রবিবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২০: রষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ, নাগপুর (Nagpur) মহানগরের বৌদ্ধিক চর্চার পক্ষ থেকে এদিন বিকেল ৫টা থেকে সঙ্ঘপ্রধান মোহনজী ভাগবৎ জাতির উদ্দেশ্যে বর্তমান পরিস্থিতির নিরিখে যে বিশেষ বার্তা দিয়েছেন:
বর্তমান চালচিত্র এবং আমাদের ভূমিকা
মাননীয় মহানগর সঙ্ঘচালক, স্বয়ংসেবক বন্ধুগণ, সজ্জনমণ্ডলী ও এবং মাতাদেশবাসী-ভগ্নীগণ, এই বিশেষ সময়ে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে পর্দায় আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি। করোনার সঙ্গে সারা বিশ্ব আজ যুঝছে। যোঝার উপায় ঘরে বন্দী থেকে যতটুকু সম্ভব করা। সকলের সঙ্গে সঙ্ঘের কাজও বন্ধ। আমাদের প্রাত্যহিক শাখা, প্রার্থনা, বার্ষিক শিক্ষাবর্গ সবই বন্ধ। তবে সঙ্ঘের কাজ বন্ধ থাকলেও বন্ধ থেমে হয়থাকেনি। আমরা স্বয়ংসেবকরা আপন আপন গৃহে বন্দী থেকেই সঙ্ঘের কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। লকডাউন থাকলেও জীবন কিন্তু চলছে। তেমনি সঙ্ঘের কাজও থেমে নেই। নিত্যকর্মের ধারাটা সঙ্ঘের মতো সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কারণ মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য কী? নিজেরা ভালো হয়ে সেই ভালোত্বকে কাজে লাগিয়ে পৃথিবীর ভালো করা। নিজে ভালো কিন্তু কারও জন্য কিছু করলাম না, এটা যেমন ভালো চোখে দেখা হয় না; তেমনি দুনিয়ার ভালো করতে গেলাম অথচ নিজের জীবনে তার পালন করলাম না, এটাও লোকে প্রশংসা করে না। জীবন ও সঙ্ঘ একই মুদ্রার দুই পিঠ, যাদের স্বরূপ হল একান্তে আত্মসাধনা ও লোকান্তে পরহিত। তাই স্বয়ংসেবকরা নিয়মিত প্রার্থনা করছে, প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণ করছে নিজেদের পরিবারের মধ্যে থেকেই, ময়দানে না এসে। বর্তমানে এটাই সম্ভব, তার বেশি কিছু নয়। কিন্তু বাকি কার্যক্রম বদলে গেছে সেবাকাজে ভিন্ন স্বরূপে। সে সেবাকাজ। এখন আমাদেররা প্রচণ্ড পরিমাণে সেবা করতে হচ্ছে, কঠোরভাবে , অকাতরে যে সেবাকাজ করছি, সবাই তা দেখছে। সারা সমাজ আমআমাদের উৎসাহই দিচ্ছে। কিন্তু এটাই একমাত্র কাজ এমন ভাবলে চলবে না। আমাদের আসল কর্মসূচী হল নিজেরা ভালো থেকে জগতের হিতসাধন।
