কলকাতা বা নোয়াখালির দাঙ্গা নিয়ে একশ্রেণীর দুর্বুদ্ধিজীবী মুখ খোলেন না বা এগুলোকে অত্যন্ত হালকা ভাবে দেখানোর চেষ্টা করেন । এই দাঙ্গার জন্য তাঁরা হিন্দু মুসলমান উভয়কেই দোষারোপ করেন । এক কাঠি উপরে উঠে অনেকে আবার শুধু হিন্দু সম্প্রদায়কেই এক তরফা দোষারোপ করেন। সত্য কথা বলতে কি , কলকাতা বা নোয়াখালিতে দাঙ্গা হয় নি, যা হয়েছে তা স্রেফ এক তরফা হিন্দু সংহারতার সঙ্গে আছে অবাধ ধর্ষন, লুঠপাট, নারীহরন, অগ্নি সংযোগ আর ধর্মান্তরকরনের উন্মাদ তান্ডবলীলা। সবই কিন্তু একপেশে।


কলকাতার প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস বা ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে র সূত্রপাত হয় ১৯৪৬ সালের ২৭-২৮ জুলাই, বোম্বেতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম প্রস্তাব গ্রহণ থেকে। এই ঘৃণ্য কাজের দিন ঠিক হয় ১৬ ই আগস্ট । এই সংগ্রাম কিন্তু ব্রিটিশ বিরোধী নয় , কারণ ব্রিটিশরা পাকিস্তান দিতে রাজি । এর লক্ষ্যস্থল স্থির হল কংগ্রেস তথা হিন্দুরা । তারাই পাকিস্তান দিতে গররাজি , অতএব হিন্দুদের উচিত শিক্ষা দিতে হবে।
মুসলিম লীগ নেতা জিন্না ঘোষণা করলেন আমাদের হাতে পিস্তল আছে আর তা ব্যবহার করার ক্ষমতাও আছে। বাংলার প্রাক্তন প্রধান মন্ত্রী এবং মুসলিম লীগের একজন নেতা খাজা নাজিমুদ্দিনও খোলাখুলিভাবে বলেন প্রত্যক্ষ সংগ্রাম মানে কি তা মুসলমানরা জানে। এই প্রত্যক্ষ সংগ্রাম কার্যকর করার স্থান হিসাবে নির্বাচন করা হ য় মূলতঃ কলকাতাকে। বাংলায় তখন মুসলিম লীগ শাসন চলছে, যার নেতৃত্বে আছেন হোসেন শহীদ সুরাবর্দী। মন্ত্রী হবার আগে থেকেই তিনি অনাকাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক চিন্তাধারা এবং বিপথগামী লোকজনের দ্বারা প্রভাবিত। সারা ভারতে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দেওয়া হ লেও কলকাতাকে মূখ্য কেন্দ্র করার চক্রান্ত অতি পরিষ্কার, এখানে র ক্ষকই ভক্ষকের ভূমিকা পালন করবে


প্রত্যক্ষ সংগ্রামের প্রস্তুতির স্থান হিসাবে নির্বাচন করা হয় মসজিদ গুলিকেযেখানে ঈশ্বরের আরাধনা হয় সেখান থেকেই পৈশাচিকতার ডাক দেওয়া হল। এটা কোন বৈপরীত্য নয় , বরং ইসলাম অনুমোদিত জেহাদ। রমজান মাস যেহেতু জেহাদের মাস সুতরাং প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দেওয়া হল রমজান মাসেই । দিকে দিকে জিগির উঠল নারায়ে তকদীর, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান, পাকিস্তান জিন্দাবাদ, আল্লাহু আকবর । বাংলায় কম্যুনিস্টরাও তখন পাকিস্তান দাবীর সমর্থক। কংগ্রেস মুস লমানদের তোষণে ব্যস্ত। হিন্দুদের নিরাপত্তা বলে তখন বাংলায় কিছু নেই । মুসল মানদের উত্তেজিত করবার জন্য মুসলিম সংবাদপত্রগুলি হিন্দুদের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী ভাষায় সম্পাদকীয় প্রবন্ধ লিখতে থাকে। প্রচুর হ্যান্ডবিল ও লিফলেট রাস্তার মোড়ে মোড়ে এবং মসজিদে মসজিদে বিতরণ করা হতে থাকে । প্রতিটিই হিংসাত্মক প্র রোচনায় পরিপূর্ণ । গুন্ডামি সফল করার জন্য অস্ত্রের আবশ্যক। বি টি রোডে দেখা গেল লাঠি ছোরা ও তরোয়াল ভর্তি লরি । মানিকতলায় ক্যানাল ওয়েস্ট রোডে অস্ত্র শস্ত্র ভর্তি ঠেলাগাড়ি দেখা গেছে । বেলগাছিয়া, রাজাবাজার, কলাবাগান বস্তি, ক্যানাল ওয়েস্ট রোড, ধর্মতলা , পার্ক সার্কাস, এন্টালি প্রভৃতি এলাকায় মুসলমানদের অস্ত্রে ধার দিতে দেখা গেছে। ১৬ তারিখ এবং তার পরে মুসলমানরা প্রচুর লরি কাজে লাগিয়েছিল এই সমস্ত লরির ইন্ধনের জন্য কলকাতার মেয়র ওসমান, প্রধানমন্ত্রী সুরাবর্দী প্রমূখ ঢালাও কুপন বিলি করে


