গোধরা কাণ্ডের নেপথ্যে ছিল ষড়যন্ত্র

সবরমতী এক্সপ্রেস। বেশিরভাগ যাত্রীই করসেবক বা রামসেবক এবং গুজরাটের বাসিন্দা। তাঁরা ফিরছেন অযোধ্যা থেকে, যে অযোধ্যায় প্রায় এক দশক আগে বাবরি ধাঁচা গুড়িয়ে দিয়েছিল বিশ্ব হিন্দু পরিষদ নিয়ন্ত্রিত রামসাধক আর বজরং দলের সদস্যরা।
যাত্রীরা বেশ ক্লান্ত। দীর্ঘ ১২০০ কিলোমিটার ট্রেন-যাত্রায় তারা বিধ্বস্ত। খিদেয়-পিপাসায় কাতর। ট্রেন ঢুকেছে। গোধরায়। আমেদাবাদ আসতে আর বেশি দেরি নেই। বাড়ি ফেরার তাড়নায় তারা অস্থির। বিশেষ করে শিশুরা যাঁরা অযোধ্যাকাণ্ডের সময় এই পৃথিবীর আলোই দেখেনি।
মাত্র মিনিট পাঁচেক। সবরমতী এক্সপ্রেসের বাঁশি বেজে উঠল। ট্রেন ছাড়ল আমেদাবাদের উদ্দেশে। পশ্চিমদিকে।
বড়ো জোর ৭০০ মিটার গড়িয়েছে ট্রেনের চাকা। আচমকাই থেমে গেল। সবরমতী এক্সপ্রেস। ফালিয়া সিগন্যালের কাছে। সিগন্যাল সবুজ। থামার কথা নয়। তাহলে…? যাত্রীরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ট্রেনের কামরাগুলোয় এসে পড়তে লাগল পাথরের টুকরো, আধলা ইট। জানলার কঁচ ভেঙে ইট-পাথর লাগছে যাত্রীদের গায়ে, মাথায়। আচমকা আক্রমণে বিভ্রান্ত যাত্রীরা। ব্যাপারটা কী?
জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রক্ত হিম হয়ে গেল তাদের। প্রায় দু’হাজার মানুষ ঘিরে ধরেছে ট্রেনের বিভিন্ন কামরা। বিশেষ করে কামরা নম্বর এস-৬, যেখানে অযোধ্যা-ফেরত তীর্থযাত্রীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। তারা পাথর ছুঁড়ছে আর আওয়াজ উঠছে– ‘মারো, কাটো, জ্বলা ভিদো। কাছেই কোনও মসজিদ থেকে ভেসে আসছে মাইকের নির্দেশ—একটা হিন্দুকেও ছাড়বে না। মেরে কেটে টুকরো টুকরো করে জ্বালিয়ে দাও। ইসলাম বিপন্ন।’
এখানে ট্রেন থামার কথা নয়। কেউ না কেউ নিশ্চয়ই আপতকালীন চেন টেনে। থামিয়েছে ট্রেনটিকে এবং দুষ্কৃতীদের কেউ কেউ এ কাজ করেছে পূর্বপরিকল্পিতভাবে গোধরা থেকেই ট্রেনে উঠে।
কামরায় কামরায় আক্রান্ত যাত্রীদের পরিত্রাহী রব— বাঁচাও বাঁচাও। কিন্তু কে বাঁচাবে? ইঞ্জিনের সামনে লাইনের ওপর শত শত মানুষ। ট্রেনের গার্ড সাহেব আপতকালীন চেন রিসেট করে ট্রেন। চালাবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু উন্মত্ত জনতার তাড়ায় তিনি তাঁর কামরায় উঠে দরজা বন্ধ করে ভয়ে ঠকঠক করে কাপছেন।
