এদিন বিকেলে একটি টেলি কনফারেন্সের আয়োজন করে ‘উত্তর ২৪ পরগণা (North 24 Parganas) দত্তপন্থ ঠেংড়ী জন্মশতবর্ষিকী উৎযাপন সমিতি’৷ তাতে মুখ্য বক্তা ছিলেন স্বদেশী জাগরণ মঞ্চের সর্বভারতীয় কার্যকর্তা শ্রী সরোজ মিত্র। সরোজ বাবু বলেন, অসম্ভব দূরদৃষ্টি ছিল ঠেংড়ীজীর, ১৯৬৮ সালেই ভাবতে পেরেছিলেন কমিউনিজম ভারতবর্ষে ভবিষ্যতে আর কাজে আসবে না। রাজ্যসভায় এবং একবার সঞ্জীব রেড্ডির সামনে বলেছিলেন, Communism is in reverse gear in Russia. ভারতবর্ষে তার প্রাসঙ্গিকতা শেষ হওয়া কেবল সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু দেখা গেলো, তার পরেও পশ্চিমবঙ্গে (West Bengal) সিপিএমের (CPM) নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এসেছে। পুরনো কথা স্মরণ করিয়ে দিলে বলতেন, ক্ষমতায় আসা আলাদা জিনিস। সিপিএম একটা বিনা-কমিউনিজমের দল। ২০০৪ সালে ১৪ ই অক্টোবর তাঁর দেহাবসান হয়। সিপিএম-এর জামানা সমাপ্তি দেখে যেতে পারেন নি তিনি।
ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘকে তৈরি করে ভবিষ্যৎ ৫০ বছরের রসদ দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। ১৯৫৫ সালে এই সংগঠন (বিএমএস) গড়ে তোলেন। একটি মানুষের একটি সংগঠন গড়ে তুলতেই সারা জীবন লেগে যায়, কিন্তু তিনি একের পর এক সংগঠন তৈরি করতে লাগলেন। যেন এক অদ্ভুত সাংগঠনিক-ব্যক্তিত্বের পরাকাষ্ঠা! শুধু ভারতবর্ষ কেন, সারা বিশ্বে এমন নেতৃত্ব দেবার লোক খুঁজে পাওয়া মুস্কিল। তাঁর লক্ষ্যটা ছিল অন্য জায়গায়, গঠন করতে করতেই তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন তাঁর লক্ষ্যের অভিমুখে। কী সেই লক্ষ্য? তা হল Total Renaissance, সম্পূর্ণ রেনেসাঁস; জয়প্রকাশ নারায়ণের মতো ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ বিপ্লব (Total Revolution) নয়।
১৯৭৫ সালের ২৬ শে জুন জরুরি অবস্থা জারী হয়। জয়প্রকাশ নারায়ণ, মুরাজ্জী দেশাই প্রমুখ বিরোধী নেতাকে গ্রেপ্তার করা হল। নানাজী দেশমুখ ‘লোকসংঘর্ষ সমিতি‘-র নেতৃত্ব দিলেন, তাঁকেও গ্রেপ্তার করা হলে নেতৃত্ব দেবার অনুরোধ এলো ঠেংড়ীজীর কাছে। তিনি তখন ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘের জেনারেল সেক্রেটারি। ১৯৭৫ সালের ৯ ই সেপ্টেম্বর ঠেংড়ীজী কটক থেকে সরোজ মিত্রকে ডেকে পাঠিয়েছেন। কলকাতার সেন্ট্রাল এভিনিউ-এর একটি বিল্ডিং-এ বৈঠক হচ্ছে। চেনাই যাচ্ছে না ঠেংড়ীজীকে, এমন ছদ্মবেশ নিয়েছেন তিনি। সরোজ বাবুর পাশেই বসে আছেন, সরোজ বাবু চিনতে পারেন নি প্রথমে। ওই