ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে আমেরিকার বাইয়োজেন নামে একটি জৈব প্রযুক্তি সংস্থা বোস্টনে একটি সমাবেশ করেছিল। সারা বিশ্ব থেকে ১৭৫ জন এই সংক্রান্ত সংস্থার উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের যোগদানের মধ্যে ইতালি থেকেও ২ জন ছিলেন। এক সপ্তাহে কাটার আগেই এদের মধ্যে ৭০ জন করোনা ভাইরাস রোগে আক্রান্ত হন। ম্যাসাচুসেটসে এক ধাক্কায় এত বড়ো সংক্রমণ কখনও দেখা যায়নি। আমার পুত্র প্রসিদ্ধ ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির প্রধান কার্যালয়ের থেকে ৫ মিনিটের দূরত্বে থেকে পড়াশোনা করে। ম্যাসাচুসটসে সম্পূর্ণ জরুরি অবস্থা জারি হওয়ায় ও সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ায় সে এখন গৃহবন্দি।
অতীতের মহামারীগুলি থেকে কিন্তু শিক্ষাগ্রহণ জরুরি। ১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফু’র আক্রমণের সময় মার্কিন দেশের সেন্ট লুইস রাজ্যে মৃত্যুর হার ফিলাডেলফিয়ার থেকে অর্ধেক ছিল। এর কারণ দ্বিতীয় রাজ্যটিতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমর্থনে বড়ো বড়ো সভা করা হয়েছিল। কিন্তু সেন্ট লুইস সব ধরনের সমাবেশ নিষিদ্ধ করে দেয়। সেখানকার সমস্ত চার্চসমেত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও বন্ধ ছিল। এই প্রথমেই নেওয়া কড়া পদক্ষেপ হাজার হাজার মানুষের প্রাণ বাঁচানোর সহায়ক হয়।
এ প্রসঙ্গে বলি, আমার দ্বিতীয় পুত্রটি আমেরিকার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে। তার সংখ্যাতত্ত্ব বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করা সহপাঠীরা কিছু পর্যবেক্ষণ করেছে। তাদের মতে সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, হংকং, থাইল্যান্ড, জাপান প্রভৃতি দেশগুলো চীনের সঙ্গে লেনদেনে যথেষ্ট জড়িত ও নিকটবর্তী হওয়া সত্ত্বেও করোনার সংক্রমণ সেখানে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়েনি (www.it.ly/2TG9fsi)। এর অন্যতম কারণ এই দেশগুলি ২০০৩ সালে SARS মহামারির আক্রমণ থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিল। কত তাড়াতাড়ি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে ভাইরাল ইনফেকসনের ছড়িয়ে পড়া ঠেকানো যায় সেটা খুঁজতেই তারা সোশ্যাল ডিসটেন্সিং বা সামাজিক দূরত্বের তত্ত্ব খুঁজে পায়।
ইতালি, ইরান, ফ্রান্স, জার্মানি বা স্পেন সংক্রমণ আটকাবার ব্যবস্থা নিতে অযথা দেরি করায় তাদের দেশে আক্রান্তের সংখ্যা পূর্ব এশিয়াকে ছাপিয়ে যায়। সৌভাগ্যক্রমে ভারত বিদেশি আগমনের ক্ষেত্রে শুরুতেই প্রতিবন্ধকতা জারি করায় তা অন্য দেশগুলির মনঃপুত না হলেও কিছুটা ফলদায়ী হয়েছে।
