#প্রথমার্ধ : #অরুণ_আলো
একদা যাহার বিজয় সেনানী
হেলায় লঙ্কা করিল জয়
একদা যাহার অর্ণবপোত
ভ্রমিল ভারত সাগরময়।
সন্তান যার ত্বিব্বততীর
জাপানে গঠিল উপনীদেশ
তার কি না ধুলায় আসন,
তার কি না এই চ্ছিন বেশ?
উদিল যেখানে মোরজ মন্ত্রে
নিমাই কন্ঠে মধুর ও তান
ন্যায়ের বিধান দিল রঘুমনি,
চন্ডীদাস ও গাইল গান
যুদ্ধ করিল প্রতাপাদিত্য
তুই কিনা সেই ধন্য দেশ,
ধন্য আমরা যদি এ শিরায়
রহে যদি তাদের রক্ত লেশ।।
যখন খুব ছোট ছিলাম তখন ভাবতাম মা হলেন সব কিছু। সবার উপরে মা হলেন সত্য। যখন বড় হতে শুরু করলাম তখন উপলব্ধি করলাম যে জননী ও জন্মভূমি এই দুই হলেন স্বর্গের চেয়েও গরীয়সী। তখন বাড়িতে ধীরে ধীরে দেশপ্রেমের পাঠ পড়ানো শুরু করেছিলেন আমার কাকা। তখন পড়তে গিয়ে উপলব্ধি করলাম যে ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লব বঙ্গ ও ভারতের অন্যান্য অংশে সূচিত হয়েছিল তা ক্রমশ দেশপ্রেমের বিনিসুতোর মালায় গোটা দেশটাকে একটি বাঁধনে বেঁধে ফেলেছিল। একজন বাঙালি একজন উত্তরপ্রদেশীয়, একজন হলেন রাজেন লাহিড়ী আর একজন হলেন রামপ্রসাদ বিসমিল কী আশ্চর্য সে মিলন ঘটেছিল। দক্ষিণেশ্বর হতে লখনৌ, নদীয়া আর গোরক্ষপুর যে পড়শী হতে পারে দেশপ্রেম নামক যাদু সেই কাজ সম্ভবপর করেছিল। আজ এত প্রাদেশিক চিন্তা চারিপাশে মনে হয় হাঁপিয়ে উঠেছি,আবার ছোট হয়ে গিয়ে রবিবার দুপুরে পুকুর পাড়ে বা ছাদের ধারে অথবা প্রজাপতি ধরতে ধরতে সে সব ইতিহাস গুলো শুনি আর চোখ বন্ধ করে দেখি সূর্য সেন, জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষ, বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি, গরুর গাড়িতে রডা কোম্পানীর মাউজার পিস্তল লুঠ, হরিনারায়ন চন্দ্র, যতীন দাস, শচীন স্যন্যাল, সুভাষচন্দ্রদের…..
”…যারা স্বর্গগত তারা এখনো জানে, স্বর্গের চেয়ে প্রিয় জন্মভূমি এসো স্বদেশ ব্রতের মহা দীক্ষা লভি সেই মৃত্যুঞ্জয়ীদের চরণ চুমি…”
আজকে আমরা যাব সেই দক্ষিণেশ্বরে । সেখানে #বাচস্পতি পাড়া। সেখানে শেখানো হত ….যাক চলুন যাই।
#দক্ষিণেশ্বর_বোমা_মামলা ও #কাকোরি_ষড়যন্ত্র_মামলা একে অপরের সঙ্গে অপ্রোতভাবে জড়িত ছিল।বিপ্লবীদের নিখুঁত পরিকল্পনা, চাতুর্য, নৈপুণ্য এবং সাহসিকতায় তিন ডাকাতি সম্পন্ন হয়েছিল। সেই অর্থে দক্ষিণেশ্বরের বিপ্লবীরা বোমা তৈরি শুরু করেন। তাঁরা চেয়েছিলেন সর্বভারতীয় বিপ্লবীগনের নিকট সেই বোমা পৌঁছে বিপ্লবের কার্যে সহায়তা করতে। কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলায় সে সময়ের প্রথম সারির বিপ্লবীরা ছিলেন। উত্তরপ্রদেশের বিপ্লবীদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ডাকাতির সঞ্চিত অর্থে ভবিষ্যতে এক সশস্ত্র গন অভ্যুত্থান ঘটানো ও স্বাধীনতা। যদিও উত্তরপ্রদেশের বিপ্লবীরা ধরা পড়ে গিয়েছিলেন। ধরা দক্ষিণেশ্বরের বিপ্লবীরাও পড়েছিলেন। কাকোরির ঘটনায় রামপ্রসাদ বিসমিল, ঠাকুর রোশন সিং , আসফাকুল্লা খানের সঙ্গে ছিলেন বাংলার রাজেন্দ্রনাথ লাহিড়ী, শচীন স্যান্যাল, যতীন দাস, মাস্টারদা সূর্য সেন।