ভারত থেকে চীনদেশে এক ভিক্ষু গিয়েছিলেন তথাগতর জীবন ও ধর্ম প্রচারের জন্য। কয়েক বছর পর তাঁর মনে হল, চীনা ভাষায় তথাগতর একটা জীবনী লেখা দরকার। লিখেও ফেললেন। এরপর ছাপার পালা। পরিচিত বন্ধুদের মাধ্যমে অর্থের সংস্থানও হল। ছাপাখানায় পাণ্ডুলিপি জমা দেওয়ার আগের দিন হঠাৎ প্রবল ভূমিকম্প। তখন সবাইকে লেগে পড়তে হল সেবাকাজে। স্বভাবতই বইয়ের জন্য সঞ্চিত অর্থ ব্যয় হয়ে গেল ত্রাণকার্যে। সংকট কেটে যেতে ভিক্ষুরা সবাই মিলে পুনরায় টাকাপয়সা যোগাড় করল বইটি প্রকাশের উদ্দেশ্যে। এবার অতর্কিতে বন্যা এসে হাজির। বলা বাহুল্য এবারেও ঐ অর্থ বন্যাত্রাণে কাজে লাগাতে হল। এরপর তৃতীয়বার অর্থ সংগ্রহ করা হল এবং পাণ্ডুলিপি নির্বিঘ্নে বই হয়ে বেশ ধুমধাম সহকারে প্রকাশ পেল। মানুষ সশ্রদ্ধায় কিনে পড়া শুরু করল। বই খুলে দেখে তারা অবাক, প্রথম পাতায় লেখা – তথাগতর তৃতীয় চরিতামৃত। চরিত্র একটাই, কিন্তু তার প্রকাশ বহুমুখী, অথচ বার্তা অভিন্ন – জীবনের দুঃখ থেকে মুক্তি। তথাগত বুদ্ধ বিশ্বের দুঃখ মুক্তির কথা বলে গিয়েছিলেন। প্রথম দু’বার তো উনি তা দেখিয়ে দিয়েছেন। তাই এটি তৃতীয়….”। সুতরাং আজকে যে কাজটা করতে হচ্ছে তা সঙ্ঘের কাজ মনে করেই করতে হবে। আর এটা সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
এখন এই সেবা কেন করছি? এর অনুপ্রেরণা নিজের অহংবোধ তৃপ্ত করা নয়, নিজের যশ খ্যাতির জন্যও নয়। তবে যারা বিখ্যাত তাদের কিছুটা প্রচার করতে হয় যাতে অন্যরা অনুপ্রেরণা পায়। তবে কখনই সেটা নিজেদের ঢাক পেটানোর জন্য নয়। দেশ আমাদের, মানুষগুলোও নিজেদের। তাই স্বার্থ, অহঙ্কার, প্রতিক্রিয়া – সব সরিয়ে রেখে আত্মবৃত্তির বিকাশ ঘটাতে হবে। নিজেদের নিরহঙ্কার হয়ে নিরন্তর সেবা করতে হবে, কৃতিত্ব দিতে হবে অন্যদের। হয়তো অনেককেই কাজের জন্য অনেক কৈফিয়ত দিতে হচ্ছে। যা বলছি নিজেরা পালন করলে তবেই তার সদুত্তর দেওয়া সম্ভব। কিন্তু নিজেরা পালন করার সঙ্গে সঙ্গে পরহিতের কাজটাও চালিয়ে যেতে হবে। বাইরেও বেরোতে হবে। তার জন্য লকডাউন চলাকালীন যথাবিহিত অনুমতি নিতে হবে। পারস্পরিক শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে, সেভাবেই কাজ করতে হবে। দরকারে ছোটখাটো বিষয়ও মানুষকে বোঝাতে হবে। সেটা অসম্ভবও নয়।
মহামারী নতুন ধরনের, মারাত্মক। কিন্তু ভয় পেলে তো চলবে না। তাতে সংকট আরও বেড়ে যাবে। ভয় না পেয়ে ঠাণ্ডা মাথায় ভারসাম্য বজায় রেখে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা করতে পারলে সেই কাজ সাফল্য পায়। আত্মবিশ্বাস নিয়ে নির্ভয়ে ইতিবাচক প্রয়াস দরকার। করোনা নির্দিষ্ট অসুখ নয়। মানে কী কী হতে পারে তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল, যেমন যেমন তথ্য আসছে সেই অনুযায়ী চলতে হচ্ছে। তবে চেষ্টা থাকবে দ্রুত এই পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার। কিন্তু যতদিন চলছে, ততদিন পীড়িতের সেবা এবং সংক্রমণ প্রতিরোধের চেষ্টা দুইই চালিয়ে যেতে হবে। মাঝপথে ছেড়ে দিলে কাজ সফল হবে না।