সভায় সার্বিক হতাশা ঝরে পড়লো — আর কিছু করার নেই জরুরি অবস্থায়; সিপিএম পালিয়ে গেছে; ইন্দিরা এক এক করে সকল নেতাকে জেলে ঢোকাচ্ছেন; বিরোধী দলগুলির কাজ থমকে আছে; অথচ ইন্দিরার সভায় হাজার হাজার মানুষের জমায়েত হচ্ছে। গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ হয়েছে, এভাবে কাজ হবে কী করে? শান্তকণ্ঠে ঠেংড়ীজী বললেন, এই অবস্থা থাকবে না। ১৭ মাস পরেই ইন্দিরার শাসন খতম হয়ে যাবে। সরোজ বাবু বিনীতভাবে জানতে চাইলেন, আপনি কি কোনো জ্যোতিষীর মতামত দিচ্ছেন? এইরকম মাস গুণে বলা যায়? ঠেংড়ীজী বললেন, ইন্দিরা গান্ধী এইভাবে প্রশাসন চালাতে পারবেন না, কারণ ওনার ডিক্টেটর হবার যোগ্যতাও নেই। এত বড় দেশে জরুরি অবস্থা দীর্ঘদিন জারী রেখে নিজের ভাবমূর্তি ধরে রাখা ওনার কম্ম নয়; তার জন্য যোগ্যতা লাগে। এরপর ঘটনাচক্রে সরোজ মিত্রও জেলে গেলেন। ছাড়া পেলেন যখন, মিলিয়ে দেখলেন, ১৭ মাস।
সঙ্ঘবিচার ধারার রাজনৈতিক দল জনসঙ্ঘকে জনতা পার্টিতে মিশিয়ে দেওয়া হল। এই দল পরবর্তী নির্বাচনে ইন্দিরা কংগ্রেসকে পর্যুদস্ত করলো। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সমস্ত পার্টিকে একত্রিত করার কাজে সক্রিয় হয়ে ইন্দিরাকে হারানো পর্যন্ত থাকলেন তিনি, তারপর বেরিয়ে এলেন। কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব নেবার, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকের পদ পাবার মোহ তাঁর ছিল না। পদ্মভূষণ, অন্য অসামরিক পুরস্কারও ফিরিয়ে দিতে পারেন অনায়াসে। এমনই উচ্চকোটির মানুষ ছিলেন তিনি। বিনয়ের সঙ্গে বলতেন, আমার কাজ শেষ হয়ে গেছে; এবার আমি মুক্ত। বিএমএস প্রেসিডেন্ট নরেশ গাঙ্গুলীর অনুরোধে তার দায়িত্বও নিলেন না। সেই পত্রবাহকের কাজ করেছিলেন সরোজ মিত্র। সরোজ বাবুকেই তিনি বললেন চিঠিটি খুলে, পড়ে শোনাতে। ইতস্তত করছেন সরোজ বাবু; ঠেংড়ীজী বললেন, আরে খোলো, নরেশ বাবুর চিঠিতে এটাই লেখা আছে।
ঠেংড়ীজী দৈনিক ব্যবহার লিপিবদ্ধ না হলেও তা ছিল চমকপ্রদ। ৫৭, সাউথ এভিনিউ; নিউদিল্লীতে রয়েছেন। মে মাসের রোদ্দুর, দুপুর দু’টো। গেঞ্জি-লুঙ্গি পড়ে সরোজ বাবুকে সঙ্গে নিয়ে ওই দুপুরে চক্কর কাটছেন ঝুপড়িতে ঝুপড়িতে। কেন? প্রিয় এক মুচির সঙ্গে দেখা করে যাবেন, প্রিয় ধোপা যে ওখানেই থাকেন, তার সঙ্গে দেখা করা চাই। দিল্লিতে এলে তাদের সঙ্গে দেখা না হলে কষ্ট পেতেন। এক ঘন্টা রোদে রোদে চরকি কেটে দুজনে এক গ্লাস লস্যি খেয়ে ফিরে এলেন, তারপর সরোজ বাবুকে বললেন, স্টেশনে নিয়ে চলো, নাগপুর যাবো। এমন ব্যক্তিগত জীবন ভাবা যায় না!