যাত্রী কামরায় তখনও চলছে অনর্গল পাথর বৃষ্টি। কঁাচ ভাঙা জানালায় ব্যাগ সুটকেস দিয়ে আড়াল করেও রেহাই মেলেনি। কারণ ততক্ষণে এস-৬ কামরা জ্বলে উঠেছে পেট্রলের আগুনে। সেই আগুন থেকে রক্ষা পেতে যারা কামরার বাইরে ঝাপ মারছেন, তাঁদের গলায়, পেটে, বুকে পড়ছে তরোয়ালের কোপ। রক্তে ভেসে যাচ্ছে রেললাইন, পাশের সবুজ ঝোপ। কারও কারও কাটা মুণ্ডু নিয়ে তখন লোফালুফি করছে কিছু নৃশংস আক্রমণকারী।
কয়েক মিনিটের ব্যাপার। জলন্ত কামরায় পুড়ে ছাই হয়ে গেল ৫৯টি দেহ। বাকিরা গুরুতর আহত। রক্তাক্ত, আগুনে পোড়া দেহগুলি কাতরাচ্ছে লাইনের পাশে শুয়ে। ক্ষণ গুনছে মৃত্যুর।
দমকলের গাড়ি যখন এসে পৌঁছল, ততক্ষণে যা ক্ষতি হবার হয়ে গেছে। পরে জানা গিয়েছিল, স্থানীয় কংগ্রেস নেতা কট্টর ইসলামপন্থী হাজি বিলালের নেতৃত্বে ষড়যন্ত্র করে খারাপ দেওয়া হয়েছিল দমকলের ইঞ্জিন। সেসব মেরামত করে তবেই বেরোতে হয়েছে। তার ওপর গোধরায় ঢোকার মুখে বাধা দেয় আরও একদল মত্ত জনতা। গোধরা স্টেশনে দমকলের গাড়ি গুলি ঢুকল ভাঙা উইন্ডস্ক্রিন, তোবড়ানো শরীর নিয়ে। আগুন নিভে যাবার পর তাঁরাই টেনেটুনে কামরা থেকে নামালেন ৫৯টি পোড়া দেহ। গুরুতর আহত ৪৩ জনকে পাঠানো হলো স্থানীয় হাসপাতালে। পুলিশও হতবাক। তাদের অনেকেই ঘটনার বীভৎসতা দেখে আতঙ্কিত। এমন অভিজ্ঞতা তাদের জীবনে এই প্রথম। আর তাদের সংখ্যা তো জমায়েত হওয়া জনতার তুলনায় নগণ্যই। কোনওরকমে প্রাণ বাঁচিয়ে রেখেছিলেন একজন মহিলাযাত্রী। ট্রেনের নীচে আত্মগোপন করেছিলেন। পুলিশ দেখে আছড়ে পড়লেন একজন কনস্টেবলের পায়ে। তাঁর আর্জি, তিনি তার গায়ের সব সোনার গয়না পুলিশকে দিয়ে দেবেন। স্রিফ মেরি জান বাঁচাইয়ে।
পুলিশ বাধ্য হয়েই শূন্যে গুলি চালাল। উন্মত্ত জনতা কিছুটা পিছু হটলেও ফের দ্বিতীয় দফায় আক্রমণ হানল তারা। ততক্ষণে ঘটনাস্থলে এসে পড়েছে রেলওয়ে প্রোটেকশন ফোর্স। দেরি না করে গুলি চালাল তারা, টিয়ার গ্যাস ছুঁড়ল। পিছু হটল আক্রমণকারীরা। তারপর সব শান্ত।
গোধরায় যখন পোড়া মাংসের গা-গুলোনো আবহাওয়া, পুড়ে যাওয়া। সবরমতী এক্সপ্রেস নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে, ততক্ষণে হাওয়ায় ছড়াতে শুরু করেছে। হিন্দু-নিধনের নৃশংস কাহিনি।
মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সেদিনও রোজের মতোই ভোর পাঁচটায় উঠে পড়েছিলেন বিছানা ছেড়ে। রোজকার মতো যোগব্যায়াম, জগিং সেরে ইন্টারনেটে দেখে নিয়েছেন কিছু জরুরি খবর আছে কিনা। তারপর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছেন খবরের কাগজগুলো। ব্রেকফাস্টও সেরেছেন ঘড়ি ধরেই।