হ্যা, মৃত্যুর হার তিন শতাংশকে অধিকাংশ মানুষই অত্যন্ত নগণ্য বলে মনে করছেন। কিন্তু ভারত এক অতি বিশাল দেশ, এখানে করোনার মতো ভয়ানক ছোঁয়াচে রোগের প্রকোপ এই প্রথম মেকাবিলা করতে হচ্ছে। একজন করোনায়। সংক্রামিত আরও তিন জনকে সংক্রামিত করতে পারেন যাঁরা আরও ১৪ দিন। সংক্রমণের সম্ভাবনা নিয়ে দিন কাটাবেন। এই লেখার সময় ভারতে আক্রান্তের সংখ্যা ১০৭। এর মধ্যে ৫ শতাংশ আইসিইউ-তে ভর্তি হওয়ার যোগ্য এবং ১ শতাংশের ক্ষেত্রে ভেন্টিলেটার সার্পোট ছাড়া শ্বাসপ্রশ্বাস সম্ভব নয়। যে সমস্ত মানুষের শরীরে উচ্চ রক্তচাপ, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস। রয়েছে বা যাদের বয়স ৭০-এর আশেপাশে বা ঊর্ধ্বে তারা এ রোগের সহজে শিকার হতে পারেন। দেশের অধিকাংশ হাসপাতালেই জরুরি চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার কারণে এই ধরনের শয্যাগুলি ভর্তিই রয়েছে। আমরা কিন্তু ইতিমধ্যেই মহামারীর কবলে পড়ে গেছি। একটা জিনিসই আমরা করতে পারি তাহলো সংক্রমণ ছড়াতেনা দেওয়া যাতে আমাদের হাসপাতালগুলিতে নিতান্ত মরণাপন্নকে বাঁচানোর কিছুটা অন্তত স্থান থাকে।
আবার বলছি, এটা ভাবা ভুল যে ভারতের আসন্ন উষ্ণ আবহাওয়া আমাদের পরিত্রাণ করবে কিংবা আমাদের ভাইরাল রোগের ক্ষেত্রে এক ধরনের অন্তর্নিহিত প্রতিষেধক আছে। উলটে যদি আমরা অন্য দেশগুলির মতোই হই, দেখা গেছে প্রত্যেক দেশেই একটি দুটি সংখ্যা দিয়ে শুরু হয়ে আক্রান্তের বন্যা বয়ে গেছে। ভারতের জনবসতির যে ঘনত্ব সেখানে গোষ্ঠী সংক্রমণ ছড়ালে বিশাল বোমা ফাটার প্রতিক্রিয়া হবে। বহু বিষয়ের বিশেষজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ জার্মান রাজনীতিকঅ্যাঞ্জেলা মারকেল বলেছেন আমাদের মধ্যে২০ থেকে ৬০ শতাংশ আক্রান্ত হবে।
আমাদের কাছে একটিই মাত্র বাঁচার ছোট্ট জানালা খোলা আছে তা হলো সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা যাতে সংক্রমণের সংখ্যা কমানো যায়। অবশ্যই আমরা হয়তো চীনের মতো সম্পূর্ণ লকডাউন বা দেশ বন্ধ করে দেওয়ার মতো ব্যবস্থা নিতে পারব না কিন্তু কয়েকটি সাধারণ সাবধানতা আমাদের গ্রহণ করতেই হবে।
(১) সমস্ত রকমের যাত্রা সে দেশের মধ্যে হোক বা বিদেশ, ট্রেন হোক বা বাস একেবারেই নিষিদ্ধ করতে হবে। দীর্ঘ পথ কোনো না কোনো যানবাহনে ভ্রমণ এই রোগ সংক্রমণের প্রধান সহায়ক।
(২) একটা ছোটো জায়গার মধ্যে বেশি সংখ্যক লোকের যেখানে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে তা এড়িয়ে চলা। এর মানে স্কুল, ব্যায়ামাগার, মল, খোলা বাজার, পানশালা, থিয়েটার, সিনেমা, মন্দির, অন্যান্য প্রার্থনা স্থল, সাঁতার-পুকুর সবই পড়বে।
(৩) বাড়িতে থেকে কাজ করতে হবে। উপায় নেই অফিস বা কারখানায় একত্রে কাজ করলে অন্যের দ্বারা সংক্রামিত হওয়ায় সম্ভাবনা তো থেকেই যায়।
(4) নিতান্তই যদি কর্মস্থলে পৌঁছতে হয় তাহলে অন্তত ৬ ফুট দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। ক্যান্টিনে যাওয়ার দরকার নেই। বাইরের যাদের সঙ্গে বৈঠক করার কথা ছিল সেগুলি বাতিল করতে হবে। দশ জনের বেশি একসঙ্গে থাকার দরকার নেই।
(৫) পূর্ব নির্ধারিত যে কোনো ধরনের সম্মেলন, খেলাধুলোর কর্মসূচি, মেলা, মিছিল, পথসভা, ক্রিকেট ম্যাচ দেখা বাদ দিতে হবে। এগুলি মহামারী ছড়িয়ে দেওয়ার প্রবল সম্ভাবনাময়।
