#তৃতীয়ার্ধ: #সুলুকবাহার_থেকে_নাগারখানা
বোমা তৈরির জন্য ধ্রুবেশ চ্যাটার্জি নিজের ভূত ভবিষৎ ভুলে নিঃস্ব হয়ে গেলেন। কিন্তু সেই অর্থে ক দিন আর চলবে? অর্থাভাব দেখা দিল।পুনরায় বৈঠকে ডাকাতির কর্মসূচি গৃহিত হল। কিন্তু কৃষ্ণনগরের এক বিপ্লবী অনন্তহরি মিত্র অন্য প্রস্তাব রাখলেন…. ডাকাতি নয়, ধ্রুবেশ যদি নিঃস্ব হয় দেশের জন্য তাহলে বাকিরা কেন নয়? প্রস্তাব হল ধ্রুবেশের মত প্রত্যেকে যে যতটা পারবে নিজেরা টাকা জমা করে সেই টাকা বোমা তৈরীর কাজে দান করবেন । দেখা যাক তা দিয়ে কতদিন কাজ চলে…. সেই টাকা আবার ফুরোলে তারপর ভাবা যাবে… প্রস্তাব সকলে মেনে নিলেন।
তবে বাইরে থেকে যে সমস্ত বিপ্লবীরা এসেছিলেন তাদের পক্ষে টাকা দেওয়া সম্ভব ছিল না । তারা তো বাড়ির সঙ্গে সব সম্পর্ক চুকিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু কাছাকাছি যাদের বাড়ি তাঁরা অনেকেই এলেন । এনাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন তারাদাস মুখার্জি, প্রমোদ সেনগুপ্ত, প্রফুল্ল কুমার বসু ,গোবিন্দ দত্ত, ধীরেন সরকার প্রমুখ। ধীরেন সরকার বিপ্লবী মহলে ভদু নামেই সুপরিচিত ছিলেন।
এঁদের মধ্যে তারাদাস মুখার্জি দক্ষিণেশ্বর বোমা মামলায় শাস্তি পাওয়ার পর অভ্যন্তরীণ থাকার সময় আত্মহত্যা করেছিলেন। প্রমোদ সেনগুপ্তকে অবশ্য দক্ষিণেশ্বর বোমা মামলায় জড়ানো যায়নি । কারন যেদিন বোমা কারখানায় তল্লাশি হয় সেদিন তিনি সেখানে ছিলেন না । তবে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ছাড় দেয়নি। পরবর্তী কালে #বেঙ্গল_অর্ডিনেন্স_এক্ট এ প্রমোদ সেনগুপ্ত কে আটক করা হয়। পরে তিনি ছাড়া পেয়ে তিনি লন্ডন চলে যান।
প্রফুল্ল কুমার বসু ১৯৪২ সালের ১০ ডিসেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বোমার আঘাতে মারা যান।
যা হোক বিপ্লবের বোমা তৈরির কাজে টাকা দেওয়ার জন্য এগিয়ে এলেন তাঁরা। তাঁরা অবাক কান্ড করেছিলেন । নিজের সংসারের #সোনার_অলংকার তুলে এনে দিলেন বিপ্লবীদের হাতে। সারা পাড়া রটিয়ে দিয়েছিলেন যে ,বাড়িতে ডাকাত পড়েছে …তাই সোনার অলংকার ডাকাতি হয়ে গিয়েছে। আবার বোমা তৈরীর কাজ এগিয়ে চললো । কিন্তু এই টাকা কত দিন ? স্বাভাবিকভাবেই কিছুদিনের মধ্যে আবার টাকার ঘাটতি দেখা দিল। কারণ বোমা তৈরি বিরাম ছিল না।পূর্বেই বলেছি স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য বোমা কারুর কাছে বিক্রি করার কথা কল্পনাও করতে পারতেন না বিপ্লবীরা ।
বোমা বিতরণ বাংলা ছাড়িয়ে সারা দেশের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। ভারতের প্রায় সর্বত্র যেখানে বিপ্লব এর কাজ শুরু হয়েছিল সেই সব জায়গায় বোমা চলে যেত । সুতরাং পুনরায় দেখা দিল অর্থাভাব । তাহলে এবার উপায় কি? এবার কোথা থেকে হবে সেই প্রচুর অর্থের সংস্থান? কোথা থেকে পাওয়া যাবে টাকা ? আলোচনায় সিদ্ধান্ত হলো এবার ডাকাতি করতেই হবে ….তবে কলকাতা শহরে নয়। কারণ কলকাতার উপকণ্ঠের কাছেই দক্ষিনেশ্বরে চলছে বোমা তৈরীর কাজ। যদি কলকাতায় কোন ভাবে ডাকাতি হয়, তাহলে পুলিশি তদন্তে কিন্তু উপকণ্ঠের অঞ্চল গুলো বাদ যাবে না । ফলত আস্তানার খবর পুলিশ পেলেও পেয়ে যেতে পারে।
ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম কেন্দ্র থেকে খবর এলো …. বিপ্লবী অন্তত সিং জানালেন সরকারি টাকা ডাকাতি সম্ভাবনা রয়েছে। #আসাম_বেঙ্গল_রেলওয়ের টাকা লুন্ঠন করা হবে । চট্টগ্রামে বিপ্লবীরা গুপ্ত সভায় বসলেন হরিনারায়ন চন্দ্রের সঙ্গে । ব্লু প্রিন্ট তৈরি হল। কিছু বোমা দিলেন হরিনারায়ন। কলকাতা থেকে পাঠানো হলো এ ব্যাপারে পাকা কর্মী দেবেন দে কে।
১৪ ই ডিসেম্বর ১৯২৩ সালে হয়ে গেল সেই বিখ্যাত রেল ডাকাতি। এই ডাকাতিতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মাস্টারদা সূর্য সেন । অংশ নিয়েছিলেন অনন্ত সিংহ, অবনী ভট্টাচার্য্য, দেবেন দে প্রমুখ…. ডাকাতি করে সেখান থেকে প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণ ছিল ১৭০০০ টাকা । কিন্তু তার পরেই দেখা দিল বিপদ। ডাকাতির পর সূর্য সেন এবং অন্যান্যরা আশ্রয় নিয়েছিলেন শহরের বাইরে #সুলুকবাহার নামক স্থানের একটি বাড়িতে। রেল ডাকাতি কারা করেছে তার তদন্তে পুলিশ জানতে পারে এটি সূর্যসেনের দলের কাজ ।
সুতরাং স্বাধীনতা বিপ্লবের গন্ধ পেয়ে পুলিশ কুকুরের মত খোঁজ শুরু করলো। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে গেল শহরের বাইরের সুলুকবাহারের একটি বাড়িতে ডাকাতের দল অর্থাৎ বিপ্লবীদের দল লুকিয়ে রয়েছে। পুলিশ গেল সেই বাড়ি ঘেরাও করতে। সে বাড়িতে তখন মাস্টারদা সূর্য সেন, দেবেন দে, রাজেন্দ্রনাথ দাস ,অম্বিকা চক্রবর্তী ,অনন্ত সিং ছিলেন। দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষ হয়েছে সবে। এঁটো বাসন-কোসন মাজতে দেবেন দে পুকুরপাড়ে গিয়েছেন । দূর থেকে দেখতে পেলেন পুলিশ আসছে বাড়ির দিকে ধেয়ে। দারোগা দেবেন কে দেখে তার নাম ধাম ইত্যাদি জানতে চাইলে মনগড়া উত্তর দিল।কিন্তু দেবেন কলকাতার ছেলে ,চট্টগ্রামের ভাষা তাঁর জানা ছিল না । পুলিশের সন্দেহ হলো….
ব্যাপারটি কি ঘটতে যাচ্ছে তা অনুমান করে দেবেন পুলিশের আসার খবর পৌঁছে দিলেন মাস্টারদা সূর্য সেন এর কাছে। তৎক্ষণাৎ সূর্য সেন সমস্ত কাগজপত্র নষ্ট করে শুধু মাত্র টাকা পয়সা নিয়ে বাড়ি ছেড়ে সদলবলে ন্যত্র আত্মগোপনের চেষ্টা করলেন। পুলিশ বাড়ি তল্লাশি করে কারও সন্ধান পেল না । কিন্তু রাস্তায় লোকদের কাছে জিজ্ঞাসা করলে তারা বলল…. একদল লোককে রাস্তা দিয়ে পাহাড়ের দিকে যেতে দেখেছে..
বাঃ , সন্ধান পাওয়া গেছে …পুলিশ গ্রামের লোকদের ভুল বোঝাতে থাকল। জানালো যে ,ওটা ডাকাতের দল এবং ডাকাতদের ধরে দিতে পারলে সরকারের তরফ থেকে পুরস্কার দেওয়া হবে মোটা টাকা। টাকার লোভে গ্রামবাসীরা উৎসাহী হয়ে পুলিশের সঙ্গ নিল। বিপ্লবীরা যত এগোয় গ্রামবাসীরা ছুটতে ছুটতে তাদের অনুসরণ করতে থাকলো কি হবে উপায়? একমাত্র পথ হচ্ছে ঠকানো… মাস্টারদার সঙ্গে কিছু খুচরো টাকা ছিল। গ্রামবাসীরা কাছে আসতেই, বিপ্লবীরা তাড়াতাড়ি খুচরো টাকাগুলো রাস্তায় ছড়িয়ে দিতে লাগল ।গ্রামবাসীরা টাকা পড়ে থাকতে দেখে টাকা কুড়োতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। টাকা কুড়োনো শেষ হলেই গ্রামবাসীরা আবার টাকার জন্য ছুট দেয়।
তখন বাধ্য হয়ে বিপ্লবীরা একটি টিনের বোমায় আগুন লাগিয়ে এগিয়ে যান। একটু পরেই ভীষণ শব্দ করে বোমাটি ফেটে যায়। চারিদিকে ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, কিছু দূর যাবার পর #নাগারখানা পাহাড়ের কাছে ব্রিটিশ পুলিশ ও বিপ্লবীদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। গুলি বিনিময় হতে লাগল। এই যুদ্ধই #নাগারখানা_যুদ্ধ নামে সুবিখ্যাত।
