কাশ্মীরে পাক সন্ত্রাস নিয়ে গত কয়েকদিন ধরেই নানারকম সমালােচনা শােনা যাচ্ছে। এইসব সমালােচনা মূলত উঠছে বিরােধী রাজনৈতিক শিবির থেকেই। সমালােচনার কেন্দ্রবিন্দু কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এবং মুখ্যত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামােদরদাস মােদী। উদ্দেশ্য যেন তেন প্রকারেণ মােদীর বিরুদ্ধাচারণ করে ভােটের আগে সরকার বিরােধী হাওয়ায় বাতাস করা। দুর্ভাগ্যবশত, এই সমালােচনার শীর্ষে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের সরকার এবং শাসক দল। কারণ তাদের সব রাজনৈতিক খেলা, সাম্প্রদায়িক ভােটের অঙ্ক এবং দুর্নীতির নেপথ্য কাহিনি প্রধানমন্ত্রী ধরে ফেলেছেন।
প্রশ্ন হলাে, যাঁরা বিরােধিতা করছেন, তারা কি কাশ্মীরের প্রকৃত পরিস্থিতি সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ? তারা কি জানেন, জম্মু এবং কাশ্মীর রাজ্যটির গরিষ্ঠ জনসংখ্যা মুসলমান নন, হিন্দু এবং অন্যান্য সম্প্রদায়? তারা কি জানেন, জনসংখ্যার ভারসাম্যের হিসেবে পাকিস্তান কখনই কাশ্মীরকে তাদের জমিদারি বলে দাবি করতে পারে না শুধু এই অজুহাতে যে কাশ্মীর মুসলমানদের স্বর্গরাজ্য। তাঁদের কাছে কি এই তথ্য আছে যে জম্মু এবং কাশ্মীরের ২২টি জেলার মধ্যে মাত্র পাঁচটি জেলা বিচ্ছিন্নতাবাদের সমর্থক এবং সমস্যার তীব্রতা শুধু এই পাঁচটি জেলাতেই? বাকি সব জেলাই ভারতীয়ত্বে বিশ্বাসী? যদি না জানা থাকে, তাহলে তাঁদের পরামর্শ দেব নীচের তথ্যগুলি পড়ে অনুধাবন করতে এবং তারপর সমালােচনার বাণী ছড়াতে। কারণ মনে রাখতে হবে, কিছু মানুষের অজ্ঞতার জন্য গােটা দেশকে বিপন্নতার পথে ঠেলে দেওয়া যায় না। ওইসব অজ্ঞ মানুষের উচিত, মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকা অথবা দেশদ্রোহিতার নামাবলী গায়ে দিয়ে সীমান্ত পার হওয়া।
জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের মােট আয়তন ১০১৩৮০ বর্গকিলােমিটার। এর মধ্যে ধরা হচ্ছে পাক-অধিকৃত কাশ্মীরকেও যা সম্পূর্ণ বেআইনি ভাবে দখল করে রেখেছে পাকিস্তান শুধুমাত্র ভারতের অভ্যন্তরে যখন তখন সন্ত্রাসবাদী হামলা চালানাের সুবিধার জন্য। এই ১০১৩৮০ বর্গ কিলােমিটারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি এলাকা লাদাখে— ৫৯ শতাংশ। মােট আয়তনের ২৬ শতাংশে রয়েছে জম্মু আর কাশ্মীরের অবস্থান মাত্র ১৫ শতাংশ জুড়ে। এ থেকে একটা উপসংহারে পৌঁছতে কোনও অসুবিধা নেই যে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের অতি ক্ষুদ্র অংশ জুড়ে কাশ্মীরের অবস্থান। এর চেয়ে বড়াে তথ্য হলাে, ১০১৩৮০ বর্গ কিলােমিটার এলাকার ৮৫,০০০ বর্গ কিলােমিটারে মুসলমান জনসংখ্যা থাকলেও তা যৎসামান্যই। বলা চলে ৮৫ শতাংশ অঞ্চলেই সংখ্যাগরিষ্ঠ হলাে হিন্দু জনসমাজ।