একবার একজন মানুষ প্রায় সর্বস্ব খুইয়ে হতশায় আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। ভাবল মরার আগে যা সঙ্গতি আছে তাই দিয়ে যে ক’দিন বাঁচা যায় বেঁচে একেবারে নিঃস্ব হয়ে তারপর মরবে। গিয়ে হাজির হল জুয়ার আড্ডায় সব সেখানেই উড়িয়ে দেবে ভেবে। সেই জায়গায় গিয়ে জানতে পারল কাছাকাছি একটা জমি পড়ে আছে যেখানে ম্যাঙ্গানিজ়ের খনি আছে অনুমান করে বিস্তর খোঁড়াখুঁড়ি হয়েছে, কিন্তু ম্যাঙ্গানিজ়ের সন্ধান পাওয়া যায়নি। দু-তিনটি কোম্পানি খননকার্য চালিয়ে প্রায় ২৫০ ফুট গভীর গর্ত করে ফেলেছে, কিন্তু ম্যাঙ্গানিজ়ের সন্ধান না পেয়ে অগত্যা ঐ জমি এখন নিলামে বেচে দিতে চায়। কিন্তু জায়গাটা তো আর জমি নেই, ২৫০ ফুট লম্বা চওড়া ও গভীর গর্তে পরিণত হয়েছে। কে কিনবে অমন জমি? তাই আর খদ্দের জুটছে না। লোকটা দেখল পকেটে যা আছে তাই যৎসামান্য দিয়েই নিলামে জমিটা পাওয়া যাচ্ছে। ভাবল এমন নিষ্ফলা জায়গা কেনা আর জু্য়ায় দাঁও লাগানো একই ব্যাপার। কিনেই গেল। যেসব শ্রমিক কাজ করছিল, তাদের সেদিনের মতো মজুরি ঐ কোম্পানিগুলো দিয়েই রেখেছিল। নতুন মালিককে তারা যথাসময় অর্থাৎ বিকেল ৫টা পর্যন্ত কাজ চালিয়ে যাবে, নাকি তখনই থামাবে প্রশ্ন করায় লোকটা উত্তর দেয়, পারিশ্রমিক যখন পেয়েই গেছ, তখন বিকেল ৫টা পর্যন্ত কাজ করে তারপরেই যেও। তারপর ঠিক আরও ৩ ফুট খুঁড়তেই যে নমুনা পাওয়া গেল তা ম্যাঙ্গানিজ়ের আকরিক। সেই আত্মহত্যা করতে যাওয়া লোকটা অতঃপর শুধু ঐ ম্যাঙ্গানিজ় খনিরই নয়, ক্রমে একটা রেল কোম্পানিরও মালিকানা লাভ করে। গল্পটা আমেরিকার। ‘Readers’ Digest’ পত্রিকায় পড়া, শিরোনাম “The Difference between Success and Failure is 3 feet”। মাত্র ৩ ফুটের জন্য আসল খনি মালিক হতাশায় বঞ্চিত হল, আর সব আশা হারিয়ে ফেলা মানুষটা নতুন জীবনের সন্ধান পেল।
তাই আমাদেরও ক্লান্ত হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। আর করতে হবে সবার জন্যই। যারা অসুস্থ তারা সবাই আমাদের নিজেদের মানুষ। ভারতে যে ওষুধগুলির রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা ছিল, নিজের আর্থিক ক্ষতি করেও ভারত সরকার সেগুলো রপ্তানির অনুমতি দিয়েছে; কারণ আমরা মানুষে মানুষে ভেদাভেদ করি না। যে চেয়েছে, তাকেই ওষুধ পাঠানো হয়েছে। এটাই আমাদের স্বভাব। যারা অসুস্থ তাদের প্রত্যেকের সেবা করো। নিজেদের কীর্তি জাহির না করে সবার সঙ্গে মিলে সামগ্রিকভাবে কাজ করতে হবে। যাই করি বা অন্যদের