সকাল ন’টা সাড়ে ন’টা নাগাদ তাঁর কাছে খবর পৌঁছল গোধরায় একটা ট্রেন দুর্ঘটনা হয়েছে। নিশ্চিত খবর নয়, কারণ উড়ো খবর আসছিল ট্রেনে আক্রমণ হয়েছে এবং কয়েকজন যাত্রী মারা গেছে। মোদী চেয়েছিলেন তখনই গোধরায় পৌঁছতে। কিন্তু সেদিন বিধানসভায় রাজ্যের অর্থমন্ত্রী পেশ করবেন রাজ্য বাজেট। উপায় ছিল না। বেলা দুটো-তিনটে নাগাদ তিনি বিস্তারিত খবর পেয়েই ছুটলেন।
তখনও জানা নেই, আক্রমণকারী কারা, মৃতের সংখ্যাই বা কত। তবুও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে পাঠিয়ে দিলেন নিজে রওনা হওয়ার আগে। মোদী জরুরি ক্যাবিনেট বৈঠক ডাকলেন। সেই বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, গোটা রাজ্যে সতর্কতা জারির। মোদী নির্দেশ দিলেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সমস্ত এজেন্সি ও বিভাগের সব কর্মচারীর ছুটি বাতিল থাকবে। পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত। আর নির্দেশ দিলেন সংরক্ষিত সমস্ত বাহিনীকে তৈরি থাকতে।
গান্ধীনগর থেকে গোধরার দূরত্ব ১২৫ কিলোমিটার। সোজাসুজিই যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু গুজরাট সরকারের কোনও হেলিকপ্টার ছিল না। অয়েল অ্যান্ড ন্যাচারাল গ্যাস কোম্পানি (ONGC)-র কাছে হেলিকপ্টার চেয়েও পাওয়া যায়নি। কারণ এক ইঞ্জিনের যে হেলিকপ্টারটি তাদের জিম্মায় ছিল, সেটিতে মুখ্যমন্ত্রীর মতো ভি ভি আইপিকে বহন করার রিস্ক তাঁরা নিতে পারেননি।
অতএব শেষ পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদী বিমানে রওনা হলেন ভাদোদরার পথে। সেখান থেকে সড়কপথে গোধরায় পৌঁছে। ঘটনায় বীভৎসতা দেখে মোদী স্তম্ভিত। ভাবতেও পারেননি, এমন নৃশংস হত্যালীলা মানুষের পক্ষে সম্ভব!
মোদী জানতেন– এই ঘটনার জল গড়াবে বহুদূর। গুজরাটের মতো দাঙ্গাপ্রবণ। রাজ্যে পরদিন থেকে যে কী শুরু হয়ে যাবে কেউ জানে না। সাম্প্রদায়িক হত্যার খবরের প্রতিক্রিয়া হবে মারাত্মক। অতএব তিনি আগেভাগেই গোধরায় বসেই প্রেস বিবৃতি দিলেন : “This is human terrorist crime of collective/ mass violence is not an incident of communal violence.”
এই ঘটনা যে সাম্প্রদায়িক ঘটনার চেয়ে মারাত্মক কোনও ষড়যন্ত্রের ফল, তাতে মোদীর কোনও সন্দেহই ছিল না। এবং পরবর্তীকালে তা সত্যি বলেই প্রমাণিত হয়েছিল। মোদী প্রেস বিবৃতিতে আরও বললেন : “The Government will not be lacking in discharging (its) duty…No efforts will be spared in ensuring law and older.”
