“জ্যেষ্ঠ শুক্লা ত্রয়োদশী” তিথি ভারতীয় ইতিহাসে্র এক গৌরবময় দিন। আজকের এই তিথিতেই (এ বছর অবশ্য আষাঢ় মাসের ৮ তারিখ ইং ২৩ শে জুন, বুধবার) ১৬৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ৬ই জুন রায়গড়ে পন্ডিত গাগা ভট্টের পৌরহিত্যে, পবিত্র নদী ,সমুদ্রের জল বর্ষণ ও বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণের মাধ্যমে মহাসমারোহে শিবাজী মহারাজের রাজ্য অভিষেক হয় । ইতিহাসের কালখণ্ডে শিবাজী মহারাজের আবির্ভাব এমন এক সময়ে যখন মুঘল অপশাসনে, বিশেষতঃ ঔরঙ্গজেবের নৃশংস অত্যাচারে হিন্দু সমাজ প্রবলভাবে ভীত-সন্ত্রস্ত,অসহায় ও বিপর্যস্ত । ভারতীয় ইতিহাসের সে এক করুণ কালা অধ্যায় ,যখন ,অপমানজনক জিজিয়া কর অথবা স্বধর্ম ত্যাগ এই দুইটির মধ্যে একটিকে বেছে নিয়ে হিন্দু সমাজকে বেঁচে থাকতে হচ্ছে I চলছে ব্যপকহারে মন্দির ধ্বংস, এমনকি রাজপুত রাজগনও মুঘল সম্রাটের বশ্যতা স্বীকার করে অথবা আপন কন্যা সম্প্রদানের মাধ্যমে নিজেদের ধন্য বলে মনে করছেন । এমনই এক অস্থির, সংকটময় সময়ে ,হতাশাগ্রস্ত ,ভীত ,অসংগঠিত হিন্দু সমাজকে সুসংগঠিত করে রাষ্ট্রীয় স্বাভিমান জাগিয়ে, শিবাজী স্থাপন করলেন স্বাধীন হিন্দু সাম্রাজ্য ,যা তার মৃত্যুর পরও শতবর্ষ স্থায়ী হয়েছিল।
ভারতীয় ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে ভারতবর্ষই বিশ্বের একমাত্র দেশ ,যে বারবার বিদেশী আক্রমণকারী দ্বারা আক্রান্ত , লুণ্ঠিত ও শাসিত হয়েছে ।বিশ্বকবির ভাষায় “শক হূন দল পাঠান মোগল…”পরবর্তীকালের ইংরেজ, ফরাসি,পর্তুগিজ সকলেই বিভিন্ন সময়ে ভারতের কোন না কোন অংশ শাসন করেছে,আর তার সাথে চালিয়েছে অবাধ সম্পদ লুণ্ঠন । আর আশ্চর্যের বিষয় এই যে , হিন্দু সমাজ এদেশে সংখ্যা গরিষ্ঠ হয়েও সেই আক্রমণকারীরই পদানত থেকে, ,নিজ সম্পদ লুণ্ঠন কেই নিজ-ভবিতব্য বলে মেনে নিয়েছে I এর মূলে ছিল পারস্পরিক অনৈক্য,বিচ্ছিন্নতা, আর অবিশ্বাস ।অথচ শিবাজীর বহু-বহুপূর্বে একাধিক হিন্দু রাজা যেমন চন্দ্রগুপ্ত ,অশোক প্রমুখেরা ভারতবর্ষের বৃহৎ অংশ ঐক্যবদ্ধ করে, ভারতীয় সাম্রাজ্য বালুচিস্তান্ আফগানিস্থান (তৎকালীন গান্ধার) পর্যন্ত প্রসারিত করে গিয়েছিলেন।বিশেষ করে পুষ্যমিত্র ,গুপ্ত সম্রাট গণ বিস্তীর্ণ ভারত ভূভাগ কে আরও সংঘবদ্ধ করে ভারতীয় শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি কে তুলনাহীন ,অসামান্য উচ্চতায় নিয়ে যান। এটা দেখা গিয়েছে যে গ্রিক ,শক্,হূণ আক্রমণ ভয়াবহ হলেও তাদের জীবন পদ্ধতি তারা কখনোই ভারতীয় হিন্দু সমাজের উপর চাপিয়ে দেয়নি ,বরঞ্চ কালের স্রোতে ভারতীয় সমাজ জীবনেই “এক দেহে লীন হয়ে হিন্দু সংস্কৃতি কে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছে।