দিয়ে করাই, তার আধার যেন হয় আপনাত্ম, স্নেহ, প্রেম। করব আপনজনের সেবা ভেবে, পরোপকার ভেবে নয়। বাল্মীকি রামায়ণে হনুমানের চরিত্রের স্তুতি করতে গিয়ে দেবতারা চারটি গুণের কথা বলেছেন – ধৃতি, দৃষ্টি, মতি ও রাক্ষ অর্থাৎ সাবধানতা। সাবধানতা আবশ্যক, কাজ করতে গিয়ে যাতে নিজেরা অসুস্থ না হয়ে পড়ি। তাই আয়ুষ মন্ত্রালয়ের তৈরি পাঁচন (কাঢ়া) নিয়মিত সেবন করব। তাছাড়া মাস্ক পরা, দূরত্ব বজায় রাখা, হাত ধোয়া, পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা – সবকিছুই করতে হবে যাতে আমরা কর্মক্ষম থাকি। সতর্ক থাকতে হবে, যাদের বাস্তবিক দরকার, ত্রাণ যেন তাদের কাছে পৌঁছায়। ধূর্ত সুযোগসন্ধানী লোকের অভাব নেই। তাই সজাগ থাকতে হবে তাদের জন্য প্রকৃত অভাবী মানুষ যেন বাদ না পড়ে।
কিছু সাধারণ নির্দেশাবলী থাকে। কিন্তু অবস্থাভেদে বিশেষ ব্যবস্থাও থাকা দরকার। তাই দলে থেকে দলের শৃঙ্খলা বজায় রেখেও পরিস্থিতি বিশেষের জন্য অনুশাসনে উপযুক্ত নমনীয়তা রাখতে হবে, যাতে ত্রাণ বা সেবা যাদের প্রয়োজন তাদের সবার কাছে পৌঁছায়। মাথায় রাখতে হবে এই ত্রাণ বা সেবা দিতে গিয়ে যেন তাদের সুআভ্যাসও গড়ে তুলতে পারি। বদঅভ্যাসের কারণেও কিন্তু অসুখ বিসুখ হয়ে থাকে। মানুষ নিজেও ইতিমধ্যে এটা উপলব্ধি করতে শুরু করেছে। তাই সুঅভ্যাসের প্রচার ও প্রসার করাটাও জরুরি। এটা শুধু একটি বিচ্ছিন্ন কর্মসূচী নয়, মানুষের জীবন গঠন ও সুরক্ষিত রাখার ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। আমাদের উদ্দেশ্য এক পবিত্র সমাজের সুরক্ষা ও সর্বাঙ্গীন উন্নতি। এই দৃষ্টিভঙ্গী মাথায় রেখেই কাজ করতে হবে। যতদিন দরকার ততদিন, নিরলসভাবে এবং অবশ্যই যথাযথ সুরক্ষা নিয়ে। বিদুর নীতিতে বলা আছে ’দোষ কাটানো’র কথা। যে পুরুষ নিজের বৈভব, বিজয় ও আনন্দ লাভ করতে চায়, তাকে ছটি দোষ থেকে মুক্ত থাকতে হয় – নিদ্রা, তন্দ্রা, ভয়, ক্রোধ, আলস্য ও দীর্ঘসূত্রতা। আলস্য ও দীর্ঘসূত্রতা নয়, চাই তৎপরতা। যখন যেমন পরিস্থিতির দাবি তখন সেইমতো কাজ করতে হবে। ভারতে এ ব্যাপারে ভালো কাজ হয়েছে, কারণ যথাসময়ে শাসন ও প্রশাসন উপযুক্ত ব্যবস্থা লাগু করেছে এবং সমাজের বিরাট অংশের মানুষও তা গ্রহণ করেছে। আলস্যের কারণে কাজ করতে গিয়ে ঝিমুনি চলে আসতে পারে। ঝিমুনি স্বাভাবিক হলেও তন্দ্রাচ্ছন্ন হলে মুশকিল, তন্দ্রায় মানুষ অসাবধান হয়ে পড়ে, বিচারবুদ্ধি কাজ করে না। প্রতিটি পদক্ষেপ ভেবেচিন্তে ও সজাগ থেকে নিতে হবে। সেই সঙ্গে ভয় ও ক্রোধকে জয় করতে হবে। লোকে ভয় পাচ্ছে পাছে তাকে ধরে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়। তাই লুকোনোর চেষ্টা করছে। নিয়ম নিগড়ে বাঁধলে ব্যক্তিগত অসুবিধা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ছে।
