রান্না করা নিয়ে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি যে একেবারে বদলায়নি তা নয়। কথায় বলে, বড়ো কোনও পরিবর্তন আনতে গেলে, নিজের ঘর থেকেই শুরু করতে হয়। আজকের প্রজন্ম অনেক সচেতন, লিঙ্গরাজনীতির ঊর্দ্ধে সমান্তরাল পৃথিবীকেই তারা মান্যতা দিতে চাইছে। পরিচিত এক তরুণ কবি-শিক্ষক যেমন বলছিলেন, তিনি রান্না করতে পারেন না, কারণ ছোটোবেলা থেকে তাঁকে হেঁশেলের ধারে কাছে ঘেঁষতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু, প্রতিদিন নিয়ম করে যেকোনও একটা পদ রান্না করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর কথায়, জীবনসঙ্গী চাকুরীজীবী হয়েও সংসারের জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবটাই করেন। তাই, তিনি কী পারেন বা পারেন না, অতকিছু না ভেবে জীবনসঙ্গীকে যতটা সম্ভব সাহায্য করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। শুধু রান্না নয় রান্নার প্রি-প্রোডাকশন/পোস্ট-প্রোডাকশন, মানে রান্নার জোগাড় থেকে শুরু করে রান্নার পর রান্নাঘর পরিচ্ছন্ন রাখা সবটাই আস্তে আস্তে রপ্ত করছেন।
যাঁরা মনে করেন রান্না বা রান্নাঘর মানেই ‘মেয়েলি’ ব্যাপার, তাঁরা হয় জানেন না নয় তো ভুলে যান এ দেশে খানসামা, রান্নার ঠাকুর বা শেফদের সুদীর্ঘ ইতিহাস। কলকাতার খাদ্যরসিকরা রাঁধুনি বা খানসামাদের শুধু মনেই রাখেননি, তাদের নামে বিভিন্ন রাস্তার নামও দিয়েছেন। যেমন- ছকু খানসামা লেন, চমরু খানসামা লেন, পাঁচু খানসামা লেন, করিম বক্স খানসামা লেন, নিমু খানসামা লেন, মিসরী খানসামা লেন, পিরু খানসামা লেন, গদাই খানসামা লেন রাস্তাগুলো উল্লেখযোগ্য। শুধু রান্না কেন, বাজার-হাট, কুটনো কাটা, মশলা বাটা যুগ যুগ ধরে সবেতেই সিদ্ধহস্ত পুরুষরা। সাহিত্য–সিনেমায় বারবার ধরা পড়েছে সে দৃশ্য। অন্যদিকে, মহিলারা যতই রন্ধনপটিয়সী হোন না কেন, তাদেরকে সবসময় ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যেই দেখা গিয়েছে। কোনও অনুষ্ঠান, প্রীতিভোজ বা হোটেল – বাড়ির বাইরে বেরিয়ে বড়ো পরিসরে একসঙ্গে অনেকের রান্না করার ক্ষেত্রে পুরুষ রাঁধুনী বা শেফদেরই দেখা গেছে এতদিন। কিছু ব্যতিক্রম থাকলেও, প্রাচীনকাল থেকে এই রীতিই চলে এসেছে।
অভিজ্ঞ ‘শেফ’ হিসেবে দেশে-বিদেশে সুনাম রয়েছে তারাতলা আইএইচএম (Institute Of Hotel Management)-এর প্রাক্তনী, কৃতি ছাত্র রঙ্গন নিয়োগী’র (Rongon Neogi)। বহু বছর বেশ কিছু নামী হোটেলের শেফ হিসেবে কাজ করার পর, এখন ক্যাটারিং-এর ব্যাবসায় মন দিয়েছেন। ‘কন্টিনেন্টাল ক্যাটারিং সার্ভিস’-এর প্রণেতা তিনি। রান্না বিষয়ক একাধিক বই লিখেছেন অন্যান্য দেশ বিশেষত, বাংলাদেশ-এর সঙ্গে তাঁর বিশেষ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে রান্না-কে কেন্দ্র করে। পড়ানো, কর্মশালা, বক্তৃতা তো আছেই তার সঙ্গে টেলিভিশনে বিভিন্ন রান্নার অনুষ্ঠান, রান্নার প্রতিযোগিতার প্রধান বিচারক হিসেবে প্রায়ই যেতে হয় সেদেশে। তাঁর কাছে জানতে চাইলাম পেশা হিসেবে ‘রান্না’ বেছে নেওয়ার জন্য ব্যক্তিগত ভাবে কখনও কোনও কটুক্তি শুনতে হয়েছে কিনা, অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছে কিনা… কারণ তিনি যে সময় আইএইচএম-এ ভর্তি হন, সমাজের চিন্তাভাবনা তো আজকের মতো ছিল না।