কিন্ত গোল বাঁধলো পাঠান, মোগলদের নিয়ে। তারা ভারতের বাইরে থেকে এল , আর এসেই ,ভারতীয়দেরই ওপর নৃশংস অত্যাচার শুরু করলI ধ্বংস হতে থাকল সনাতন হিন্দু সভ্যতার শ্রদ্ধা কেন্দ্রগুলি। একের পর এক ভস্মীভূত হল দুর্মূল্য পুস্তক সমৃদ্ধ অসংখ্য গ্রন্থাগার I পাশাপাশি তারা জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল তাদের জীবন পদ্ধতিকে । আর এক দেহে লীন হওয়া তো দূর ,তাদের পরবর্তী বংশধরেরা ভারতবর্ষ কে খণ্ড খন্ড করে আফগানিস্তান্,পাকিস্তান, বাংলাদেশ বুঝে নিলI
আর এখানেই শিবাজী মহারাজের অসামান্য কৃতিত্ব।একধারে বিজাপুর ,অপরদিকে গোলকুণ্ডা,সর্বোপরি মহাশক্তিশালী নৃশংস মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব, চতুর্দিক ইসলামিক শাসন পরিবেষ্টিত । এই প্রবল বিপরীত পরিস্থিতিতেও শিবাজী তাঁর অসামান্য সমর দক্ষতা্ ,বুদ্ধিমত্তা আর সাহসের মাধ্যমে, অসংগঠিত,ছন্নছাড়া হিন্দু সমাজকে সুসংগঠিত করে, নিজ ভুমি পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে স্থাপন করলেন স্বাধীন হিন্দু সাম্রাজ্যের । সমাজে অবহেলিত মাওয়ালিদের মধ্যে সঞ্চারিত করলেন স্বাধীনতার বীজমন্ত্র I নিজস্ব সেনাবাহিনী ,অষ্টপ্রধান মন্ত্রিপরিষ্দ, নিজস্ব নৌবহ্র ,ব্যবস্থিত আইন, সুবিন্যস্ত কর ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রকৃত অর্থেই প্রবল প্রতাপশালী মোগল সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে স্বাধীন, স্বাভিমানী হিন্দু রাষ্ট্রের পুনর্জন্ম ঘটলI
আশ্চর্য হতে হয়, মূলতঃ ইসলামিক শাসন থেকে পুনরুদ্ধার করে হিন্দু সাম্রাজ্য স্থাপন করলেও শিবাজী মহারাজ কখনোই ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক ছিলেন না ।মাতা জিজাবাঈএর মাধ্যমে সংস্কারিত, মাতৃভক্ত শিবাজী ,নারী জাতির প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধা্শীল ছিলেনI দাদাজী কোন্ডদেবের শিক্ষায় শিক্ষিত,সনাতন আদর্শে দীক্ষিত্,সমর্থ গুরু রামদাস এর শিষ্য শিবাজী কখনই পরধর্মের শ্রদ্ধা কেন্দ্রে আঘাত হানেন নি । মুসলিম নারী ,শিশুর প্রতি আশ্চর্য উদারতা দেখিয়েছেন ।যুদ্ধক্ষেত্রে কোরান কুড়িয়ে পেলে ও ধর্মপ্রাণ মুসলিম কে তা অর্পণ করেছেন।একবার এক দলপতি, যুদ্ধে সংগৃহীত অসামান্য রূপসী এক মুসলিম মহিলাকে উপহার হিসেবে শিবাজীর সামনে উপস্থিত করলে, শিবাজী তাকে মা সম্মোধন করে ,ক্ষমা চেয়ে, সসম্মানে ফেরত পাঠিয়ে দেন ।মসজিদের ব্যয় নির্বাহের জন্য শিবাজী বহু নিষ্কর জমি দান করেছেন। সমসাময়িক হিন্দু ধর্ম বিদ্বেষী ধর্মান্ধ ঔরঙ্গজেব এর সাথে এখানেই শিবাজীর আসমান-জমিন পার্থক্য,এমন কি হিন্দু বিদ্বেষী কাফি খানকেও তা স্বীকার করতে হয়েছে ।