সঙ্ঘ মার্চ থেকে আগামী জুনের শেষ পর্যন্ত তার নিজস্ব কার্যক্রম স্থগিত রেখেছে। কারও কারও মনে হতে পারে, সরকার এই সুযোগে আমাদের কর্মসূচীতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। ওস্কানোর মতো লোকের অভাব নেই। এর ফলে ক্ষোভের জন্ম হয়, এবং সেখান থেকে অভিমান ও অতিসক্রিয়তা। আমরা জানি এর সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা অনেকেই করবে। কিছু লোক যদি ভয় ও ক্রোধ থেকে অসহযোগিতা করে রোগসংক্রমণ বিস্তার করেও থাকে, তাদের নিরিখে সমগ্র সম্প্রদায়কে বিচার করে দূরে সরিয়ে দেওয়াটাও ঠিক নয়। দোষী সর্বত্রই পাওয়া যায়। কিন্তু সর্বাসাধারণকে মনে রাখতে হবে এটা আমাদের দেশের হিতের প্রশ্ন, আমাদের সবার ভূমিকা সহযোগিতাপূর্ণ হতে হবে, বিরোধিতাপূর্ণ নয়। মনে দ্বিধা দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে দেশ -বিরোধী উস্কানি দেওয়ার, নিজেদের স্বার্থে ‘ভারত তেরে টুকড়ে হোঙ্গে’ ভাবধারার, রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার মতো লোক অনেক আছে। এসব যাদের করার তারা করবেই। কিন্তু এরা যাতে আমাদের ক্ষতি করতে না পারে, সে জন্য সতর্ক থাকতে হবে। এদের কারণে আমাদের মধ্যে প্রতিক্রিয়াবশত দ্বেষ বা প্রতিশোধস্পৃহা তৈরি হওয়া কাঙ্ক্ষিত নয়। মনে রাখতে হবে ভারতের একশো ত্রিশ কোটির সমাজ – সবাই ভারতমাতার সন্তান, আমাদের বন্ধু।
ভয় ও ক্রোধ কারও মনেই রাখা উচিত নয়। প্রত্যেক সম্প্রদায়ের নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিদের নিজেদের সম্প্রদায়কে এটা বোঝানোর দায়িত্ব নিতে হবে। আমরা প্রতিহিংসাপরায়ণ নই – এটা নিজেদের সমাজকে শেখাতে হবে। নাহলে কী হয় মহারাষ্ট্রে তা দেখলাম। দু’জন সন্ন্যাসীকে হত্যা করা হল। এ নিয়ে যে বিতর্ক হচ্ছে, তা সরিয়ে রাখছি। কিন্তু কিছু মানুষ নিজের হাতে আইন কেন তুলে নিল, পুলিসের কী কর্তব্য ছিল – এসব ভাবতে হবে। এই সংকটকালে মানুষের মনে স্বাভাবিকভাবেই অনেক ‘যদি কিন্তু’ জন্মাতে পারে। কিন্তু তার ফাঁদে পা না দিয়ে আমাদের সব ভেদাভেদ দূরে রেখে উস্কানি থেকে বেঁচে দেশহিতে সদর্থক ভূমিকা নিয়ে এগোতে হবে। ভয় ও ক্রোধ দুটোই পরিত্যাজ্য। দু’জন নিরুপদ্রব সন্ন্যাসীকে পিটিয়ে পিটিয়ে মারা হল, যাঁরা কারও কোনও ক্ষতি করেননি; নিজেরা ধর্মাচারণ করেন, ধর্মাচারণ শেখান, মানুষের সেবা করেন। সেই দুঃখ আমাদের সবার মনে আছে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এর