মুসলিম-দলিত ঐক্যের বিষয়টাকে অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল-মুসলিমিনের আসাদউদ্দীন ওয়াইসির মতো নেতারা আজকাল উচ্চগ্রামে উত্থাপন করছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দুইটি সম্প্রদায়কে একত্রিত করার জন্য অতীতে কোনও প্রচেষ্টা হয়েছে কিনা আর যদি হয়েও থাকে কীভাবে।
একটু পিছনে ফিরে তাকালে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের (পরবর্তী কালে পূর্ব পাকিস্তান অধুনা বাংলাদেশ) দলিত নেতা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল আর তার পরিণতির কথা নজরে আসবে।
পাকিস্তানে যোগ দিলে দলিতরা উচ্চবর্ণের হিন্দুদের অত্যাচার থেকে রক্ষা পাবে এই ধারণাটি কেবলমাত্র যোগেন্দ্রনাথ নিজে গ্রহণ করেছিলেন তাই নয়, বরং আরও অনেক দলিতকে প্রভাবিত করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে যাওয়ার জন্য। বি আর আম্বেদকর রাজ্য বিধান পরিষদে আসার জন্য মুম্বাই (তখনকার বম্বে) থেকে নির্বাচনে হেরে গেলে যোগেন্দ্রনাথ বঙ্গপ্রদেশ থেকে আম্বেদকরকে একই অনুরোধ জানান। পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দিতে আসামের সিলেট জেলাকে প্রভাবিত করারও চেষ্টা করেন যোগেন্দ্রনাথ। লিয়াকৎ আলি খানের মন্ত্রিসভায় তিনি পাকিস্তানের প্রথম আইনমন্ত্রীও হয়েছিলেন।
কিন্তু ১৯৫০ সালে মন্ত্রীপদ ত্যাগ করেন এবং ভারতে চলে আসতে বাধ্য হন। কারণ ততদিনে তিনি বুঝতে পারেন যে, তাঁর ধরণা ভুল ছিল। দলিতরা মুসলমানদের হয়রানি, অপমান ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে এবং তাঁর ব্যক্তিত্বের অপব্যবহার করা হচ্ছে।
১৯৫০ সালের ৮ই অক্টোবর লিয়াকৎ খানকে তাঁর পদত্যাগপত্রে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে তিনি লেখেন, “ঢাকা ও পূর্ববাংলার দাঙ্গায় নিহতদের সংখ্যা ১০০০০ জনেরও বেশি। আমি সত্যিই বিষাদগ্রস্ত ও বিব্রত। প্রিয়জনসহ সবকিছু হারানো নারী ও শিশুদের কান্নায় আমার অন্তর বিদীর্ণ। ইসলামের নামে পাকিস্তানে যা হচ্ছে, তা একতরফা হিন্দুনিধন।”
১৯৪৬-এর ১৬ই আগস্ট কলকাতায় ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’র কথা স্মরণ করিয়ে তিনি আরও লিখেছিলেন “আমি শ্রীযুক্ত (এইচ এস) সোহরাওয়ার্দীর মন্ত্রিসভায় ছিলাম। মুসলিম লিগ সেই বছরের ১৬ই আগস্টকে কলকাতায় ‘দি ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ হিসাবে পালন করে। আপনি জানেন যা এক ব্যাপক হত্যাকান্ডের রূপ নিয়েছিল।হিন্দুরা লিগ মন্ত্রিসভা থেকে আমার পদত্যাগ দাবি করে । আমার জীবন তখন এক বিপদগ্রস্ত অবস্থায়। আমি প্রায় প্রতিদিন হুমকি চিঠি পাচ্ছি। কিন্তু আমি আমার নীতিতে অবিচল ছিলাম।তাছাড়া, আমার জীবনের ঝুঁকি সত্বেও পত্রিকা ‘জাগরণ’-এর মাধ্যমে আমাদের সম্প্রদায়ের কাছে আপিল করি যে, কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের রক্তাক্ত বিবাদ থেকে তারা যেন নিজেদেরকে দূরে রাখেন।”
