রি-ইনফেকশন নাকি রি-অ্যাকটিভেশন? সত্যি সেরে ওঠার পর পুনঃসংক্রমণ হয়েছে, নাকি শরীরে ঘাপটি মেরে থাকা রোগজীবাণু ফের মাথাচাড়া দিয়েছে? উত্তরবঙ্গে করোনামুক্ত হয়ে চারজনের দেহে নতুন করে একই রোগের প্রাদুর্ভাবের ঘটনা খতিয়ে দেখতে শুরু করেছে রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তর। তলব করা হয়েছে চার জনের যাবতীয় সোয়াব টেস্টের রিপোর্ট।
‘সেরে ওঠা’ রোগীদের পুনরায় সংক্রমিত হওয়া প্রসঙ্গে বিশ্বের বিজ্ঞানীমহল কার্যত দ্বিধাবিভক্ত। একদলের মতে, অ্যান্টিবডি দুর্বল হয়ে গেলে পুনরায় সংক্রমণ হতেই পারে। অন্য শিবিরের বক্তব্য, করোনার জীবাণু কিছুদিন মানবকোষে লুকিয়ে থাকতে পারে। এবং অনুকূল পরিবেশ পেলে ফের বংশবিস্তার আশ্চর্যের নয়।
বস্তুত, করোনা জীবাণুর এই ‘লুকিয়ে থাকা’র ক্ষমতা নিয়েই শুরু হয়েছে বিতর্ক। এ সবের মাঝে একদল আবার নমুনা পরীক্ষায় যান্ত্রিক ত্রুটির সম্ভাবনার কথাও তুলে ধরছেন। তাঁদের বক্তব্য, আরটিপিসিআর (RT-PCR) মেশিনেও ফলস পজিটিভ বা ফলস নেগেটিভ হতে পারে। কোভিড ভাইরাসের ‘আত্মগোপন’ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা হারপিসের উদাহরণ টানছেন। তাঁদের পর্যবেক্ষণ, হারপিস একটি ‘ডিএনএ’ ভাইরাস, যা কিনা মানবকোষের নিউক্লিয়াসের মধ্যে সেঁধিয়ে থাকতে পারে। দশ-বারো বছরও লুকিয়ে থাকার নজির রয়েছে। অনুকূল পরিবেশে সে আবার সক্রিয় (Active) হতে পারে। যাকে ‘লেটেন্ট ইনফেকশন’ অর্থাৎ ‘পারসিসটেন্ট ইনফেকশন’ বলা হচ্ছে। HIV’র মতো ভাইরাসেরও নিউক্লিয়াসে গা ঢাকা দেওয়ার ক্ষমতা আছে। RNA ভাইরাস হলেও রিভার্স ট্রান্সক্রিপটেজ এনজাইমের সাহায্যে এইচআইভি’র RNA কমপ্লিমেন্টারি DNA তৈরি করে রেপ্লিকেশনের সময় কোষের ডিএনএ-তে যুক্ত হয়। পরবর্তীকালে অপত্য তৈরি করে।
ঘটনা হল, নভেল করোনাও আরএনএ ভাইরাস। যদিও এইচআইভি-র মতো তার ডিএনএ তৈরির ক্ষমতা নেই। সুতরাং হারপিস বা এইচআইভির মতো লুকিয়ে থাকার প্রবণতা করোনা ভাইরাসের না থাকার সম্ভাবনাই বেশি বলে বিজ্ঞানীদের একাংশের পর্যবেক্ষণ। তবে কি SARS-CoV-2′ র ল্যাটেন্ট ইনফেকশেনর ক্ষমতা শূন্য? ভাইরোলজিস্ট ডা. সিদ্ধার্থ জোয়ারদার জানিয়েছেন, কোনও সম্ভাবনাই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। নিউক্লিয়াসে না ঢুকলেও কিছু টার্গেট সেলের সাইটোপ্লাজমের মধ্যে করোনা থেকে যেতেই পারে। কিন্তু এই নিয়ে আরও অনেক গবেষণার প্রয়োজন। তাই করোনাজয়ীদের সাবধানে থাকাই শ্রেয়।
তবে কি উত্তরবঙ্গের চারজন ল্যাটেন্ট ইনফেকশন’এর শিকার? সিদ্ধার্থবাবুর পর্যবেক্ষণ, আরএনএ ভাইরাস সংক্রমিত ব্যক্তির কোষে লুকিয়ে থাকতে পারলেও রেপ্লিকেট করতে পারে না। কিন্তু পজিটিভ রিপোর্ট দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। আসলে, কোনও ব্যক্তি আক্রান্ত হয়েছে মানেই তাঁর প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল, এটা ধরে নেওয়াই যায়। অ্যান্টিবডি তৈরি হলেও তা পুনঃসংক্রমণ নাও ঠেকাতে পারে। করোনার মতো ‘হাইলি মিউটেডেড’ ভাইরাসের ক্ষেত্রেও পুনঃসংক্রমণের সম্ভবনা রয়েছে।
উত্তরবঙ্গের ঘটনার পর স্বভাবতই নড়েচড়ে বসেছেন স্বাস্থ্যকর্তারা। চারজনেরই প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বের কোভিড পরীক্ষার সমস্ত রিপোর্ট তলব করেছে স্বাস্থ্য দপ্তর। স্বাস্থ্য অধিকর্তা ডা. অজয় চক্রবর্তী বলেছেন, “প্রথম করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট যদি ঠিক হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে, ওই চার জনের প্রোটেক্টিভ অ্যান্টিবডি তৈরি হয়নি। তবে এমন ঘটনা অসম্ভব নয়।” তিনি আরও জানাচ্ছেন, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এমন নজির মজুত। তবে দেখতে হবে, ডেঙ্গুর মতো কোভিডেরও দ্বিতীয়বার সংক্রমণ হলে কতটা মারাত্মক হতে পারে। দ্বিতীয়বার সংক্রমণের আগে ওই চারজন কাদের সংস্পর্শে এসেছিলেন, তা-ও খুঁজে বার করতে হবে।