প্রতিবাদ করেছে। ২৮ তারিখতারিখে ‘হিন্দুধর্মাচার্য সভা’ তাঁদের উদ্দেশে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিতে একটি কর্মসূচী রেখেছে। তা আমরা সবাই নিশ্চয়ই পালন করব। কিন্তু ধৈর্য রেখেই কাজ করতে হবে। কারণ এই অসুখ চলে যাবে। লকডাউনের প্রয়োজনীয়তাও ফুরিয়ে যাবে। কিন্তু যে অস্থিরতা অব্যবস্থা তৈরি হল, তা ঠিক করতে সময় লাগবে। আমরা দেখছি সামান্য বাঁধন আলগা সামান্য হলেই ভিড় জমে যাচ্ছে। অমনি সেখানে আবার কড়াকড়ি শুরু করতে হচ্ছে। এটা হতে পারে। কিন্তু সাধারণ মানুষকে দিশা দেখানোর মতো মানুষ দরকার।
এরপর বিদ্যালয় খুলবে। তখনও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা অত্যাবশ্যক। তা কীভাবে সম্ভব সমাজকে মিলিতভাবে ঠিক করতে হবে। স্কুলের আশেপাশে অল্পসংখ্যক ছাত্রছাত্রীর ক্লাস নেওয়া যায় কিনা, ই-ক্লাস নেওয়া সম্ভব কিনা, কীভাবে বিদ্যালয় শুরু করেও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা যায়, কলকারখানা অফিস-কাছারি চালু হলেও যাতে ভিড় না হয়, তার উপায় খুঁজে বার করতে হবে। পারস্পরিক দূরত্ব ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য চিন্তাভাবনা করতে হবে। ত্রাণ বণ্টন কম হতে পারে, কিন্তু অসুখ যেন না আবার হানা দেয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। উতলা না হয়ে সমাজের নেতৃবর্গকে এই দায়িত্ব নিতে হবে। এজন্য সদাচার ও সদ্ভাবের বাতাবরণ তৈরি করা দরকার। সমাজের জনমান্য ব্যক্তিদের একত্র করে এই বার্তা দিতে হবে। নিজেদেরই উদাহরণ হতে হবে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য আয়ুর্বেদিক পথ্য সেবনের পাশাপাশি যোগব্যায়াম, প্রাণায়াম ইত্যাদির নিয়মিত অভ্যাসের শৃঙ্খলা তৈরি করতে হবে। আত্মীয় স্বজনের মধ্যে ভীতি না ছড়িয়ে ঠাণ্ডা মাথায় কর্তব্য পালনের জন্য পরিবারের মধ্যেও উপযুক্ত সুসংস্কার গড়ে তোলা আবশ্যক। এই প্রচেষ্টাতেও নিজেদেরই উদাহরণ হতে হবে। নিজেদের সেবা দ্বারা পরেরও উপকার করতে হবে, সবার সহযোগিতাও আদায় করতে হবে।
বিগত কয়েক শতকে এই প্রথমবার সারা বিশ্বে একই সময়ে একই অসুখ আছড়ে পড়েছে। সংকট তো বটেই। কিন্তু এর থেকে কিছু শেখারও আছে। ক’দিন আগে প্রধানমন্ত্রী পঞ্চায়েত প্রধানদের বলেছেন, এই সংকট আমাদের স্বাবলম্বনের শিক্ষা দিচ্ছে। যে সুস্থিতি নষ্ট হল তা যথাসময়ে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এই সংকট থেকেও উপযুক্ত শিক্ষা নিয়ে নিজেদের জীবনকে সেইমতো পরিবর্তিত করতে হবে। সামনে গুরু দায়িত্ব। একদিকে রাষ্ট্র পুনর্নিমাণ করে অসম্পূর্ণ কাজগুলোকে পূর্ণতা দিতে হবে। অন্যদিকে বহু মানুষ শহর ছেড়ে নিজেদের গ্রামে ফিরে গেছে। সবাই ফিরে আসবে তো? যারা গ্রামে থেকে যাবে, তাদের রোজকারের ব্যবস্থা কী হবে? যারা কাজে ফিরতে চাইবে, তাদের পুনর্বহাল করার মতো অবস্থায় তাদের মালিকরা থাকবে তো? কারণ ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে তাদেরও লোকসান হয়েছে। এই অবস্থায় যাতে মানুষগুলোর রোজগার চালু থাকে, আবার সীমিত উপকরণে কাজ চালানো যায়, সে জন্য সবাইকে কিছু না কিছু ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। তার জন্য সচেতনতা তৈরি করা প্রয়োজন।
এই ‘স্বাবলম্বন’ই যদি সময়ের বার্তা হয়ে থাকে, তাহলে তার জন্য ‘স্ব আধারিত অবলম্বন তন্ত্র’-এর সাধনা আমাদের করতে হবে। কম শক্তি ব্যয় করা, উপার্জনমূলক প্রকল্প নেওয়া, পরিবেশ নষ্ট না করা এইসব চিন্তাধারা আমাদের মধ্যেই আছে। তার ভিত্তিতে যুগোপযোগী অর্থনীতি, বিকাশনীতি বা পরিকাঠামো ইত্যাদি রচনার উদ্যোগ আমাদেরই নিতে হবে। আধুনিক বিজ্ঞানের সবরকম সহায়তা নিয়ে ঐতিহ্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে উন্নয়নের নতুন মডেল নির্মাণ করতে হবে। শাসনব্যবস্থা ও প্রশাসনকে এসব চিন্তাভাবনা করতে হবে। কিন্তু শুধু এই দুই ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে থাকলে চলবে না। সমাজেরও কর্তব্য আছে। সমাজকেও স্বাবলম্বন বজায় রাখতে হবে। যেখানকার উৎপাদন, সেখানেই যথাসম্ভব ব্যবহার করা হোক। যা এখানে তৈরি হয় না সেটা ছাড়া যদি জীবন চালানো যায়, তাহলে সেভাবেই চলতে হবে। জীবনটাকে নিজের শর্তে ন্যূনতম উপকরণে চালাতে হবে। এই অভ্যাস নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনের নিয়মিত অঙ্গ করে তুলতে হবে। এজন্য ‘স্বদেশী অর্থনীতি’ অবলম্বন করা খুব জরুরি। স্বদেশী পণ্য উপলভ্য করতে হবে, ও তৎসহ স্বদেশী সামগ্রীর উৎকর্ষ নিয়েও কোনও সমঝোতা হবে না – এই মনোভাব তৈরি করতে হবে শিল্পপতি, নির্মাতা, কারিগর সবার মধ্যে। সমাজকে স্বদেশী নীতি অনুযায়ীই চলতে হবে। বিদেশের ওপর নির্ভরতা সমীচীন নয়।
এই যেমন আমরা বাইরে বেরিয়ে অনুভব করলাম বাতাস ইদানিং যথেষ্ট মাত্রায় নির্মল হয়ে গেছে। কারণ পরিবেশ দূষণকারী কর্মকাণ্ড বন্ধ আছে। আবার যখন জীবন অভ্যস্ত ছন্দে ফিরবে, তখন পরিবেশ দূষণকারী কোন কোন কাজ বন্ধ রেখেও আমাদের চলে যাবে, সেটা ভাবা দরকার। জলের ব্যবহার সংরক্ষণ ও শুদ্ধিকরণ, বৃক্ষরোপণ ও সংরক্ষণ, প্লাস্টিক বর্জন করে দূষণ প্রতিরোধ, পরিচ্ছন্নতা পালন, জৈবিক প্রক্রিয়া অবলম্বন যেমন গোপালন, প্রাচীনযুগের মতো সরল জীবনযাপন ইত্যাদির অভ্যাস আমাদের গড়ে তুলতে হবে। এজন্য রাসায়নিক কৃষি উপাদান ব্যবহারের প্রচলন বদলাতে হবে। সেজন্য পুরো সমাজকেই পাল্টাতে হবে। সরকারি নীতিও তেমনটা হবে। কিন্তু সমাজ সেই নীতি অনুযায়ী না চললে তো ফলাফল হবে শূন্য।
