পরিবেশবান্ধব ডোকোশিল্পকে পুনর্জীবন দিতে দার্জিলিংয়ের তাকদায় বিশেষ কর্মশালা

Story image

পাহাড়, মেঘ, পাইন গাছের সারি মেশানো উত্তরবঙ্গ। দার্জিলিং, কালিম্পংডুয়ার্স। পাকদণ্ডী পথ, চা-বাগান, পাহাড়ি বাঁক, পাইনের জঙ্গল আর ছবির মতো সুন্দর ছোটো ছোটো গ্রাম। তাকদাতিনচুলেলামাহাট্টা, সিলারিগাঁও, ইচ্ছেগাঁও, আরও কত কি। বাঙালি তথা সারা দেশবাসীর অন্যতম প্রিয় ডেস্টিনেশন। গ্রামগুলির মতন গ্রামের মানুষগুলোও সহজ, সরল, সুন্দর। পর্যটকরা সারা বছরের ক্লান্তি কাটাতে যান, কয়েকদিন থাকেন, অনাবিল শান্তি আর অপার মুগ্ধতা নিয়ে নেমে আসেন সমতলে। কিন্তু তারপর স্থানীয় বাসিন্দাদের খোঁজ কেউ রাখেন, কেউ রাখেন না। ওখানকার বাসিন্দারা নিজস্ব দিনযাপন, সংস্কৃতি, শিল্প, উপার্জন নিয়ে যে সম্পূর্ণ জীবন কাটান, তার খুব ছোটো অংশই আমাদের চোখে পড়ে। পর্যটনশিল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকা, চা-বাগানে বা অন্য ক্ষেত্রগুলিতে শ্রমিক হিসাবে কাজ করা, পড়াশোনা বা খেলাধূলা করার বাইরে সেই বড়ো অনাবিষ্কৃত জায়গা হলো উত্তরবঙ্গের হস্তশিল্প। সেই হস্তশিল্পের মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য আবার বাঁশ, কাঠ, অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদান থেকে তৈরি বিভিন্ন রকমের ঝুড়ি, বা অন্যান্য সামগ্রী তৈরি করা। ডোকো, ঝক, ডালো, থুনসে ইত্যাদি। এগুলি ঐ অঞ্চলের নিজস্ব শিল্প, যা দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গেও যুক্ত। কিন্তু সময়ের স্রোতে হারিয়ে যেতে বসেছে এই শিল্পদ্রব্যগুলি। প্রায় হারিয়ে যেতে বসা সেই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতেই দার্জিলিঙের রামপুরিয়া গ্রাম-এ আয়োজিত হতে চলেছে তিনদিনব্যাপী ডোকো তৈরির কর্মশালা (A Three-Day Doko Workshop)। উদ্যোক্তা রামপুরিয়া যুবা সংঘ (Rampuria Yuwa Sangh)। উদ্যোগটিতে বিশেষ ভাবে সহায়তা করছে দ্য বেঙ্গল স্টোর (The Bengal Store) এবং লামাহাট্টা ক্যাফে (Lamahatta Café)। কর্মশালার স্থান শিশু শিক্ষা কেন্দ্র (Sishu Sikcha Kendra, SSK), রামপুরিয়া খাসমল (Rampuria Khasmal), দার্জিলিং।

কর্মশালার পোস্টার

ডোকো

দার্জিলিঙের তাকদা ব্লকের অন্তর্গত ছোট্টো গ্রাম রামপুরিয়া। চারিদিক সিনচেল অভয়ারণ্য দিয়ে ঘেরা। আগে গ্রামের প্রায় সব ঘরেই তৈরি হতো বাঁশের বিভিন্ন জিনিসপত্র। বাঁশের তৈরি ডোকো (Doko), টোকরি, ঝক, ডালো। কিন্তু বর্তমানে এই কাজ আর প্রায় হয়ই না। নতুন প্রজন্মের কেউই আর এই কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে চান না। প্লাস্টিকের জিনিস বাজার দখল করার ফলে বাঁশের জিনিসের চাহিদা কমেছে। কাজেই এসব জিনিস তৈরি করে তেমন উপার্জনের সুযোগ নেই বলেই ভাবছে বর্তমান প্রজন্ম। গ্রামে এখন তিন-চারজনের বেশি ডোকোশিল্পী নেই বলেই জানা গেল। তাঁরাও সবাই বয়স্ক। তাঁরাই বাচিয়ে রেখেছেন এই ঐতিহ্যশালী শিল্পকে। ডোকো কর্মশালা-র আয়োজকমণ্ডলীর সদস্য, রামপুরিয়া যুবা সংঘের সাধারণ সম্পাদক, নেপালি কবি নিমা শেরপা (Nima Sherpa) বঙ্গদর্শন.কম-কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেন, “এই শিল্পের সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতি যুক্ত। আমাদের গ্রামের প্রায় প্রত্যেক বাড়ির পারিবারিক ঐতিহ্য এই শিল্প। আমরা এই শিল্পকর্মকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই। তাই এই কর্মশালার উদ্যোগ নেওয়া।” তিনি জানান, ডোকো তৈরির সঙ্গে শুধু ঐতিহ্য নয়, দৈনন্দিন জীবনযাপনও যুক্ত। ডোকোগুলি হালকা অথচ মজবুত। তাই এগুলি সহজেই বহনযোগ্য। ডোকোর ব্যবহার অনেক। এতে করে নিয়ে যাওয়া যায় বিভিন্ন সামগ্রী, ফল, শাকসবজি, ফসলের বীজ, জলের পাত্র ইত্যাদি। বহন করা যায় ছোটো গৃহপালিত পশু আর পোলট্রি পাখিও। এমনকি, পশুপাখিগুলির খাঁচা হিসেবেও সাময়িক ভাবে ব্যবহার করা যায় ডোকোকে। প্লাস্টিকের জিনিসপত্রের কারণে যে পরিবেশ দূষণ, তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে এই কর্মশালা পরিবেশরক্ষার বার্তাও বটে। কর্মশালাটি শুরু হবে আগামী রবিবার, ২৩ জুলাই থেকে। আগামী আরও দুটি রবিবার, অর্থাৎ ৩০ জুলাই এবং ৬ অগাস্ট অনুষ্ঠিত হবে কর্মশালার পরবর্তী দুটি দিনের কর্মসূচি। ক্লাবের সদস্যরা সবাই অংশ নেবেন এই কর্মশালায়। এছাড়াও অংশ নেবেন গ্রামের বিভিন্ন বয়সী মানুষ। উদ্যোক্তারা ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণের উপর জোর দিচ্ছেন। যাতে এই ডোকো তৈরির কৌশল শিখতে পারে পরের প্রজন্ম।