১৫ই আগস্ট রাতে কলকাতা যখন নিদ্রামগ্ন তখন মসজিদে মসজিদে চলছিল ব্যস্ত কা র্যকলাপ ১৬ই আগস্ট মুসলিম লীগ হরতাল ডাকল আর লীগ গভর্নমেন্ট ছুটি ঘোষনা করল যাতে জেহাদীরা নিজ নিজ এলাকায় সক্রিয় হতে পারে। বেলগাছিয়া মু সলমান বস্তিকে কেন্দ্র করে বেলগাছিয়া অঞ্চলকে বিদ্ধস্ত করার পরিকল্পনা করা হল। রাজাবাজার অঞ্চলের মুসলমানদের অঞ্চল নির্দিষ্ট করা হল মানিকতলা থেকে শিয়াল দহ, বৌবাজার, কলেজ স্ট্রীট এলাকা। ধর্মতলা, তালতলা ওয়েলেসলী হয়ে পার্কসা র্কাসের দিকে অগ্রসর হল একটা দল।এমনি আরো অনেক। ১৬ তারিখের ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতে মুসলিম লীগের গুন্ডারা ও শান্তির ধর্মের জনগন ঝাঁপিয়ে পড়ল নিরস্ত্র, অসহায় , অসতর্ক ও বিচ্ছিন্ন হিন্দু জনগোষ্ঠীর উপর। খুন , জখম, ধ র্ষণ , অগ্নিসংযোগ ও লুঠপাটে মেতে ওঠে তারা


সেদিন লাল বাজার পুলিশ কন্ট্রোল রুম থেকে দাঙ্গা পরিচালনা ক রে সুরা ব র্দী, ওস্মান, লাল মিয়া প্রমুখ মুস লিম নেতারা। এই দাঙ্গায় যে বীভৎস হত্যালীলা চলে তার কিছু বিবরণ পাওয়া যায় Calcutta Disturbances commission of Enquiry-Record of proceedings এবং Transfer of power থেকে । ক্যানিং স্ট্রীটে হত্যাকান্ড ও বাসনের দোকান লুট হয় , ওয়েলেসলি এলাকায় লুটতরাজ হয়, কে সি বিশ্বাসের বন্দুকের দোকান লুট হয় , হিন্দু বস্তি ভস্মীভূত করা হয়, নারকেলডাঙ্গা গড়পার এলাকা ধ্বংস স্তুপে পরিণত হয়, ডেপুটি পুলিশ কমিশনারের বাড়ি আক্রমণ করা হয়, কসাই বস্তির গুন্ডারা হিন্দু বস্তিতে আগুন লাগিয়ে দেবদেবীদের মূর্তি নর্দমায় নিক্ষেপ করে। সুরাব র্দী গুন্ডাদের অভয় দেন, চব্বিশ ঘণ্টা সময় দিলাম, তোরা যা পারিস কর । নির্বি চারে ছোরা তরোয়াল ব্যবহারের ফলে যেখানে সেখানে হিন্দুদের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায় । বুদ্ধু ওস্তাগর লেনে একটি পরিবারের ২৫ জনকে হত্যা করা হয়। পুলিশ কয়েকজন হত্যাকারীকে গ্রেফতার করলেও তাদের সুরাবর্দীর নির্দেশে ছেড়ে দেওয়া হয় । শিয়ালদহ বৌবাজার এলাকায় স্লোগান দিয়ে তাণ্ডবলীলা চালানো হয় । পরিস্থিতি এমন হয় যে ঠেলাগাড়িতে করে হিন্দুদের মৃতদেহ অপসারণ করতে দেখা যায় । পা র্ক সার্কাস অঞ্চলে হিন্দুদের বাড়িতে লুটপাট ও নারী নির্যাতন চলে , পার্কসার্কাস কড়েয়া অঞ্চলে ব্যাপক হত্যা ও লুটতরাজ হয়। ভারত মিহির প্রেসে দুজন হিন্দুকে হত্যা ও একজন হিন্দু মহিলাকে ধর্ষণ করা হয়। টেরিটি বাজারে নির্বিচারে হিন্দু হত্যা করা হয় । সেখানে মৃতদেহের স্তূপ জমে ওঠে। দাঙ্গার দু দিন পরে পুলিশ মাত্র ১০০ গজ দূরের এই ঘটনার খবর পায় পচা গন্ধ মারফৎ। সুরাবর্দী তিন চার দিন যাবত কন্ট্রোল রুমে বসেছিলেন এবং পুলিশ কমিশনার যাতে কোন পদক্ষেপ না নেয় সেদিকে সতর্ক নজর রাখছিলেন। এর ফলে চারদিক থেকে হিন্দুদের প্রাণরক্ষার আর্ত আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিল তাদের কিছু করার নেই।