এই সূত্রে আমি কর্ণাটক সরকারকে অবশ্যই ধন্যবাদ জানাবো, তারা সকলের আগে এই পদ্ধতিগুলি সাহস করে নিয়েছে। একই সঙ্গে দেশের অন্য রাজ্যগুলিকেও কর্ণাটককে অনুসরণ করতে বলব। একটি রাজ্য সরকারকে যদি ধরে নিতে হয় মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ আক্রান্ত হতে পারে, সেখানে ব্যঙ্গালুরুর মতো শহরেই ৫০০০ ক্রিটিক্যাল কেস-এর শয্যা থাকা জরুরি হয়ে পড়বে যার সঙ্গে অক্সিজেনের ব্যবস্থা থাকা তো অপরিহার্য।
এ কথাটাও মাথায় রাখা জরুরি যেহেতু করোনা ভাইরাসের রোগীরা সংক্রমণবাহক, তাই তাদের অন্যান্য রোগীর সঙ্গে সাধারণ হাসাপাতালে চিকিৎসা করানো চলবে না। প্রত্যেক রাজ্য সরকারেরই উদ্যোগ নেওয়া উচিত কোনো নির্দিষ্ট হাসপাতালকে এই রোগের জন্য চিহ্নিত করা এবং অব্যবহার্য হয়ে পড়ে থাকা পুরনো কোনো হাসপাতালকে সংস্কার করে করোনা রোগীর জন্য অন্তর্বিভাগ ও বহির্বিভাগ চালু করা। যেটি হবে কেবল করোনা হাসপাতাল। কর্ণাটকে বহু বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য চিকিৎসা সহায়ক যন্ত্রপাতি নিয়ে সরকারকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে। এগুলি করোনা। স্পেশালিটি হাসপাতাল বলে লোকে জানছে।
দু সপ্তাহের স্বল্প সময়ের মধ্যে ইতালিতে দু’শো থেকে দশ হাজার করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। এর প্রধান। কারণ প্রাথমিকভাবে আক্রান্ত রোগীরা রোগের উপসর্গ কিছু ধরতেই পারেননি। নির্দ্বিধায় তারা রোগের বীজাণু নিজের থেকে অপরের শরীরে ছড়িয়ে ফেলেছেন। করোনার পরীক্ষার মূল উদ্দেশ্য লক্ষণ ধরা পড়লেই আলাদা করে রাখা। সেই কারণে সরকার অনুমোদিত ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠিত প্যাথোলজিক্যাল পরীক্ষাকেন্দ্রগুলিতে এখনই বিনামূল্যে পরীক্ষা করার ব্যবস্থা চালু করা দরকার। দক্ষিণ কোরিয়া ও ইতালিতে ঠিক একই সময়ে এই মহামারী শুরু হয়। দক্ষিণ কোরিয়া বস্তুত সমস্ত নাগরিককেই পরীক্ষাধীন করেছিল এবং যাদের শরীরে রোগ লক্ষণ ধরা পড়েছিল তাদের সংস্পর্শে আসা প্রায় সমস্ত মানুষজনের পেছনে ধাওয়া করে তাদের সকলকে আটকে ফেলে। এর নাটকীয় ফল মিলেছিল। হায়! ইতালি এসবের ধার দিয়েও যায়নি, পরিণতি হয়েছে বিধ্বংসী।
আর একটি বিষয়, বিশ্বজুড়ে চিকিৎসা সংক্রান্ত কাজে নিযুক্ত কর্মীদের জন্য প্রতিরক্ষামূলক সাজসরঞ্জামের খুবই অভাব দেখা দিয়েছে। অধিকাংশ দেশ এই সমস্ত সামগ্রীর রপ্তানি ইতিমধ্যেই বন্ধ করেছে। ভারতীয় এন-৯৫ মুখোশ উৎপাদনকারী সংস্থাগুলিকে উপযুক্ত ভরতুকি দিয়ে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় উৎপাদন বৃদ্ধি করাতে হবে। চিকিৎসা কর্মীরা অসুস্থ হয়ে পড়লে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।
এই সূত্রে যে ৫০ হাজার বিদেশে পাশ করা ডাক্তার ভারতে এসে লাইসেন্সের জন্য অপেক্ষা করছে তাদের অস্থায়ীভাবে অনুমোদন দিয়ে প্রবীণ ডাক্তারবাবুদের অধীনে কাজ করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এরা সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলির কেবলমাত্র ক্রিটিক্যাল কেস ইউনিট এই কাজ করবে। এটা করতে পারলে দু’ সপ্তাহের মধ্যেই তারা জাতির এই ব্যধি-বিপর্যয় মোকাবিলায় এক মহামূল্য সম্পদ হয়ে উঠবে।
ডা. দেবী শেঠী