আক্ষরিক অর্থে তিনি এই জোট থেকে অনেক দূরে চলে গেছিলেন। তাঁর চিঠিতে তিনি আরও বলেন “কলকাতা গনহত্যার অনুসরণে ১৯৪৬ সালের অক্টোবরে ‘নোয়াখালী দাঙ্গা’। সেখানে তপশিলী জাতি ও শত শত হিন্দুকে হত্যা এবং ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হয়। হিন্দু সহ নারীদের ধর্ষণ ও অপহরণ করা হয়। আমার সম্প্রদায়ের সদস্যদের জীবনহানি ও সম্পত্তির ক্ষতি হয়।
কিন্তু, যখন সোহরাওয়ার্দী সরকারের বিরুদ্ধে “অনাস্থা প্রস্তাব” আনা হয় সরকারকে বাঁচাতে তিনি তৎপর হয়েছিলেন। তাঁর চিঠিতে লিখছেন, “কলকাতা গণহত্যার পরপরই সোহরাওয়ার্দী সরকারের বিরুদ্ধে একটি অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয়, কিন্তু আমি তখনও মুসলিম লিগের সঙ্গে সহযোগিতার নীতি অব্যাহত রেখেছিলাম।” ওই চিঠিতে তিনি এও দাবি করেছেন যে, তাঁর প্রচেষ্টাতেই সরকার পরাজয়ের হাত থেকে বেঁচে যায়।কারণ তিনি পরিষদের চার অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সদস্য এবং ‘কংগ্রেসের সঙ্গে এযাবৎ সুরক্ষিত’ চার তপশিলী জাতি সদস্যের সমর্থন আদায় করতে পেরেছিলেন।
যোগেনবাবুরা পাকিস্তানে আসার পর পাক নেতৃবৃন্দ তপশিলী জাতি ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের জন্য পৃথক নির্বাচনী এলাকার মতো প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে থাকেন। এ প্রসঙ্গে তিনি লেখেন, “পাকিস্তানি শাসকদের পক্ষ থেকে এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে প্রতিশ্রুতি অস্বীকার করার কৌশলগুলির উদ্দেশ্য কী তা বুঝতে অসুবিধা হয় না।” ওই চিঠিতে পাকিস্তানে দলিতদের ওপর নির্যাতন ও নিপীড়নের উল্লেখ করে তিনি লেখেন ” পূর্ব পাকিস্তান প্রশ্নটি বাদ রেখে, এখন পশ্চিম পাকিস্তান, বিশেষত সিন্ধু প্রদেশের দিকে নজর দিন। দেশভাগের পর পশ্চিম পাঞ্জাবে প্রায় এক লাখ তপশিলী জাতির মানুষ ছিল । তাদের একটি বড় সংখ্যা ইসলামে ধর্মান্তরিত।
কর্তৃপক্ষকে পুনঃপুনঃ অনুরোধ সত্ত্বেও মুসলমানদের অপহরণ করা এক ডজন তপশিলী মেয়ের মাত্র চারজনই এখনও উদ্ধার হয়েছে।”
যোগেন্দ্রনাথ উৎসাহিত হারিয়েছিলেন, কারণ তিনি গুরুত্বহীনভাবে ব্যবহৃত হচ্ছেন বলে বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি লিখেছেন ” প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদীয় দলের নেতা হিসাবে আপনার নির্দেশে গত ৮ই সেপ্টেম্বর আমি একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছি। আপনি জানেন যে, আমি মিথ্যা ও অর্ধসত্য তথ্য সম্বলিত কোনও বিবৃতি দিতে ইচ্ছুক ছিলাম না। যতক্ষণ আপনার নেতৃত্বের অধীনে মন্ত্রী হিসাবে কাজ করেছি ততক্ষণ আপনার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করাও সম্ভব ছিল না।” অবশেষে যোগেনবাবু ভারতে ফিরে আসেন এবং ১৯৬৮ সালে নীরবে মৃত্যুবরণ করেন।
যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের মনে মুসলিম-দলিত ঐক্যের সম্ভাবনা সম্পর্কে যদিবা সামান্য আশা থাকে, ডঃ আম্বেদকরের কিন্তু মুসলমানদের সম্পর্কে মতামত ছিল খুব স্পষ্ট। ১৯৪০ সালে মুসলিম লিগ মুসলমানদের জন্য একটি পৃথক দেশ দাবি করে প্রস্তাব পাস করার পর তিনি এ বিষয়ে একটি লেখা প্রকাশ করেন।