রঙ্গনবাবু বললেন, “না, তেমন কিছু আমায় শুনতে হয়নি। অনেকেই বলেছিল ‘পড়াশোনা করে শেষে রান্নার কাজ করবি!’ আসলে সেসময় অনেকেরই ধারণা ছিল না, হোটেল ম্যানেজমেন্ট মানে শুধু তো রান্নার কাজ নয়, প্রায় চোদ্দ-পনেরো রকম কাজ আছে। অ্যাকাউন্টস আছে, হাউস কিপিং-হসপিটালিটি আছে, রেস্টুরেন্ট কাউন্টার সার্ভিস, ইঞ্জিয়ারিং-এর একটা অংশ আছে, কুকারি-বেকারি ইত্যাদি অনেক ভাগ আছে। রান্না তো একটা শিল্প—রন্ধনশিল্প যে কারণে বলা হয়। এর জন্য ধৈর্য, পরিশ্রম, অধ্যাবসায় লাগে। হোটেলে রান্নার ক্ষেত্রে উপযুক্ত ট্রেনিং-পড়াশোনা ছাড়াও বিভিন্ন দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য-আদব-কায়দা-স্বাদ সম্বন্ধে ধারণা থাকা আবশ্যিক। মা খুব ভালো রান্না করতো, ছোটোবেলা থেকে রান্না করার প্রতি ঝোঁক তৈরি হয়েছিল সেখান থেকেই। সেই ঝোঁকের জন্যই ‘শেফ’ হিসেবে পড়াশোনা করেছি। সবথেকে বড়ো কথা এটা নিয়ে বাড়িতে কোনও চাপ ছিল না, কেউ কখনও বলেনি ডাক্তার-ইঞ্জিয়ার হতে। আইএইচএম-এর টপার ছিলাম। জার্মানিতে কন্টিনেন্টাল কুকারি (Continental Cookery)-র ওপর পড়াশোনা করেছি। আগে অন্যান্য পেশার বন্ধুবান্ধবরা ইয়ার্কি করে ‘রাঁধুনি’ বলে ক্ষ্যাপাতো, এটুকুই।”
খানসামা, রান্নার ঠাকুর, হোটেলের শেফ মানেই পুরুষ কিন্তু বাড়িতে রান্নার কথা হলেই আগে মহিলাদের কথা মনে পড়ে কেন? আজও কি এই ‘ট্যাবু’ থেকে আমরা বেরতে পারিনি?
“রান্নার সঙ্গে এখন আর ‘মহিলা/পুরুষ’ ট্যাবুর কোনও সম্পর্ক নেই। সময়, সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টেছে। প্রচুর ছেলে-মেয়ে হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়ছে, তাদের মধ্যে অনেকেই পেশা হিসেবে ‘রান্না’ বেছে নিচ্ছে। বড়ো বড়ো হোটেলে আগে শেফ (Chef) হিসেবে শুধু পুরুষরাই প্রাধান্য পেত, এখন মহিলারাও পাচ্ছেন। হোটেলের যেকোনও উচ্চ পদে এখন পুরুষদের পাশাপাশি মহিলাদেরও দেখা যাচ্ছে। মধুমিতা মৈত্র এখন দ্য ললিত গ্রেট ইস্টার্ন (The LaLiT Great Eastern)-এর এক্সেকিউটিভ শেফ (Executive Chef)। সুতরাং বলাই যায়, ভেদাভেদের দিন আর নেই।” বলেন রঙ্গনবাবু।
রঙ্গনবাবুর কথার রেশ টেনে বলি, এ প্রজন্ম কিন্তু রান্না করা নিয়ে সত্যিই বেশ মুক্তমনা। এ প্রজন্ম সুইগি-জোম্যাটো থেকে অর্ডার করা রেডিমেড খাবার খেতে জানে, আবার নিজে রান্না করা নিয়েও তাদের ছুৎঁমার্গ নেই। উল্লেখ্য, লকডাউনের সময় অনেকের মধ্যেই এই অ্যাক্টিভিটি গড়ে উঠতে দেখা গেছে। এখন তো নতুন প্রজন্মের মধ্যে রান্না বা খাবারকে কেন্দ্র করে স্টার্ট-আপের প্রবণতা বেড়েছে। সদ্য ২১-এ পা দেওয়া ইঞ্জিয়ারিং-এর ছাত্র আর্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “ছোটো থেকেই গানবাজনার প্রতি আমি দুর্বল। আর একটা দুর্বলতা হল রান্না। সময়-সুযোগ পেলেই কিছু না কিছু রান্না করি। আমার প্রথম পছন্দ বাঙালি-কুইজিন। খুব ভালো লুচি, হিং দিয়ে আলুর তরকারি, মাটন কষা করতে পারি। মায়ের রান্না দেখে শিখেছি এমন নয়, ভালো লাগে রান্না করতে তাই ইউটিউবে প্রচুর রান্নার ভিডিও দেখতাম, একটা বেসিক ধারণা তৈরি হয়ে যায়। বিশেষ বিশেষ রান্নার ক্ষেত্রে মা বা দিদার পরামর্শ নিই।”
পরিশেষে বলি, শুধু পুরুষ-মহিলা বলে নয়, জেন্ডার ভেদে আলাদা ভাবে শেখার কোনও বিষয় নেই। কিছু দক্ষতা বোধ হয় প্রতিটা মানুষেরই থাকা উচিত। রান্না করতে পারাও একটা দক্ষতা – লিঙ্গ নির্বিশেষে এই দক্ষতা থাকা জীবনকে সহজ করে দেয়।