অবাক হবার কিছু নেই, উপরোক্ত বাংলার বিপ্লবীরা দুটি ঘটনাতেই সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন। রাজেন্দ্রনাথ লাহিড়ীকে দুটি ঘটনায় প্রত্যক্ষ ভাবে শাস্তি পেতে হয়েছিল। দক্ষিণেশ্বর মামলায় প্রথমে দশ বছর জেল, আপিল করে কমে পরে তা হয় পাঁচ বছর।পরবর্তীতে কাকোরি মামলায় তাঁর ফাঁসির হুকুম হয়। দুটি মামলায় মোট ছয় জন বিপ্লবীর ফাঁসি হয়। কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলায় চারজন – রামপ্রসাদ বিসমিল, রাজেন লাহিড়ী, আস্ফাকউল্লা এবং ঠাকুর রোশন সিং । দক্ষিণেশ্বর বোমা মামলায় দুজন – অনন্তহরি মিত্র এবং প্রমোদ চৌধুরী। এই দুজন বিপ্লবী জেলে থাকার সময় এক ব্রিটিশ পুলিশ অফিসারের ভবলীলা সাঙ্গ করেছিলেন। ফাঁসির জন্য অনেক কারনের মধ্যে এই কারনকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল।
১৯১৯ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মন্টেগু চেমসফোর্ডরিফর্মের জন্য বহু রাজবন্দীকে মুক্তি দেওয়া হয়। ১৯১৮ সালে ১১ নভেম্বর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে #ভার্সাই_চুক্তি হয়। বিশ্বযুদ্ধের আগে এরম কথা হয়েছিল যে ভারত যদি এই যুদ্ধে অর্থ ও লোকবল দিয়ে সাহায্য করে তবে যুদ্ধ শেষ হলে ভারতীয়দের দাবি বিবেচনা করে দেখবে। এতে ভারতের পক্ষে সই করেন লর্ড সত্যেন্দ্রনাথ সিংহ এবং বিকানিরের মহারাজ। ১৯১৯ সালের ২৩ শে ডিসেম্বর অফিসিয়ালি বা রাজকীয় ভাবে চুক্তি ঘোষিত হয়।
উক্ত চুক্তির ফলে আন্দামান থেকে ঘরে ফিরলেন বহু দ্বীপান্তর হয়ে যাওয়া বিপ্লবীরা। এছাড়াও বিভিন্ন জেলে থাকা রাজবন্দী ও দন্ডিত বিপ্লবীরাও মুক্ত হলেন। যাঁরা আত্মগোপন করে ছিলেন তাঁরাও এলেন প্রকাশ্যে। কিন্তু তাঁরা সকলেই হয়ে পড়লেন বড় শান্তিপ্রিয়। স্বাভাবিক জীবনযাপন করতেই পছন্দ করলেন।কেউ বিবাহ করলেন, কেউবা চাষবাস ,কেউ ব্যবসা ,তো কেউ একেবারে চাকরি।
ঠিক এই সময় পাঞ্জাব থেকে ফিরলেন বিখ্যাত বিপ্লবী গুরু জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষ। ইনি বিপ্লবীদের নিকট মাস্টারমশায় বলে সুপরিচিত ছিলেন।বছর দুই আগে বৈপ্লবিক কর্ম তত্বাবধানের জন্য তিনি পাঞ্জাব গিয়েছিলেন। ১৯২২ সালের শেষদিকে তিনি ফিরে এসে বাংলার বিপ্লবের অবস্থা দেখে বড় চিন্তিত হয়ে পড়লেন।
আগামী দিনে কিভাবে বিপ্লবের কার্য করবেন সেই নিয়ে মাস্টারমশায় প্রথম আলোচনা করলেন চন্দননগরের গোঁদল পাড়ার নরেন বন্দ্যোপাধ্যায় ,উত্তরপাড়ার অমরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় , বউ বাজারের বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি, মলঙ্গা লেনের অনুকূল মুখার্জি, বরানগরের খগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ বিপ্লবী দের সঙ্গে। এঁরা প্রায় সকলেই ১৯১৪ সালের রডা কোম্পানির মাউজার পিস্তল লুঠের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আলোচনা শেষে তাঁরা সকলেই নতুন করে কাজ শুরু করার পক্ষে মতদান করলেন।
#বউবাজারের_চেরি_প্রেসে আন্দামান ফেরৎ বহু বহু বিপ্লবী একত্রিত হতেন।জেল জীবন, ব্রিটিশ অত্যাচারের কথা ইত্যাদি স্মৃতি নিয়ে আলোচনা করে সময় কাটাতেন। কিন্তু এরম করে কতদিন? বিপ্লবী গুরু জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষ সকলকে সন্তোষ মিত্রের অক্রু র দত্ত লেনের গৃহের ছাদে একত্রিত হবার জন্য অনুরোধ করলেন। সেই গুপ্ত আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বারীন ঘোষ, পুলিন দাস , ডক্টর যদুগোপাল মুখোপাধ্যায় প্রমুখ ব্যক্তিত্বগন। সেখানে নতুন করে অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত বিপ্লবীগন কর্মসূচি গ্রহণ করলেন।