আম্বেদকর, যিনি দলিতদের কাছে ঈশ্বরের চেয়ে কম নন, লেখেন ” হিন্দুধর্মে মানুষ বিভক্ত, পক্ষান্তরে ইসলামে মানুষ একত্রিত বলে মনে করা হলেও সেটা অর্ধ সত্য। ইসলাম অপ্রতিরোধ্য ভাবে বিভক্ত করে। ইসলাম একটি রুদ্ধ ব্যবস্থা। ইসলামের ভ্রাতৃত্ব মানুষের সার্বভৌম ভ্রাতৃত্ব নয়। এটি শুধুমাত্র মুসলমানদের জন্য মুসলমানদের ভ্রাতৃত্ব।ইসলাম কখনোই সত্যিকার মুসলমানকে ভারতকে তার মাতৃভূমি হিসাবে এবং একজন হিন্দুকে তার পরম আত্মীয় হিসাবে গ্রহণ করতে দেবে না।”
এছাড়াও, ডঃ আম্বেদকর বলেন, মুসলমানরা অস্পৃশ্যদের নিজস্ব গোষ্ঠীভুক্ত করতে চাইলেও, সত্য এই যে, দলিতরা ধর্মান্তরিত হওয়ার পরও জাতিগতভাবে পরিত্রাণ পেতে পারেনি।
ডঃ আম্বেদকর ১৯০৫ সালের আদমসুমারির রিপোর্ট উদ্ধ্ত করে লিখেছেন,
“মুসলিমরা নিজেদের দুটি প্রধান সামাজিক বিভাগকে স্বীকৃতি দেয় (১) আশরফ (বা শরফ) এবং (২) আজলফ। আশরফ মানে ‘মহৎ’ এবং সন্দেহহীনভাবে বিদেশীদের বংশধর এবং উচ্চবর্ণ হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত। আর শ্রমজীবী এবং নিম্ন স্তরের ধর্মান্তরিতরাসহ অন্যান্য সকলে হচ্ছে অবমাননাকর ‘আজলফ’ বা ‘নীচু স্তরের লোক’, তাদের ‘কামিনা’ও বলে। কিছু জায়গায় একটি তৃতীয় শ্রেণী আছে যার নাম ঋ’আরজাল’ বা 0’সর্বনিম্ন’। তাদের সঙ্গে অন্য কোনও মুসলমানের কোনও যোগাযোগ থাকবে না এবং কবরস্থানে ও মসজিদে তাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ।”
ডঃ আম্বেদকর আরও বলেন, ” মুসলমানরা যে শুধু বর্ণভেদ নয়, অস্পৃশ্যতাও মানে, বাংলার এই তথ্যগুলি যথেষ্ট প্রমাণ দিতে পারে। “
এটা অবশ্যই উল্লেখ করা দরকার যে, মুসলমানদের ওপর ডঃ আম্বেদকরের দৃষ্টিভঙ্গি কেবলমাত্র কেতাবি আলোচনা নয়। তিনি তাদের নেতাদের সঙ্গে আলাপচারিতা করেছেন এবং ভারতের স্বাধীনতা ও পরবর্তীকালে বিষয়টির গুরুত্ব নিয়ে ভাবনাচিন্তা করেছেন।
অন্য দিকে, যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের বিষয়টি ছিল বাস্তব দৃষ্টান্ত, যেখানে তিনি যথেষ্ট ব্যক্তিগত ঝুঁকি নিয়ে আশার পিঠে আশা করেছিলেন।
প্রকৃতপক্ষে, যোগেন্দ্রনাথ তাঁর চিঠিতে লিখেছিলেন, তিনি সর্বদা মুসলিম লিগকে এমন “দরকষাকষির ব্যবস্থা” হিসাবে দেখেছিলেন যার মাধ্যমে সমাজের নিম্নস্তরের মানুষদের অর্থনৈতিক উন্নতি হবে। তিনি ভালোভাবে জানতেন যে, একটি আলাদা দেশ হলেই সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান হবে না, বরং খারাপ হবে। কিন্তু, সম্ভবত, তিনি আশা করেছিলেন যে, “একই অর্থনৈতিক অবস্থার (বিশেষত, পূর্ববাংলায়)” মুসলমানরা, দলিতদের পরিস্থিতি উন্নত করতে সহায়তা করবে। কিন্তু বাস্তবে মুসলমানরা দলিতদের দেখেছে শত্রু, কাফের, মুশরিক হিসেবেই।
আজ “দোনো মজলুম কমীন”(উভয় নিপীড়িত সম্প্রদায়সমূহ) বলে ঐক্যের ডাক দেওয়া হলেও তার বিশ্বাসযোগ্যতা একেবারেই নেই, তা যোগেন্দ্রনাথের উদাহরণেই স্পষ্ট।
সুমঙ্গল মন্ডল