জম্মু ও কাশ্মীরের বর্তমান জনসংখ্যা ১ কোটি ২৫ লক্ষ। এর বাইরেও রয়েছে সাড়ে সাত লক্ষ মানুষ যারা ভারতবর্ষের নাগরিকই নয় অর্থাৎ এরা মূলত অনুপ্রবেশকারী। সরকারি তথ্য অনুযায়ী ভারতীয় নাগরিকত্ব রয়েছে এমন ১ কোটি ২৫ লক্ষ জম্মু ও কাশ্মীর নিবাসী জনগণের মধ্যে কাশ্মীরে বসবাস করেছেন ৬৯ লক্ষ মানুষ যার মধ্যে ৫৬ লক্ষ মানুষ কাশ্মীরী ভাষায় কথা বলে। বাকি ১৩ লক্ষের ভাষা অন্য। অর্থাৎ আক্ষরিক অর্থে এই ১৩ লক্ষ মানুষ কাশ্মীরি নন। জম্মুতে বসবাস করছেন ৫৩ লক্ষ মানুষ। এদের বেশিরভাগ কথা বলেন স্থানীয় ডােগরি ভাষায়। তাছাড়া রয়েছেন হিন্দি ও গুরুমুখী ভাষার মানুষ। লাদাখের জনসংখ্যা সবচেয়ে কম। মাত্র তিন লক্ষ। এরা লাদাখি ভাষায় কথা বলেন। অর্থাৎ সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে এ রাজ্যে কাশ্মীরি ভাষার আধিপত্যও যথেষ্ট কম।
জম্মু ও কাশ্মীরে রয়েছে ২২টি জেলা। ওই ২২টি জেলার ১৭টি জেলাই কিন্তু উপদ্রববিহীন এলাকা। উপদ্রুত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত মাত্র ৫টি জেলা। এগুলি হলাে শ্রীনগর, অনন্তনাগ, বারামুল্লা, কুলগাম এবং পুলওয়ামা। লক্ষ্যণীয় এই পাঁচটি জেলাই পাকসীমান্ত বা নিয়ন্ত্রণরেখা থেকে বহুদূরে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে সন্ত্রাসবাদী ক্রিয়াকলাপ এই জেলাগুলিতেই সবচেয়ে বেশি কারণ সন্ত্রাসবাদের কারিগর ও সমর্থনকারী সুন্নি মুসলমানগােষ্ঠী এই জেলাগুলিতেই বেশি, যদিও সামগ্রিক হিসাবে তাদের সংখ্যা মাত্র ১৫ শতাংশ। এই ১৫শতাংশের মধ্যে আবার একটা অংশ ক্ষুদ্র হলেও সন্ত্রাসবাদের সমর্থক নয়। তাহলে বােঝা যাচ্ছে, যারা আজ ভূস্বর্গ কাশ্মীরকে আজাদ কাশ্মীরে বা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করতে চাইছে, তাদের সংখ্যাটা মােট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশের বেশি নয়। সমালােচকরা অবশ্য বলছেন, বিষয়টা এত সরল নয়। কারণ ওই পাঁচটি জেলায় সব মানুষই সন্ত্রাসবাদীদের সাহায্যকারী। যদিও তাঁরা যা বলছেন না, তা হলাে, যারা সাহায্য করছেন তারাও সন্ত্রাসবাদেরই শিকার। ঠিক যেমনটি খলিস্তান আন্দোলনের সময় গােটা পঞ্জাববাসীর হয়েছিল। আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে যখন আন্দোলনের রাশ মূল নেতৃত্বের হাতের বাইরে চলে যায় এবং আন্দোলন মূলত সন্ত্রাসবাদীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় তখনও পঞ্জাবের সাধারণ অধিবাসীরা বাধ্য হতেন সন্ত্রাসবাদীদের অঙ্গুলিহেলনে সায় দিতে। যারা মনে করেন, কাশ্মীর হলাে মুসলমানদের, তারা হয়তাে জানেন না গােটা জম্মু এবং কাশ্মীরে ১৪টি সংখ্যাগুরু ধর্মীয় জনগােষ্ঠী এবং জনজাতি রয়েছে। মােট জনসংখ্যার ৮৫ শতাংশ জুড়েই রয়েছেন এইসব জনগােষ্ঠীর