একবার দিল্লিতে রয়েছেন ঠেংড়ীজী। ১০-১২ জন দর্শনার্থী, সবাই প্রবুদ্ধ মানুষ। এদের মধ্যে রয়েছেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন অধ্যাপকও। তিনি এসে সরোজ বাবুকে বলছেন, ঠেংড়ীজীকে একটি থিসিস দেখতে দিয়েছি মতামতের জন্য। ঘটনার কথা স্মরণ করে সরোজ বাবু স্তম্ভিত হয়ে যান। থিসিসের টাইটেল “Dialectical materialism versus Anasakta Yoga” কতটা দূরদৃষ্টি থাকলে তাঁকে এই থিসিসের জন্য মত নিতে আসেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক! আর কত কী বিষয়ে গভীর জ্ঞান ছিল তার — ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট দলের প্রতিষ্ঠাতা মানবেন্দ্রনাথ রায়ের মতাদর্শ থেকে দীনদয়াল উপাধ্যায়ের একাত্ম মানব দর্শন সব বিষয়েই তাঁর পড়াশোনা ছিল।
ঠেংড়ীজীর ব্যক্তিত্বের পুরোটা কেউ জেনে উঠতে পারেন নি। বলা হয়, একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের Time Horizon ৫ বছর, একজন দেশনেতা বা স্টেটসম্যানের Time Horizon ১০ বছর, কিন্তু একজন সাধুসন্তের Time Horizon ১০০ বছর। রাষ্ট্রঋষি দত্তপন্থ ঠেংড়ীজীর প্রাসঙ্গিকতা ১০০ বছরেও অম্লান। তাঁর জন্মশতবর্ষে আমরা স্মরণ করতে পারি, ১৯৮২ সালে নাগপুরের সঙ্ঘ অধিবেশনে তাঁর ভবিষ্যৎ বাণী, আগামী শতাব্দী (২০০০ সাল থেকে পরবর্তী ১০০ বছর ও তারপরেও) হবে হিন্দু-শতাব্দী। পৃথিবীর জ্ঞানীগুণী মানুষের জ্ঞানভাণ্ডার শেষ সীমায় উপনীত হয়েছে, আর নতুন লক্ষ্যে পৌঁছাচ্ছে না, এগোচ্ছে না, একটি স্থবিরতা যেন পেয়ে বসেছে; তাই এখন সমগ্র বিশ্ব ভারতীয় বেদ-দর্শনের মধ্যে নতুন আশার সন্ধানে মনোনিবেশ করেছে। বিশ্বজুড়ে ভারততত্ত্ব এক অভূতপূর্ব অধ্যয়ন।
সমস্ত সংগঠন রচনার মধ্যে যে একটা বৃহৎ লক্ষ্য স্থির করে এগোতে হয়, তা কর্মজীবন ও দর্শনের মধ্যে দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন ঠেংড়ীজী। শ্রমিক সংগঠন ও তার রাজনীতির পরত কেমন হবে, তার একটি উদাহরণ দিয়ে দত্তপন্থজীর আন্দোলনের রূপরেখা দেখিয়েছেন সরোজ বাবু। ১৯৬৯ সালে ভাইস প্রেসিডেন্ট ভি ভি গিরি-র কাছে ট্রেড ইউনিয়নের পক্ষে মেমোরেন্ডাম দিচ্ছেন, তাতে রাজ্যসভা ভেঙ্গে দিয়ে Functional Representation করতে দাবী জানাচ্ছেন। রাজ্যসভায় সমস্ত বিষয়ের প্রতিনিধি-স্থানীয় ব্যক্তিত্বকে পাঠাতে হবে, ছিল দাবী। রাজ্যসভা হবে ভারতের একটি এক্সপার্ট গ্রুপ। আজকের শ্রমিক সংগঠনগুলি এসব ভাবনা ভাবতেও পারে না!