উদার, মহানুভ্ পরধর্ম সহিষ্ণু ,ধর্মমত নির্বিশেষে প্রজা কল্যাণকারী সাম্রাজ্যের স্থপতি হওয়া সত্ত্বেও ,একশ্রেণীর ঐতিহাসিক নাগাড়ে শিবাজী কে দস্যু নেতা হিসেবে অভিহিত করেছেন।বিদেশী ভিন্সেন্ট স্মিথ প্রমুখরা তো বটেই এদেশেরও একশ্রেণীর চাটুকার তথাকথিত ঐতিহাসিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে শিবাজী মহারাজ কে কালিমালিপ্ত করার অপচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। স্যার যদুনাথ সরকারই প্রথম অক্লান্ত গবেষণা করে, মহান শিবাজী কে বিশ্বের দরবারে সসম্মানে উপস্থাপন করলেন । তুলনা করে দেখালেন ,শিবাজী যদি লুটেরা হন তাহলে,নেপোলিয়নও লুটেরা ছিলেন।
আজও ভিয়েতনামে গেরিলা যুদ্ধের স্রষ্টা হিসেবে শিবাজী কে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়। স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনা্থ, নেতাজি্,বালগঙ্গাধর তিলক, ভগিনী নিবেদিতা প্রমুখ সকলেই শিবাজীর মহান জীবন থেকে প্রেরণা লাভ করেছিলেন ।রাষ্ট্রীয় স্বাভিমান নির্মাণে বাল গঙ্গাধর তিলক প্রচলন করেছিলেন ” শিবাজী উৎসব” ।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন ” শিবাজী উৎসব” কবিতা,যেখানে কবিগুরু শিবাজীর র সঙ্কল্প ব্যক্ত করলেন এই ভাবে “এক ধর্মরাজ্য পাশে খন্ড ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ভারত বেঁধে দেব আমি” ।
বীর শিবাজীর জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা, তিনি নিজ বুদ্ধিবল ,সাংগঠনিক শক্তি , সমর দক্ষতার মাধ্যমে স্বাধীন হিন্দু রাষ্ট্রের নির্মাণ করলেও, সেই রাষ্ট্র কিন্ত এক লহমায় গুরু রামদাস কে অর্পণ করে ,নিজে ভিক্ষাবৃত্তি বেছে নিয়েছিলেন । যদিও গুরু- নির্দেশে ভিক্ষাবৃত্তি ত্যাগ করে, ” বৈরাগীর গৈরিক উত্তরীয়” তলে বিশাল হিন্দু সাম্রাজ্য সুনামের সাথে শাসন করেন । .মাত্র 50 মতান্তরে 52 বছরে মৃত্যু না হলে ভারতের ইতিহাস হয়তো অন্যরকম হত। তাঁর শাসন নীতি আজও সমান প্রাসংগিকI যদি তার নীতিসমূহ কে সময়োপযোগী অনুকরণ এর মাধ্যমে, পূর্ণ উৎসাহের সাথে সমাজ জীবনে প্রয়োগ করা যায় ,তবে ভারতবর্ষ অবশ্যই শ্রেষ্ঠত্বের দিকে এগিয়ে যাবেI
মন্দার গোস্বামী।