দোকানে কসাই-কালীমূর্তি দেখে শ্রীরামকৃষ্ণ মাংস কিনতে বলেছেন। এমন ঝটকা মাংসের চাহিদা আজও প্রবল, কিন্তু ব্যবসায়ী নেই।
কল্যাণ গৌতম।
শ্রীরামকৃষ্ণ তখন কর্কট রোগাক্রান্ত; কাশীপুর বাগান-বাড়িতে অবস্থান করছেন। পার্ষদ কালীপ্রসাদ চন্দ (কালী মহারাজ, পরবর্তীকালে স্বামী অভেদানন্দ, বিদেশে শ্রীরামকৃষ্ণ-ভাবপ্রচারক ও শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠের প্রতিষ্ঠাতা) ঠাকুরের সেবক হিসাবে সেখানে রয়েছেন; রয়েছেন স্বামী বিবেকানন্দ সহ অন্যান্য গুরুভাই ও সহধর্মিণী সারদা দেবী। ঠাকুরের গলার ব্যথা বাড়ছে, তিনি অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছেন, ঠিকমতো পদচারণা করতে পারছেন না। চিকিৎসকেরা তাঁকে বলকারক পথ্য খেতে নির্দেশ দিয়েছেন, বলেছেন কচিপাঁঠার মাংসের স্যুপ খেতে হবে; তাহলেই শরীরে শক্তি পাওয়া যাবে। কালী মহারাজের লেখনী থেকে জানা যায়, শ্রীরামকৃষ্ণ সেবকদের বলছেন, “দ্যাখ্, তোরা যে দোকান থেকে পাঁঠার মাংস কিনে আনবি, দেখবি — সেখানে কষাই-কালীমূর্তি যদি না থাকে তাহলে মাংস কিনিস্ নি। যে দোকানে কষাই-কালীর প্রতিমা থাকবে সেই দোকান থেকে মাংস আনবি।” ভক্তেরা ঠাকুরের আদেশ শিরোধার্য করেছিলেন। হিন্দুর দোকান থেকেই মাংস এনে শ্রীমার কাছে প্রদান করেছেন। শ্রীমা সেই মাংস অনেক সময় ধরে সিদ্ধ করে, ছেঁকে কাথ্বটুকু ঠাকুরকে খেতে দিয়েছেন। তখন তাঁর শক্ত জিনিস গলাধঃকরণ করার সামর্থ্য ছিল না। অর্থাৎ দেখা যায়, হিন্দুর দোকানে বিক্রি হওয়া ঝটকা মাংসই তিনি গ্রহণ করেছেন।
হিন্দুদের মধ্যে পশুকে কষ্ট দিয়ে মারার রীতি কোনোদিনই ছিল না। বলি ব্যতিরেকেও এক ঝটকায় পশুহত্যা করে তার মাংসকেই খাদ্য হিসাবে সাত্ত্বিক মনে করেছেন। এই আচরণ তারা পালন করেছেন হাজার হাজার বছর। ভোল বদল হল অন্য ধর্মে বিশ্বাসী মানুষের জোর ইচ্ছায়। বাজারে ক্রমবর্ধমান ‘হালাল’ মাংসের ভীড়ে হিন্দু তার ধর্মীয় পছন্দের মাংসের যোগান পেলো না। এই নিয়ে প্রতিবাদ সংগঠিত হতেও দিল না সেকুলার-বামপন্থী ও বুদ্ধিজীবীর দল, সে এক রহস্যে ঘেরা ব্যবসা, মানুষ বাজারে চোখ পাতলেই বুঝতে পারবেন, বলার দরকার হবে না। কে কাকে সমর্থন করে, তা আর অজানা নেই কারো। তাই মাংস ব্যবসাতে ক্রমশঃ প্রান্তিক হয়ে পড়েছে হিন্দু বাঙালি। হাট-বাজারে বংশ পরাম্পরায় মাংসের আদি কারবারিরা নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছেন অনেক আগে থেকেই। ছেচল্লিশের ‘গোপাল পাঁঠা’-কে আজ শহরে, নগরে গঞ্জে খুঁজে পাওয়া যাবে না। হিন্দু ঝটকা মাংসের দোকান করতে চায় না — ভাবে যদি কাস্টমার দুই-একজন কমে যায়! হিন্দু দোকান করলেও বাইরে থেকে কসাই এনে পশু কাটায়। আর সেকুলার বাঙালি রান্নাগিন্নী আর কমরেডদের বুঝিয়েছে রেখেছে, ঝটকার তুলনায় অন্যভাবে কাটা মাংসেই পুষ্টিগুণ বেশি। হোস্টেল – রেস্টুরেন্টের মালিক বাইরে একসময় প্রকাশ্যে আড়াই প্যাঁচে মাংস কাটতে ডেকে এনেছে কসাই। হোস্টেল পড়ুয়ার ৯৮ শতাংশের কথা শোনা হয় নি। প্রতিবাদ করেছেন কেউ কেউ, ফল পান নি। তখন বাম-আমলের মধ্য-গগন। তাই মাংস খাওয়াই ছেড়েছেন বহু বিদ্বজ্জন বাঙালি। আজও সমীক্ষা করলেই তা ধরা পড়বে।
নিষ্ঠাবান বাঙালি, পশ্চিমবঙ্গের কয়েক কোটি মানুষ ঝটকা মাংসের যোগানই চান। কিন্তু রাজ্যে হালাল মাংসের রমরমা, তাই তাদের প্রত্যাশা কোনোদিনই মেটে না। কবে ‘বলির মহাপ্রসাদ’ জুটবে, তার জন্য অনন্ত প্রতীক্ষা! ঝটকা মাংস অর্থাৎ পাঁঠা বা খাসিকে কষ্ট না দিয়ে এক ঝটকায় পশুবধের যে হিন্দু ঘরানা, তার মধ্যেই আমিষ ভোজন করতে চান তারা। তাই দিকে দিকে বাজার-হাটগুলিতে যদি ঝটকা মাংসের দোকান দিতে সুঠাম-স্বাস্থ্যের অধিকারী বলিষ্ঠ হিন্দু এগিয়ে আসেন, নিঃসন্দেহে এর বাজার মূল্য মাসিক কয়েক শো কোটি টাকায় দাঁড়াবে, বেচাকেনার মূল্য আরও বাড়বে। ছাগলকে জৈবিক পদ্ধতিতে উৎপাদিত পশুখাদ্য ও বিষমুক্ত আগাছা পরিবেশন করে পালন করলে, তার চাহিদা আরও বাড়বে।
পশ্চিমবঙ্গে ছাগলের দেশীয় জাত ‘ব্ল্যাক বেঙ্গল গোট’ বা কালো ছাগল পালনের আগ্রহ বাড়ছে। যারা ‘আত্মনির্ভর ভারত’ গড়তে চান, তারা কী দিকে দিকে ঝটকা মাংসের ব্যবসায় বাঙালি হিন্দুকে উৎসাহিত করবেন; নাকি সার্টিফিকেটের নামে মাংস কাটার পয়সা জেহাদি হাতে ঘুরপাক খাওয়াবেন, দেখেও চোখ বন্ধ করে থাকবেন? বাঙালিকে তার নিজের পছন্দে সাত্ত্বিক আহার করতে দিন। বাজার পিছু অন্তত একটি ঝটকা মাংসের দোকান হয়ে যাক।
[ তথ্যসূত্র : আমার জীবন কথা (প্রথম ভাগ), স্বামী অভেদানন্দ, শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৯৬৪, ষষ্ঠ সংস্করণ ২০১৫, পৃষ্ঠা ৭৭]
লিখেছেনঃ শ্রী Shankar Mondal…