ভুলে যাওয়া অঙ্গণ গণহত্যা ও কর্মের ফল

১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হিন্দুদের গণহত্যার ফরিদপুর অভিযান শুরু হয়েছিল শ্রী অঙ্গন আশ্রম থেকে। বর্তমান বাংলাদেশের ফরিদপুর শহরের গোলচামট এলাকায় অবস্থিত, শ্রীধাম শ্রী অঙ্গন আশ্রমটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।  প্রভু জগদ্বন্ধু সুন্দর, মহানাম সম্প্রদায়ের একজন হিন্দু বৈষ্ণব সাধক, ১৮৯৯ সালে।পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালের ২১ শে এপ্রিল ফরিদপুরে প্রবেশ করে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ ৯ মাস অবরোধ করে রাখে।  সেই সময়, পাকিস্তান দখলদার বাহিনী, উর্দুভাষী সহ-ষড়যন্ত্রকারী এবং রাজাকারদের সাথে, অনেকগুলি হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করেছিল। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, যশোর থেকে হানাদার বাহিনীর একটি দল ফরিদপুর শহরে প্রবেশ করে ২১ এপ্রিল সন্ধ্যায়। প্রথমেই তারা শহরের প্রবেশমুখে শ্রীধাম শ্রী অঙ্গনে ঢুকে পড়ে। সেখানে বিশ্বশান্তি কামনায় কীর্তনরত সাধুদের ওপর ব্রাশফায়ার করে পাকিস্তানি সেনারা। তাদের পথ দেখায় এ দেশীয় দোসর আলবদর বাহিনী।  সেখানে বসবাসকারী কিছু ভিক্ষুক সৈন্যদের দেখে আশ্রম ছেড়ে পালিয়ে যায়।  তবে তাদের মধ্যে নয়জন আশ্রম ত্যাগ করতে রাজি হননি।  এ সময় তাঁরা মন্দিরের প্রার্থনা কক্ষে কীর্তন গাইছিলেন।  জপনাম সংকীর্তনে ছিল “জয় জগৎবন্ধু হরি! জয় জয় জগৎবন্ধু হরি!” সৈন্যরা শ্লোগানটিকে “জয় বঙ্গবন্ধু” বলে মনে করেছিল এবং নিশ্চিত হয়েছিল যে সন্ন্যাসীরা শেখ মুজিবুর রহমানের জয়ের জন্য স্লোগান দিচ্ছে।  মন্দিরের এক সন্ন্যাসী, নবকুমার ব্রহ্মচারী পালিয়ে গিয়ে মাউন্টেন রোজ ফুলের গাছের আড়ালে আশেপাশের গাছপালাগুলিতে লুকিয়েছিলেন। বাকি আটজনকে সৈন্যদের সামনে সারিবদ্ধ করা হয়েছিল। নবকুমার ব্রহ্মচারীর মতে, সন্ন্যাসীদের উপর বারোটি গুলি চালানো হয়েছিল। সন্ন্যাসীরা স্লোগান দিয়েছিলেন ”  জয় জগৎবন্ধু হরি” । সৈন্য ও রাজাকাররা আশ্রমে যা কিছু মূল্যবান ছিল তা লুট করে নিয়ে যায়।  পরদিন সকালে পৌরসভার একটি ট্রাকে করে লাশগুলো নিয়ে যাওয়া হয়।  ২৬ শে এপ্রিল, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ডিনামাইট দিয়ে মন্দিরের শিখর ধ্বংস করে। নবকুমার ব্রহ্মচারী সহ কয়েকজন সন্ন্যাসী হত্যা ও লুটপাটের পরই ফিরে আসেন এবং প্রভু জগৎবন্ধুর পবিত্র দেহাবশেষ উদ্ধার করেন এবং একটি ঝুড়িতে করে নিয়ে যান। প্রথমে কলকাতার মহাউদ্ধারণ মঠে আনা হয়, এরপর কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণিতে মহেন্দ্রবন্ধু অঙ্গনে আনা হয়।ফরিদপুর শহরে প্রবেশ মুখে শ্রী অঙ্গনে প্রথমে প্রবেশ করে সেখানে আট সাধুকে কীর্তনরত দেখতে পায়। এ সময় তাদের থামতে বললেও সাধুরা হরিনাম কীর্তন বন্ধ না করায় গুলি করে হত্যা করা হয়। নিহত এই আট সাধু হলেন নিদেনবন্ধু, ক্ষিতিবন্ধু বক্ষ্ণচারী, গৌরবন্ধু বক্ষ্ণচারী, চিরবক্ষ্ণচারী এবং রবিবন্ধু বক্ষ্ণচারী।এই হত্যাযজ্ঞ থেকে বেঁচে যাওয়া একজন শংকর লাল ঘোষ। শংকর বলছিলেন, রমনা কালীমন্দিরের পুরোহিত পরমানন্দ গিরিকে পাকিস্তানিরা জিজ্ঞেস করে, তিনি হিন্দু না মুসলমান। পরমানন্দ হিন্দু এবং এই মন্দিরের পুরোহিত বলে নিজের পরিচয় দিলে তাঁকে জোর করে কালেমা পড়ানো হয়। পরে বেয়নেট দিয়ে পেট চিরে ফেলে গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই রাতেই পাকিস্তানিদের গুলিতে নিহত হন শংকরের দাদা ধীরেন ঘোষ। পরে সকালবেলা হাইকোর্টের দিকে পালিয়ে যান শংকর।প্রত্যক্ষদর্শী দিলীপ দাশ। বয়স তখন তাঁর ১৪। দিলীপ এখন কামরাঙ্গীরচরে জুতোর কাজ করেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, পাকিস্তানিরা ঢুকে বিদ্যুতের লাইন কেটে দেয়। আগুন নিক্ষেপ করে। চোখের সামনে পুড়তে থাকে মন্দির আর আশ্রম। পুরুষদের এক লাইনে দাঁড়িয়ে ব্রাশফায়ার করে তারা। সেদিন রাতে মা তাঁকে নিয়ে এক ফাঁকে বের হতে পারেন।