মানুষ। এদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য অংশ হলাে শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত মুসলমান। এরা কিন্তু একেবারেই ভারত-বিদ্বেষী নন। কাশ্মীরি পণ্ডিতরা তাে আছেনই। এছাড়া রয়েছে রাজপুত, ব্রাহ্মণ, মহাজন (সামাজিক ভাবে এরা ডােগরা বলে পরিচিত), শিখ, লাদাখি (বৌদ্ধধর্মাবলম্বী), গুজ্জর, বকরওয়াল, পাহাড়ি, বাল্টি, খ্রিস্টান এবং অন্যান্যরা।
ভারত-বিদ্বেষী হলাে সুন্নি সম্প্রদায়ভুক্ত মুসলমান জনগােষ্ঠী সহ কাশ্মীরি ভাষায় কথা বলে এমন ৩৩ শতাংশ জনগণ। এই ৩৩ শতাংশ মানুষই হুরিয়ত থেকে সন্ত্রাসবাদ, ন্যাশনাল কনফারেন্স থেকে পিপলস ডেমােক্র্যাটিক পার্টিকে নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থাৎ সন্ত্রাসবাদ, ধর্মীয় বিষয় এবং রাজনীতি— সবই এদের নিয়ন্ত্রণে। অদ্ভুত ব্যাপার রাজ্যের আমলাতন্ত্র থেকে কৃষি সবই এদের দখলে। বাকি ৬৯ শতাংশ মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ সেই সুযােগ থেকে বঞ্চিত। এদের মধ্যে রয়েছে শিয়া ১২ শতাংশ, গুজ্জর মুসলমান ১৪ শতাংশ, পাহাড়ি মুসলমান ৮ শতাংশ। এরা কেউই ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায় না এবং পাকিস্তানকে এরা শত্রু হিসেবেই মনে করে, ঠিক যেমনটি মনে করে অন্যান্য সম্প্রদায়ের মােট ৪৫ শতাংশ মানুষ। সামরিক বাহিনীকে আক্রমণ, ঘরে ঘরে পাকিস্তানের পতাকা ওড়ানাে, ভারত বিদ্বেষী স্লোগান তুলে মিছিল মিটিং— এ সবই ঘটে পাঁচটি উপদ্রুত জেলায়। অন্যত্র নয়। সীমান্তের অনেক কাছাকাছি এলাকা পুঞ্চ ও কার্গিল। এই দুটি অঞ্চলেই ৯০ শতাংশ জনগণ মুসলমান। কিন্তু এইসব এলাকায় দেশদ্রোহী কোনাে ঘটনাই ঘটে না। শুধুমাত্র দেশবিরােধী কিছু গণমাধ্যম এবং ভারত-বিদ্বেষী কিছু কাশ্মীরির একটানা প্রচারের ফলে গােটা দেশবাসী ধরে নেয় গােটা জম্মু ও কাশ্মীরই ভারতের বিরুদ্ধে।
প্রকৃতপক্ষে এই প্রচারের প্রভাব পড়ছে সবচেয়ে বেশি জম্মুতে। মূলত ব্যবসায়ী এলাকা বলে চিহ্নিত জম্মুতে হিন্দুরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং এরা তীব্র মােদী সমর্থক। প্রভাব পড়ছে লাদাখেও যেখানে মূল অর্থনীতিই পর্যটন-নির্ভর। শুধুমাত্র গােটা রাজ্যের ১৫ শতাংশ আয়তনের একটি ক্ষুদ্র অংশ আর কাশ্মীরের ৩৩ শতাংশ কাশ্মীরি ভাষাভাষীর মানুষের জন্যই ভুগতে হচ্ছে গােটা জম্মু এবং কাশ্মীরকে।
এই পরিপ্রেক্ষিতেই উঠে আসছে জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যকে বিভাজনের প্রশ্ন। যারা দীর্ঘদিন ধরে কাশ্মীর নামক জ্বলন্ত ইস্যুটিকে পর্যবেক্ষণ করছেন, তাঁরা জানেন, কিছু কাশ্মীরির পাপে বিদ্ধ হচ্ছেন জম্মু ও লাদাখের বিশাল জনগণ। জম্মু ও কাশ্মীরের যাবতীয় সুখ-সুবিধার প্রথম দাবিদার কাশ্মীর উপত্যকার কাশ্মীরিরা। তারা সস্তায় খাবার দাবার