নকশাল, মাওবাদী মানে কী, পাঁচ বছরের ছোট্ট মেয়েটা বোঝে না৷ কিন্তু সে এটুকু বুঝেছে, নকশালরাই তার বাবাকে আটকে রেখেছে৷ ছত্তীসগড়ের বিজাপুরে মাওবাদী হামলার পর অপহৃত সিআরপিএফ জওয়ান রাকেশ্বর সিং মানহসের পাঁচ বছরের ‘ছোট্ট পরী’ এ দিন সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরার সামনে বাবাকে ফিরিয়ে দেওয়ার আবেদন করেছে৷ ছোট্ট মেয়েটির কান্নাভেজা গলার কথাগুলো যে কাউকে নাড়িয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট৷
রাঘবি নামে পাঁচ বছরের ওই শিশুকন্যা নকশাল কাকুদের উদ্দেশে বলেছে, ‘পাপার পরী পাপাকে খুব মিস করছে৷ আমি আমার বাবাকে খুব ভালবাসি৷ প্লিজ নকশাল আঙ্কেল, আমার বাবাকে বাড়ি পাঠিয়ে দাও!’
পাঁচ বছরের মেয়েটা যখন এই কথাগুলি বলছে, তার দু’ চোখ বেয়ে জলের ধারা নেমে আসছে৷ ছোট্ট মেয়েটার চোখে জল দেখে পরিবারের বাকিরাও কান্নায় ভেঙে পড়েছে৷ উপস্থিত সংবাদমাধ্যমের কর্মীদেরও হয়তো কারও কারও চোখের পাতা চিক চিক করে উঠেছে৷ কিন্তু যাদের উদ্দেশে তার এই আবেদন, তাদের মন কি ভিজবে?
শনিবার ছত্তীসগড়ের বিজাপুরে মাওবাদী হামলায় নিহত হন ২৩ জন সিআরপিএফ জওয়ান৷ এখনও খোঁজ নেই জম্মুর বাসিন্দা রাকেশ্বর সিং মানহসের৷ মনে করা হচ্ছে তাঁকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছে মাওবাদীরা৷ ফলে নিখোঁজ জওয়ানের বাড়ির আর সবার মতো ছোট্ট মেয়েটাও বাবার ফিরে আসার খবরের অপেক্ষায় রয়েছে৷ ওই নিখোঁজ জওয়ানের মেয়েই শুধু নয়, তাঁর ৭ বছর বয়সি ভাইপোও সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের কাছে তার কাকুর খোঁজ জানতে চেয়েছে৷
এই দুঃসংবাদ আসার পরই রাকেশ্বরের বাড়িতে চলে এসেছেন তাঁর আত্মীয়রা৷ চিন্তায় ঘুম উড়েছে প্রত্যেকের৷ আগামী ১৫ এপ্রিলই পারিবারিক একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বাড়িতে আসার কথা ছিল নিখোঁজ জওয়ানের৷
রাকেশ্বর নামে ওই জওয়ানের স্ত্রী মিনু বলেন, ‘পাঁচ দিন আগে ফোনে আমার স্বামীর সঙ্গে কথা হয়৷ উনি জানিয়েছিলেন একটা অভিযানে যাচ্ছেন, ফিরে এসে ফোন করবেন৷ যখন টেলিভিশনে এই হামলার খবর জানতে পারলাম, দুশ্চিন্তায় বার বার ওকে ফোন করছিলাম৷ কিন্তু কোনও সাড়া পাইনি৷’
স্বামীকে ফোনে না পেয়ে তাঁর এক সহকর্মীকে ফোন করেন মিনু৷ তিনি তখন জানান, রাকেশ্বর অভিযানে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছেন৷ মিনুর দাবি, এর পর সোমবার বিকেলে বিজাপুর থেকে স্থানীয় সাংবাদিক বলে পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তি তাঁকে ফোন করেন৷ ওই ব্যক্তি রাকেশ্বরের স্ত্রীকে বলেন, তিনি যেন তাঁর স্বামীকে মুক্তি দেওয়ার জন্য আবেদন জানিয়ে মাওবাদীদের কাছে ভিডিও বার্তার মাধ্যমে অনুরোধ করেন৷
মিনু বলেন, ‘ওই ব্যক্তি আমাকে বলেন যে আমার স্বামীকে মাওবাদীরা অপহরণ করেছে এবং আমি যেন ভিডিও রেকর্ড করে তাঁকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করি৷ আমি ভিডিও রেকর্ড করে ওই ব্যক্তিকে পাঠিয়েও দিয়েছি৷ কিন্তু বিজাপুরে থাকা কেউ কী ভাবে আমার ফোন নম্বর পেলেন, এটা আমি বুঝতে পারছি না৷ এই বিষয়টির তদন্ত হওয়া উচিত৷’
মিনু আশাবাদী, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ তাঁর স্বামীকে নিরাপদে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করবেন৷ তাঁর কথায়, ‘পাকিস্তান থেকে উইং কম্যান্ডার অভিনন্দন বর্তমানকে নিরাপদে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী৷ আমি আশাবাদী আমার স্বামীকেও নিরাপদে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করবেন তিনি৷’ মিনু অবশ্য জানিয়েছেন, তাঁর মেয়ে এখনও পুরোপুরি বুঝতে পারছে না ঠিক কী হয়েছে৷ কিন্তু বাবার জন্য আশঙ্কায় একটানা কেঁদে চলেছে সে৷ মিনু বলেন, ‘ঠিক কী হয়েছে সেটা তো ওর পক্ষে বোঝা কঠিন৷ কিন্তু এত মানুষ বাড়িতে এসে কান্নাকাটি করছে দেখে ও সমানে কেঁদে চলেছে আর প্রত্যেককে অনুরোধ করছে যাতে ওর বাবাকে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হয়৷’
নিখোঁজ জওয়ানের ৭৫ বছর বয়সি মা-ও আশাবাদী, মাওবাদীদের সঙ্গে কথা বলে তাঁর ছেলেকে নিরাপদে ফেরানোর ব্যবস্থা করবে সরকার৷ সন্তানের জন্য চিন্তায় কাতর বৃদ্ধা বলেন, ‘আমার স্বামীও সিআরপিএফ-এ ছিলেন৷ তিনি দেশের জন্য শহিদ হয়েছিলেন৷ আমরা আশাবাদী আমার ছেলেকে ফিরিয়ে আনার জন্য সরকার চেষ্টার ত্রুটি রাখবে না৷’
সিআরপিএফ-এর তরফে নিখোঁজ জওয়ানদের নিরাপদে ফিরিয়ে আনার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে৷ কেন্দ্রীয় সরকারও নিখোঁজ জওয়ানদের ফেরাতে সবরকম চেষ্টা করবে বলে দাবি করা হয়েছে৷
জম্মুতে সিআরপিএফ-এর সদর দফতরের কম্যান্ড্যান্ট পি সি গুপ্তা নিখোঁজ জওয়ানের পরিবারের সঙ্গে দেখা করে বলেন, ‘আমি এখানে এসে নিখোঁজ জওয়ানের পরিবারকে আশ্বস্ত করেছি যে আমরা এবং কেন্দ্রীয় সরকার তাঁদের পাশেই রয়েছি৷ আমরা আমাদের সাহসী জওয়ানদের এই অভিযানে হারিয়েছি৷ তবে আমরা এই পরিবারকে আশ্বস্ত করছি যে তাঁরা তাঁদের ছেলেকে ফিরে পাবে৷’