেন না? মহেন্দ্র ডাক্তার রেগে বলতেন, সে তোমায় অত ভাবতে হবে না ঠাকুর, আমার কাজ আমি ঠিক সময়েই করে নেব। উত্তরে শুধু হাসতেন শ্রীরামকৃষ্ণ।
দু’জনের কথাবার্তার ফাঁকে আমরা একবার ডা: মহেন্দ্রলাল সরকারের কাছ থেকে ঘুরে আসি। জন্ম: ১৮৩৩ সালের ২ রা নভেম্বর। মৃত্যু: ১৯০৪ সালের ২৩ শে ফেব্রুয়ারি। কলকাতার হেয়ার স্কুল থেকে খুব ভালো রেজাল্ট করে হিন্দু কলেজ ( বর্তমানে প্রেসিডেন্সি) এবং সেখানেও অসম্ভব ভালো ফল করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাক্তারী পড়তে ঢুকলেন। সেখানে তাঁর প্রতিভা দেখে রীতিমতো চমকে যান শিক্ষকরা। এজন্য তিনি যখন তৃতীয় বর্ষের ছাত্র, তখন তাঁকে মাঝে মাঝে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রদের কাছে লেকচার দিতে পাঠাতেন।
১৮৬০ সালে মেডিক্যাল কলেজ থেকে সম্মানের সঙ্গে মেডিসিন, সার্জারি ও মিডওয়াইফারিতে অনার্স নিয়ে উত্তীর্ণ হলেন। এরপর ১৮৬৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় এম. ডি. হলেন। শুরু হলো ৩২ টাকা ফি নিয়ে ডাক্তারী প্র্যাকটিশ্। মজা করতেন হোমিওপ্যাথি নিয়ে। পরে সেই তিনিই হয়ে গেলেন এক নম্বর হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। তবে ফি একই রইলো—৩২ টাকা।
১৮৭৬ সালে কলকাতার বুকে প্রতিষ্ঠা করেন—“ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর্ দ্য কালটিভেশন অব্ সায়েন্স।” ভারতে বিজ্ঞান প্রসারের ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠানটির গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। ডা: মহেন্দ্রলাল সরকারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো, মেয়েদের বিয়ের বয়স কমপক্ষে ১৬ বছর করা। মূলত তাঁর পরামর্শেই সরকারীভাবে মেয়েদের এই বিয়ের বয়সটি নির্দিষ্ট হয়। এরপর ১৮৮৮ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন তিনি এবং এই সম্মেলনে অসমের চা শ্রমিকদের দুর্দশার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তাব গৃহীত হয়। তিনি শ্রমিকদের অপমানসূচক “কুলি” শব্দটি ব্যবহারে আপত্তি তোলেন।
এছাড়াও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো, অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট, কলকাতার শেরিফ ও বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি বুঝেছিলেন, মহিলা রোগিনীরা পুরুষ ডাক্তারের কাছে খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। এজন্য তিনি ও দ্বারকানাথ গাঙ্গুলির উদ্যোগে উৎসাহিত হয়ে ভারতের দ্বিতীয় এবং পশ্চিমবঙ্গের প্রথম বিলেত ফেরৎ মহিলা ডাক্তার হোন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা গ্রাজুয়েট কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়।
কাদম্বিনী ছাড়া আরও একজনের মহিলা ডাক্তার হবার কথা ছিল। তিনি ডাক্তারি পড়তে চেন্নাই গিয়েছিলেন, কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে মাঝপথেই ডাক্তারী পড়া ছেড়ে বাড়ি ফিরে এলেন। তিনি বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর সহধর্মিণী লেডি অবলা বসু। যেদিন শ্রীরামকৃষ্ণ দেহ রাখলেন, খবর পেয়ে ছুটে এলেন। দেখে বললেন, প্রাণবায়ু নির্গত হয়ে গেছে।
এরপর নি: শব্দে নেমে এলেন। কাছে একজনকে ডেকে বললেন, শোনো, একটা ফটো তোলার ব্যবস্থা কর। এই রইল আমার দশ টাকা চাঁদা। এই বলে আবার নি: শব্দে বেরিয়ে গেলেন। না, নাস্তিক ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারকে বুঝি কাঁদতে নেই !