পাবেন, শিক্ষা পাবেন, বাসস্থান পাবেন, চাকরি পাবেন, ব্যবসা করবেন আবার ভারত বিদ্বেষী স্লোগান তুলে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকাও ওড়াবেন। ১৯৫১ সাল থেকেই এটাই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অন্যদিকে জম্মুর মানুষরা ভিখারীর মতাে হাত পেতে দাঁড়িয়ে থাকবে খুদ-কুঁড়াের আশায়। জম্মুর শিক্ষিত যুবকদের ভিনদেশে যেতে হবে চাকরি করতে। সরকারি চাকরি পাবে শুধুই কাশ্মীরিরা। জম্মুতে পর্যটন শিল্পের বিকাশ হয় না। কারণ কাশ্মীরের সন্ত্রাসবাদ। একই হাল লাদাখেও।
তিনটি এলাকার সংস্কৃতি আলাদা, ভাষা আলাদা, জনচরিত্র আলাদা। জীবনযাত্রা আলাদা। পরিবেশ ও রাজনীতি আলাদা। তাহলে কেন একটি উপত্যকার যাবতীয় সমস্যার মুখােমুখি হবে গােটা রাজ্য ?
জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যকে তিনটি পৃথক রাজ্যে বিভাজিত করা হলে সবচেয়ে বড়াে সুবিধা হবে সন্ত্রাসবাদের মােকাবিলার। কারণ তখন জম্মু এবং লাদাখের পৃথক সরকারি প্রশাসনের পক্ষে আলাদা আলাদা ভাবে সাহায্যের হাত বাড়ানাে সম্ভব হবে সামরিক বাহিনীর কাছে। কাশ্মীর উপত্যকার ওপর নজরদারিও সহজ হবে। বিদেশি অনুপ্রবেশও রােখা সহজ হবে।
কেন্দ্রীয় সরকার এই পদক্ষেপ নিলে, একথা জানাই যে গােটা দেশের রাজনৈতিক বিরােধী শক্তিগুলি রে রে করে উঠবে এবং জোরদার প্রচার শুরু হবে—কেন্দ্র বিভাজনের রাজনীতি করছে। মুসলমানদের একঘরে করতে চাইছে। তখন কিন্তু কোনাে বিরােধী শক্তিই বলবে না যে ওই মুসলমানরাই ভারতবর্ষের মাটিতে সাম্প্রদায়িকতার বীজ প্রােথিত করে পাকিস্তানকে ডেকে আনছে। তৈরি হচ্ছে সন্ত্রাসবাদের কারখানা। ভারতকে বাধ্য করছে যুদ্ধের পথে এগিয়ে যেতে। সমস্যাটা এখানেই। কারণ, ভারতবর্ষের একটি দুটি দল ছাড়া সমস্ত বিরােধী শক্তিরই মূল লক্ষ্য হলাে সাম্প্রদায়িকতার তাস হাতে নিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার রাজনীতিতে অংশ নেওয়া এবং দেশকে চরম সর্বনাশের পথে ঠেলে দেওয়া।
এব্যাপারে সবচেয়ে অগ্রগণ্য ভূমিকা যে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং শাসকদলের, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর পুলওয়ামা সন্ত্রাসের পরিপ্রেক্ষিতে দেওয়া কিছু মন্তব্যই প্রমাণ করে দেয়, তিনি মােদীর বিরােধিতা করতে গিয়ে দেশদ্রোহিতাকেই প্রশ্রয় দিচ্ছেন। বিদেশি শত্রুকে মান্যতা দিচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীকে কঠোর পদক্ষেপে নিতেই হবে। ভােটাভুটি, রাজনীতির কথা ভুলে দেশরক্ষার প্রধান দায়িত্ব নিতে হবে তাকেই। গােটা দেশবাসী তাকিয়ে আছে তাঁর দিকেই এক উপদ্রবহীন শান্তির ভারতবর্ষ গড়ে তুলতে, যে ভারত ভারতবাসী দেখেনি স্বাধীনতার পর থেকেই। যে ভারত ভারতবাসী দেখতে চায় দুচোখ মেলে।
সনাতন রায়