ডোকো তৈরি হয় বাঁশ থেকে। এই বাঁশগুলি পাহাড়ি এলাকায় পাওয়া যায়। নাম পারেং (Pareng) বাঁশ। সাধারণ বাঁশের থেকে উচ্চতায় খানিক খাটো। সেই বাঁশের বিভিন্ন স্তর থেকে ডোকো তৈরি হয়। বাঁশ ছাড়া অন্য কোনও জিনিস ব্যবহার হয় না ডোকো তৈরিতে। এই কর্মশালায় সেই ডোকো তৈরির প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। প্রশিক্ষণ দেবেন বর্ষীয়ান শিল্পী অশোক রাই (Ashok Rai)। তিনি এলাকারই বাসিন্দা। বহু বছর ধরে তিনি বানিয়ে আসছেন ডোকো আর বাঁশের অন্যান্য জিনিসপত্র। নিমা শেরপার কথায়, “অশোক রাইয়ের অনেক বয়স হয়েছে। অসুস্থও ছিলেন বেশ কিছুদিন। তিনি না থাকলে তাঁর কৃষ্টিও হারিয়ে যাবে। তাই আমরা তাঁর শিল্পদক্ষতাকে অন্যদের মধ্যেও ছড়িয়ে দিতে চাই।” সবরকমের বাঁশ থেকে ডোকো তৈরি হয় না। আবার খেয়াল রাখতে হয়, যাতে কাঁচামাল সংগ্রহের কারণে বাঁশগাছগুলি অবাধে কেটে না ফেলা হয়। তাহলে পরের বছর আবার কাঁচামাল সংগ্রহ করার সময় পড়তে হবে অসুবিধায়। তাই কর্মশালায় অশোক রাই প্রশিক্ষণ দেবেন একদম গোড়া থেকে। বাঁশ গাছগুলি নির্বাচন করা, সেগুলিকে কাটার ধরন, তার থেকে বিভিন্ন স্তর আলাদা করে সেগুলি সুতো দিয়ে পরস্পরের সঙ্গে জুড়ে ডোকো তৈরি – সব বিষয়েই প্রশিক্ষণ দেবেন তিনি। নিমা শেরপা বললেন, “আমাদের ধারণা, এভাবে চললে শিক্ষার্থীরা তিনদিনের কর্মশালায় মোট দুটি করে ডোকো বানাতে পারবেন।” একটি ডোকো তাঁদের ব্যবহারের জন্য দিয়ে দেওয়া হবে। অন্য ডোকোটি গ্রামের বিভিন্ন পরিবারের মধ্যে বিতরণ করা হবে, বা রাখা থাকবে গ্রামের বিভিন্ন অংশে। যা ব্যবহার করা যাবে ডাস্টবিন হিসাবে। ফলে বাইরে থেকে বেশি দাম দিয়ে প্লাস্টিকের সামগ্রীও কিনতে হবে না, বাসিন্দাদের কাছেও খুলে যাবে স্বনির্ভরতার নতুন দিক। জানা গেল, উদ্যোক্তারা পরিকল্পনা করেছেন, পরবর্তীকালে এলাকায় একটি সেন্টার খোলার, যেখানে সারাবছর চলবে ডোকো এবং অন্যান্য সামগ্রী তৈরির প্রশিক্ষণ। যা নিজেরা ব্যবহার করতে তো পারবেনই, সেইসঙ্গে বাজারে বিক্রির মাধ্যমে পাওয়া যাবে উপার্জনের নতুন পথ।লামাহাট্টা ক্যাফে হলো লামাহাট্টার প্রথম ক্যাফে (দার্জিলিং থেকে কালিম্পং রোডের সর্বপ্রথম চালু হওয়া ক্যাফে)। পাহাড়ি পরিবেশের সৌন্দর্য আর আধুনিকতার পরিশীলিত মিশেলে তৈরি এই ক্যাফে। দেখলে বোঝা যায়, আধুনিকতার হাত ধরলেও পাহাড়ের নিজস্বতাকে সম্মান করতে জানেন এঁরা। এই কর্মশালাতে তাদের যোগদান এবং সহযোগিতা সত্যিই সাধুবাদযোগ্য। আশা করা যায়, এই কর্মশালা সাফল্য পাবে এবং এর মাধ্যমে ঐতিহ্যশালী এই পাহাড়ি শিল্প নতুন গতি পাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.