ব্রিটিশ পুলিশদের দুজন সিপাহী জখম হবার ফলে, একটু সময় পেলে বিপ্লবীর পাহাড়ে আশ্রয় নিলেন। পাহাড়ের ধারে একটি হ্রদ ছিল। সেটি ছিল কচ্ছপ ভর্তি । পাহাড়ে ওঠার পরিশ্রমে বিপ্লবীরা ক্লান্ত হয়ে পড়লেন । পুলিশ ফোর্স এর মধ্যে ছিল চট্টগ্রামের এস পি মিঃ শ্যালো , ডেপুটি সুপার মিস্টার ব্রাউন এবং ইন্সপেক্টর মিঃ সোয়ান।
পুলিশ বিপ্লবীদের পা ধরে টেনে নামায় । কাছের একটা ডোবায় বারবার চুবিয়ে এবং মেরে সূর্য সেন এবং অন্যান্যদের গ্রেপ্তার করে । তার মধ্যে রাজেন্দ্র নাথ গড়িয়ে একটি ডোবায় পড়ে যান। সেখানে তিনি দুদিন পড়েছিলেন। পরবর্তীকালে সন্ধান পেয়ে তাকেও গ্রেপ্তার করা হয়।
দেবেন দে ,অবনী ভট্টাচার্য এবং অনন্ত সিং পাহাড়ের উপর উঠে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে কাছেই এক গ্রামে আশ্রয় নিয়ে ছিলেন এবং পরে তারা কলকাতায় চলে এসেছিলেন।
রাজেন্দ্র নাথ দাস ,অম্বিকা চক্রবর্তী, সূর্য সেন প্রমুখের বিরুদ্ধে মামলা সূচিত হয় । অভিযোগ ছিল ডাকাতি এবং আগ্নেয়াস্ত্র চুরি ও সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র…. মামলা শুরু হলো সেশন জজ আদালতের স্পেশাল জুড়ির সাহায্যে । এই মামলায় বিপ্লবীদের পক্ষে মামলা লড়েছিলেন বিখ্যাত আইনজীবী যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, অ্যাডভোকেট রজনী বিশ্বাস ,কামিনী দাস প্রমুখ ।
তাঁরা দেখলেন আসামিদের কাছে যে রাইফেল পাওয়া গিয়েছে মিলিটারি রাইফেল এবং রিভালবারটি একটি সাহেবের। এ দুটি হারিয়ে যাবার বা চুরি যাবার কোন অভিযোগ পুলিশের খাতায় তোলা নেই । বিপ্লবীদের পক্ষ থেকে বলা হল সূর্য সেন একজন স্কুল টিচার। স্টুডেন্টদের নিয়ে পাহাড়ে গিয়েছিলেন পিকনিক করতে ।পুলিশ তাদের ফাঁসিয়ে দিয়েছে ,কারণ তাঁরা ভারতীয়। নেটিভ বলেই তাঁদের প্রতি এই ব্যবহার। যতীন্দ্রমোহনের সুদক্ষ মামলা পরিচালনার গুণে তিনি সমস্ত বিপ্লবীকে নির্দোষ প্রমাণিত করলেন।
যে ১৭০০০ টাকা পাওয়া গিয়েছিল তার অধিকাংশ অর্থ চলে এলো কলকাতায়। টাকা নিয়ে এসেছিলেন অনন্ত সিং । পূর্বেই বলেছি যে সূর্য সেন দের সঙ্গে অনন্ত সিং ধরা পড়েননি । তিনি ধরা পড়ে গিয়েছিলেন হাওড়ার ঘুসুরিতে আত্মগোপন কালে।
নতুন উদ্যমে বোমা তৈরির কাজ শুরু হলো কিন্তু সে টাকা ও এক দিন শেষ হলো আবার দেখা দিল টাকার অভাব । এবার বিপ্লবীরা ঠিক করলেন ডাকাতি আরো একটা করতে হবে, কিন্তু কলকাতা বা কলকাতার আশেপাশে নয় ।করতে হবে কলকাতার বাইরে যেমন, চট্টগ্রামের ঘটনাটি।
কৃষ্ণনগরের বিপ্লবী শাখার নেতা অনন্তহরি মিত্র।তাঁর উপরে পড়ল ডাকাতির দায়িত্ব। যদি কৃষ্ণনগরে ডাকাতি হয় তাহলে দক্ষিণেশ্বরের বোমা কারখানার খবর পুলিশের পক্ষে জানা একেবারেই অসম্ভব। অনন্তহরি মিত্র রাজি হয়ে গেলেন । নিখুঁত পরিকল্পনা,সতর্কতায় সেদিন ডাকাতি হয়েছিল অনেকটা সিনেমার মতো …..
কি হয়েছিল সেদিন?
ক্রমশঃ
#দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ১. কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলা ২. ভারতের সশস্ত্র বিপ্লব ৩. দক্ষিণেশ্বর বোমা মামলা থেকে কাকোরি ট্রেন ডাকাতি