বাইরে দৌড়ঝাঁপ বন্ধ হওয়ায় পরিবারের মধ্যে একত্রে থাকার অভ্যাস তৈরি হয়েছে। এতে ব্যক্তি ও পরিবার উভয়েরই ভালো লাগা আছে। এর সুফল দারুণ – পারস্পরিক খোঁজখবর, বোঝাপড়া, সমমনস্কতা বৃদ্ধি পায়। তাই আত্মীয় কুটুম্বদের মধ্যে কীভাবে এই বোধ বিকশিত হয় তারও চর্চা হওয়া উচিত। আমাদের নিজেদের যেমন পরিবার আছে, তেমনি সমাজও আমাদের পরিবার। সমাজের নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে এই বোধ জাগ্রত হওয়া ও আলোচনা হওয়া বিশেষ জরুরি। সংস্কার ও শৃঙ্খলাবোধ খুব প্রয়োজন। ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত শৃঙ্খলা পালনের মধ্যে দিয়েই নাগরিক নিয়মানুশাসন রক্ষায় তৎপর হতে হবে। যেসব জায়গায় এই অনুশাসন পালিত হচ্ছে, সেসব জায়গায় করোনার প্রকোপ কম, আর যেখানে হচ্ছে না, সেখানে করোনার দাপটও বেশি। ভগিনী নিবেদিতা বলেছেন, দেশভক্তির প্রথম ধাপ হল নাগরিক অনুশাসন পালন। ডঃ আম্বেদকারও (Dr. Ambedkar) সংবিধান প্রণয়নকালে সংসদে ভাষণ দিতে গিয়ে নিয়ম শৃঙ্খলা পালনের ওপর জোর দেন। আমাদের এই সুশৃঙ্খল অভ্যাসকেই আরও সতেজ ও ধারালো করতে হবে। একই সঙ্গে সমাজে সদ্ভাব, শান্তি ও সহযোগিতার বাতাবরণও বজায় রাখতে হবে। সরকারকে তো সংস্কারমূলক শিক্ষানীতি শীঘ্রই আনতে হবে, আনতেই হবে; কারণ সরকারের নীতি, প্রশাসনের প্রয়োগ ও সমাজ আচরণে তার পালন – এই তিন মিলিয়েই দেশ সচল থাকবে। শাসন অর্থাৎ সরকার যেমন দিক-নির্দেশ করবে, রাজনীতিকেও তেমনি নিজের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জনহিতে নিবেদিত হতে হবে। শিক্ষার নীতিও তার অনুসারী হবে। একইভাবে সমাজের ব্যবহারও অনুরূপ হওয়া চাই।
ভবিষ্যতের জন্য এই সংকট যে বার্তা দিয়ে যাচ্ছে, তা যেন নিজেদের জীবনাচরণে প্রতিফলিত করতে পারি। আমরা সবাই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নিজেদের মানুষ ও সমাজকে এই সংকট থেকে মুক্ত করে যেন দেশকে বিশ্বমানবতার নেতৃত্ব দানের জায়গায় নিয়ে যেতে পারি। দরকার সতত পরিশ্রম, ইতিবাচক চেষ্টা ও সক্রিয়তা। এই সংকটকেই নতুন ভারতের উত্থানের সুযোগে পরিণত করতে হবে। আমার যা বিচারধারা, তা আপনাদের সামনে রাখলাম। সঙ্ঘের সেবকরা তো পালন করবেই, সেইসঙ্গে সমগ্র সমাজেরও তা করা কর্তব্য।
অনুলিখন: শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়