এই ভয়ঙ্কর দাঙ্গার পটভূমি হিসাবে দ্বিজাতি তত্ত্ব একটা বড় কারণ। এই তত্ত্ব বলেছিল মুসলমানরা সব দিক থেকেই হিন্দুদের থেকে ভিন্ন, কাজেই তাদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র চাই, এবং এর জন্য হিংসা জায়েজ। পৃথিবী জুড়ে ইসলামিক সন্ত্রাসের পিছনে সমর্থন র য়েছে তাদের ধর্মগ্রন্থের, এখানেও তাই । দ্বিতীয়তঃ, কম্যুনিস্টদের ভ্রান্ত ও স্বার্থগন্ধী প্রচার পদ্ধতিও একটা বড় কারণ এই দাঙ্গার । তারা মুসলমানদের বুঝিয়েছিল, একটা বড় অংশের হিন্দু কংগ্রেসের সমর্থক, কংগ্রেস দেশ বিভাগ চায় না , অতএব হিন্দুরা মুসলমানদের শত্রু। তারা তেভাগা আন্দোলন করে মুসলমান বর্গাদারদের হিন্দু জোতদারদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিল, তারা মুসলমান প্রজাদের হিন্দু জমিদারদের বিরু দ্ধে ক্ষিপ্ত করে তুলল। এই ভাবে পুরো হিন্দু সমাজকে তারা মুসলমানদের শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করে ফেলল। কম্যুনিস্টরা অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোন থেকে শ্রেণীশত্রু চিহ্নিত করেছে আর মুসলমানরা ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিতে তা গ্রহণ করেছে। ফলতঃ সব ধরণের হিন্দুই মুসলমানদের শ্রেণী শত্রু হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে । এর সঙ্গে ইন্ধন হিসাবে কাফের তত্ত্ব তো আছেই


হিন্দুদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে যেতে তারা অনুভব করল, তাদের পরিণতি আরও খারাপ হবে যদি তারা পূর্ণশক্তিতে প্রত্যাঘাত না হানে। এ ব্যাপারে তারা সাহায্য পেল গোপাল মুখার্জীর কাছ থেকে । হিন্দুরা অপ্রস্তুত অবস্থাটা সামলে নিয়ে পালটা আঘাত হানল এবং শৌর্যের পরিচয় রাখল। মুসলমানদের মার খেতে দেখে গভ র্ণর এফ বারোজ এইবার কর্তব্যের আহবান অনুভব করলেন আর দাঙ্গা প্রশমিত করতে সেনাদের ডাকলেন । কলকাতায় নিহত নারী, পুরুষ ও শিশুদের সংখ্যা প্রায় ১৫০০০ ছিল আর ১০০০০ এর ও বেশি মানুষ মারাত্মক ভাবে আহত ও পঙ্গু হয়ে ছিল। এক লক্ষের মত মানুষ কপর্দকহীন ও গৃহহীন হয়ে পড়েছিল। স্টেটসম্যান পত্রিকার এক সাংবাদিক কিম কার্স্টেন এই ঘটনাকে, বিশেষ অভিলিপ্সা ও সংগঠন চালিত মধ্যযুগীয় ভয়ানক প্রতিহিংসা আখ্যা দিয়েছিলেন।
আগস্টের শেষ সপ্তাহে লর্ড ওয়াভেল কলকাতা পরিদর্শনে আসেন।তাঁর সামনে বাংলার গভর্ণরের মূখ্যসচিব ও স্থানীয় সেনাধ্যক্ষ এই বীভৎস ঘটনায় সুরাবর্দীর অপরাধ প্রবণতা তুলে ধরেন। কলকাতার গনহত্যায় মুসলিম লীগের অনুমান ভুল প্রতিপন্ন হয় । তারা হিন্দুদের চোখ রাঙিয়ে বাগে আনতে ব্যর্থ হয় । পাকিস্তান তারা পেলেও নৈতিক ভাবে তারা পরাজিত হয়

অনিকেত গুপ্ত (Aniket Gupta)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.