সন্তোষ মিত্র
বিপ্লবী গুরু জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষ তরুণ বিপ্লবীদের উৎসাহিত করলেন, যে মুক্তির বিপ্লব শুরু করেছিলেন ঋষি অরবিন্দ , যাঁর জন্য ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী, বসন্ত বিশ্বাস রা প্রাণ উৎস্বর্গ করেছিলেন সে বিপ্লব ,সে লড়াই থামতে পারে না। নবীন রক্তকে উৎসাহিত করলেন ভারতব্যাপী বৈপ্লবিক সংগঠন তৈরি করার জন্য। বললেন , ” তোমরা যদি নিজেরা পাথেয় সংগ্রহ করে কাজে এগোতে পার তবে একটা কিছু হতে পারে। “
সেই আহ্বানে নবীন বিপ্লবী রক্ত নেচে উঠল। নিজের মাটির দাবিতে লড়াই। নিজেরাই জোগাড় করবেন পাথেয়। নতুন পথে চলার সংকল্প নিলেন । সন্তোষ মিত্রের নেতৃত্বে একটি দল , জুলু সেন ও সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের একটি দল, বরানগর হাওড়া, হুগলি, চন্দননগর, কৃষ্ণনগর ইত্যাদি জায়গায় বিপ্লবীরা বিভিন্ন দল গঠন করে কাজ শুরু করলেন। ভিন্ন দল কিন্তু নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ অক্ষুন্ন থাকল।
চট্টগ্রাম থেকে মিরাট ও লাহোর পর্যন্ত একটি দল, একই সূত্রে গ্রথিত। সেই দলের নাম দেওয়া হল #Red_Bengal_Party…
চুঁচুড়ার বিপ্লবী হরিনারায়ন চন্দ্রকে দায়িত্ব দেওয়া হল বোমা তৈরি নিজে শিখে অন্যদের শেখানো। চন্দননগর গোঁদল পাড়ার তিনকড়ি মুখার্জি , মগরা নিবাসী ডক্টর দীনবন্ধু ঘোষ এবং হরিনারায়ন চন্দ্র প্রেসিডেন্সি কলেজে রসায়নের অধ্যাপক সুরেশবাবু কাছে বোমা তৈরি শেখা শুরু করেন । হরিনারায়ন পরে অবশ্য আরো উন্নত মানের বোমা তৈরি করতে শিখেছিলেন এবং বানিয়েছিলেন।
বোমা তৈরি শেখার পর শচীন্দ্রনাথ সান্যাল অনুরোধে বারীন্দ্রকুমার বন্দোপাধ্যায় , ভূমেশ চট্টোপাধ্যায়, বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়, যতীন দাস এবং হরিনারায়ন চন্দ্র চলে গেলেন দেওঘরে বোমা পরীক্ষার জন্য। এদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন বিহারের এক কলেজের অধ্যাপক। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার , ১৯০৭ সালে #যুগান্তর দলের বিপ্লবীরা – বারীন ঘোষ, প্রফুল্ল চক্রবর্তী , উল্লাসকর দত্ত- দেওঘরে #দিঘরা পাহাড়ে উল্লাসকরের তৈরি বোমা পরীক্ষা করতে এসেছিলেন। দুর্ভাগ্যক্রমে পরীক্ষার সময় বোমার আঘাতে মারা যান প্রফুল্লকুমার চক্রবর্তী। সেই বোমা এত শক্তিশালী ছিল যে পরের দিন সেখানে গিয়ে প্রফুল্লের দেহের কোন অংশ খুঁজে পাওয়া যায় নি। দেওঘরে হরিনারায়ন চন্দ্রের তৈরি বোমা সফলভাবে বিস্ফোরণ হয় এবং সকলে তৃপ্ত হয়ে কলকাতায় ফিরে আসেন ।
হরিনারায়ন চন্দ্র
তারপর?
ক্রমশঃ
#দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ১. কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলা ২. ভারতের সশস্ত্র বিপ্লব ৩. দক্ষিণেশ্বর বোমা মামলা থেকে কাকোরি ট্রেন ডাকাতি