স্বদেশী জাগরণ মঞ্চ যখন গঠন করলেন বিদেশী পূঁজিপতিদের প্রতি একটি পরিস্কার বার্তা দিয়ে রাখলেন। তিনি বুঝেছিলেন বিশ্বের যা কিছু রিসোর্স, আমেরিকাকে বাদ দিয়ে, তা প্রায় সবই রয়েছে সাউথ-এ। আর ক্যাপিট্যাল যা আছে তা নর্থ-এ। যে দেশ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ, তা কেন পরমুখাপেক্ষী হবে? বিকল্প অর্থনীতির কথা এবং মার্গদর্শন করিয়ে তিনি লিখলেন ‘Third Way’ গ্রন্থ। Preface of Hindu Economics -এ তিনি পরিস্কার উল্লেখ করলেন, দেশের অর্থনীতি কোন দিকে যাওয়া দরকার, Sustainable Development বা চিরায়ত উন্নয়ন কোন পথে তা বুঝিয়ে দিলেন। Self-employment System -এর পক্ষে তিনি সওয়াল করেছেন, যা নেহেরু জামানায় রাশিয়াকে নকল করতে গিয়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আগে ভারতবর্ষের গ্রামগুলি সমস্ত পেশার মানুষের বসবাসে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল; নাপিত, ছুতোর, মুচি, তন্তুবায়, কামার, কুমোর, স্যাঁকরা সবাই থাকতেন এক গ্রামে। দত্তপন্থজী মনে করতেন, দরকার ছিল স্বাধীন ভারতে এদের সকলকে Skill Development করিয়ে দেওয়া এবং মার্কেটিং-এর ব্যবস্থা করা; তা না করে নেহেরু রুশ মডেলে ITI গড়ে তুলে কিছু আধা কারিগর বানিয়ে শিল্পের জন্য নতুন ভারত গড়তে চাইলেন। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই স্বয়ং-সম্পূর্ণ কাঠামো ভেঙ্গে পড়লো, কারিগর সমাজ নষ্ট হয়ে গেল। শিল্পকারখানায় কাজের লোভে সামান্য ট্রেনিং নিয়ে ছাত্রেরা ছুটলো মাসকাবারি চাকরি করতে। কলের সস্তা জিনিস বাজারে এলো, গ্রামে কামারের জিনিস, কুমোরের জিনিস আর বিকোলো না। ঠেংড়ীজী বলতেন, দেশীয় জিনিস যদি সামান্য নিম্নমানেরও হয়, তাই পরম আদরে ব্যবহার করা দরকার, স্বদেশী আন্দোলনের সময় ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়’-ই তো মাথায় তুলে নিয়েছিল দেশবাসী! এসব স্বদেশী চিন্তাচেতনার প্রয়োজন আজ এসে পড়েছে। বাড়িতে বাড়িতে কেন ফলের গাছ লাগানো হবে না? উদ্ভিজ্জ নানান সামগ্রী নির্মাণের জন্য গাছ লাগাতেই হবে। সরোজ বাবু রাষ্ট্রঋষি ঠেংড়ীজীর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন, আর্থিকক্ষেত্রে দেখতে হবে অঞ্চলে অঞ্চলে সমীক্ষা করে কী করা যায়! কতটুকু আছে সেই অঞ্চলে, কতটুকু নেই, কতটুকু ছাড়াই দৈনন্দিন জীবন চলে যায়, কতটুকু সেই অঞ্চলেই উৎপাদন করে নেওয়া যায় ইত্যাদি। যেমন সাবানের পাউডার উৎপাদনের জন্য তো আহামরি হাই-টেকনোজলির দরকার নেই, এরজন্য মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানি সাবান কেন কিনবো? বাইরে থেকে যা আসছে, তার মধ্যে করোনা নেই, অন্য রোগজীবাণু মুক্ত কে তার গ্যারান্টি দেবে? সরোজ বাবু রাখঢাক না রেখেই বলেছেন, ইকোনোমিকসের ওই প্রফেসরদের দিয়ে কিছু হবে না; ওইসব নোবেলবিজয়ী দিয়েও হবে না। দেশীয় আর্থিক চিন্তন নষ্ট করে দিয়ে কৃত্রিম উন্নয়ন কোনো কাজের কথা নয়!
ঠেংড়ীজীর ‘কার্যকর্তা‘ নির্মাণ সম্পর্কিত বই আমাদের সকলের পড়া দরকার। এটি যেকোনো সংগঠনের জন্যই প্রযোজ্য। ব্যক্তিত্ব নির্মাণের জন্য পড়া উচিত, কীভাবে কাজ করতে হবে, তার দিশা দেখিয়েছেন তিনি। এমন দুর্লভ সংগঠক পৃথিবীতে বিরল।
( দেশের মাটি-র অধীনস্থ গ্রুপগুলির জন্য পরিবেশিত প্রতিবেদন, ১২ ই মে, ২০২০)
ড. কল্যাণ চক্রবর্তীর (Dr. Kalyan Chakraborty) প্রতিবেদন, ১১ ই মে, ২০২০।