গোধরায় কার্ফু জারি করা হলো। সেইসঙ্গে ২৮টি শহরেও। গোটা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ল পুলিশ বাহিনী। ধরপাকড় শুরু হলো আগাম সতর্কতা হিসেবে। ঘটনার দিনই আটক করা হলো ১৩৭ জন হিন্দু ও ৮০ জন মুসলমান দুষ্কৃতীকে। সমস্ত মন্দির এবং মসজিদে জারি হলো সতর্কতা ব্যবস্থা। বসল কড়া পুলিশ প্রহরা।
মোদী তখনও গোধরাতেই। খবর পেলেন, গোধরায় ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ পরদিন ২৮ ফেব্রুয়ারি ‘গুজরাট বন্ধ’-এর ডাক দিয়েছে। এটা সম্পূর্ণ এক সাংগঠনিক বিষয়, রাজনৈতিকও। প্রশাসন বাধা দিতে পারে না। তবে পরিষদের ‘বনধ’ মানেই আমেদাবাদে হাজার হাজার রাগী হিন্দু জনতার জমায়েত হওয়া। সেটা মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়।
নরেন্দ্র মোদী গোধরা থেকেই কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আর্জি জানালেন, দ্রুত চার কোম্পানি দাঙ্গা প্রতিরোধ বাহিনী, র্যাপিড অ্যাকশন ফোর্স এবং দশ কোম্পানি আধা সামরিক বাহিনী পাঠাতে।
মুখ্যমন্ত্রী গান্ধীনগরে পৌঁছলেন গভীর রাতে– প্রথমে সড়কপথে ভাদোদরায়, সেখান থেকে বিমানে আমেদাবাদ। তারপর সড়কপথে গান্ধীনগর। মোদী চিন্তিত, বিমর্ষও।
পরদিন থেকে গোটা রাজ্যকেই মুড়ে ফেলা হলো নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তার চাদরে। ছ’ হাজার পুলিশ, ৫৮ কোম্পানি রাজ্যের সংরক্ষিত পুলিশ বাহিনী, চার কোম্পানি আধা সামরিক বাহিনীর জওয়ানেরা শুরু করে দিয়েছে রুট মার্চ সমস্ত স্পর্শকাতর অঞ্চলে। ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতটা বিনিদ্রই কাটল মোদীর। গোধরা থেকে ফেরার পর রাতেই পদস্থ অফিসারদের নিয়ে বৈঠক করলেন। কেন্দ্রের কাছে জরুরি ফ্যাক্স বার্তা পাঠানো হলো সেনাবাহিনী চেয়ে। তখন কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদবানী। তাকেও ব্যক্তিগত অনুরোধ জানালেন মোদী।
কিন্তু জানা গেল, সেনাবাহিনী পাঠানো সম্ভব নয়। কারণ কিছুদিন আগেই দিল্লির সংসদ ভবনে পাক – জঙ্গিবাহিনীর আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে সেনাবিহিনীর বড়ো অংশকেই সীমান্ত এলাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। অপারেশন পরাক্রম’-এ অংশ নিতে। তবুও মুখ্যমন্ত্রী মোদী চেয়েছিলেন, সেনাবাহিনীর ইউনিফর্মে জুনিয়র সৈন্যরা অন্তত আসুক। তাও ব্যবস্থা হয়নি।
তবে সতর্ক নরেন্দ্র মোদী একটা কাজ করেছিলেন, ওই রাতেই গোধরা থেকে সমস্ত মৃতদেহ এনে আমেদাবাদ শহরের এক প্রান্তে সোলা হাসপাতাল থেকে পোস্টমর্টেমের পর পরিবার পরিজনদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল সবার অলক্ষ্যে। সংবাদমাধ্যমও খবর পায়নি। উদ্দেশ্য ছিল, গোধরায় যাতে দাঙ্গা না হয়। যদিও ১৩টি মৃতদেহ সনাক্ত করার মতো কেউ ছিলেন না। সেগুলি তুলে দেওয়া হয় বিশ্ব হিন্দু পরিষদের হাতে। পরে হাসপাতালের পিছন দিকে সরকারি চিকিৎসক এবং স্থানীয় পুরসভার কাউন্সিলর জগদীশ প্যাটেলের উপস্থিতিতে সেগুলি গণদাহ করা হয়। গোটা কাজটাই করা হয়েছিল যাতে পরদিন থেকে হিন্দু জনরোষ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় পরিণত হয়।
কিন্তু কপাল খারাপ নরেন্দ্র মোদীর। চিরকালই যিনি নানা ষড়যন্ত্রের শিকার। হয়েছেন, এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটল না। পরদিন রটে গেল, রাতে পদস্থ কর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে মোদী নাকি নির্দেশ দিয়েছেন মুসলমানদের হত্যা করতে। পরদিন সকালে রাজ্য বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ঘটনার বিবরণ পেশ করলেন এবং কংগ্রেস-সহ সমস্ত রাজনৈতিক দলের সহযোগিতা চাইলেন যাতে রাজ্যকে দাঙ্গামুক্ত রাখা হয়।
কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। সকাল ১০টা নাগাদ আমেদাবাদের উত্তর-পূর্বে নারোদা পাটিয়া অঞ্চলে অন্যান্য রাজ্য থেকে আগত মুসলমান জনবসতির ওপর আছড়ে পড়ল হিন্দু জনরোষ। সশস্ত্র এই হামলায় বেশ কিছু মানুষ প্রাণ তো হারালেই, জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে গেল ঘরবাড়ি, ব্যবসা সব কিছুই।
শোনার পর মোদীর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল, পুলিশে কী করছিল? একটু ভাবনা-চিন্তার পর মোদীর মনে হয়েছিল— তার রাজ্য দাঙ্গার জারকরসে রসাদৃত। সেই সাম্প্রদায়িক মনোভাব ছড়িয়েছে রাজনীতি, আমলাতন্ত্র এমনকী পুলিশ প্রশাসনেও।
নারোদা পাটিয়ার ঘটনা যে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র মোদীর বুঝতে দেরি হয়নি এবং জানা গেল, কেশুভাইপন্থী বিজেপির এক মহিলা বিধায়ক মায়া কোদনানিই প্রথম বজরং দলের বাবু বজরঙ্গীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে নারোদা পাটিয়ায় হামলা চালিয়েছে। অস্ত্র তুলে দিয়েছে উত্তেজিত হিন্দু জনগণের হাতে। তার পরিণতিতেই মরতে হয়েছে মুসলমান পুরুষ, মহিলা, শিশুদের সঙ্গে হিন্দু জনতাকেও। এই মায়া কোদনানিই আবার পরে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে নরেন্দ্র মোদীর পদত্যাগ দাবি করেন। এর সঙ্গে মিলেমিশে গেল সমাজকর্মী তিস্তা শীতলবাদের অভিযোগ, মোদীর নির্দেশে ডিরেক্টর জেনারেল অব পুলিশ পি সি পাণ্ডের নেতৃত্বেই চলেছে গণহত্যা। এমন অভিযোগও হাওয়ায় ভাসিয়ে দেওয়া হলো যে মোদীর নির্দেশে প্রকাশ্য দিনের আলোয় গোধরায় নিহতদের মৃতদেহ আমেদাবাদ শহরে ঘোরানো হয়েছে যাতে হিন্দু জনগণের মধ্যে মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা সমস্ত সহ্যের সীমা অতিক্রম করে যায়। যদিও পরে সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম (SIT)-এর রিপোর্টে এই সমস্ত ঘটনাকেই অবাঞ্ছিত গুজব এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল।
নারোদা পাটিয়ার ভয়াবহ হাঙ্গামার পর গণ্ডগোল ছড়ালো উত্তর-পশ্চিমে চমনপুরাতে। চমনপুরায় ছিল উচ্চবিত্ত মুসলমান পরিবারের একটি বড়ো আবাসন— গুলবার্গ সোসাইটি। হিন্দু দাঙ্গাবাজরা হামলা করল ওই আবাসনে। আবাসনের বিশিষ্ট বাসিন্দা ৭৩ বছর বয়সী প্রাক্তন কংগ্রেস সংসদ সদস্য এহসান জাফরি চেষ্টা করেও নিজেকে যেমন বাঁচাতে পারেননি, তেমনি বাঁচেনি অন্যান্য পরিবারগুলিও। নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল ৬৮ জন মুসলমান নারী, পুরুষ, শিশুকে। এখন সেই আবাসন জনমানবহীন। শুধুমাত্র বছরে একদিন মৃতদের স্মরণে ফুলের স্তবক নিয়ে হাজির হন পরিজনরা— সে দিনটা হলো ২৮ ফেব্রুয়ারি।
পরে জানা গিয়েছিল, গুলবার্গ সোসাইটিতে হামলার ঘটনায় মূল অংশগ্রহণকারীরা ছিল কংগ্রেসি ষড়যন্ত্রকারীরা যাদের সাহায্যে বাঁচতে চেয়েছিলেন এহসান জাফরি সাহেব। শুধু তাই নয়, একথাও প্রমাণিত হয়েছিল যে গোধরা জংশনে সবরমতী এক্সপ্রেসের নৃশংস ঘটনাতেও হাত ছিল স্থানীয় কংগ্রেস নেতৃত্বের।
(সুজিত রায় এবং রাজ মিত্র লিখিত স্বপ্নের ফেরিওয়ালা গ্রন্থ থেকে পুনর্মুদ্রিত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.