Prabhu Jagatbandhu Sundar’s idol at Faridpur.


শাহরিয়ার কবির বলেন, “পশ্চিম ইউরোপের বহু দেশ প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে ৭১-এ গণহত্যাকারীদের সমর্থন দিয়েছে। আমেরিকা, চীন, তথাকথিত ইসলামি উম্মাহ এরা কিন্তু পাকিস্তানের পক্ষেই ছিল। তারা গণহত্যার ব্যাপারে সরকারিভাবে প্রতিবাদ করেনি যদিও সেসব দেশের গণমাধ্যম এবং জনগণ এর নিন্দা করেছে।”বঙ্গবন্ধু কারাগার থেকে ফিরে আসার পর যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট গণহত্যা-ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের অভিযোগ আছে এমন প্রায় ৩৬ হাজার রাজাকার-আলবদর, আলশামসের বিচারের পাশাপাশি পরিকল্পনাকারী, নির্দেশদাতা ও সরাসরি হত্যা-ধর্ষণ, লুটপাটে যুক্ত চূড়ান্তভাবে ১৯৫ জন সেনা কর্মকর্তাকে বিচারের জন্য মনোনীত করেন।সর্বশেষ ত্রিপক্ষীয় সিমলাচুক্তির মাধ্যমে পাকিস্তান তাদের অপরাধের জন্য দুঃখপ্রকাশ করে ১৯৫ জন সেনাকর্মকর্তাকে নিজ দেশে নিয়ে বিচার করবে এই মুচলেকা দিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু তারা আর বিচার করেনি। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষমতায় আসা সরকারগুলোর বেশিরভাগই গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধের বিষয়টি নিষ্পত্তি না করেই পাকিস্তানের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ার চেষ্টা চালায়।২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর গণহত্যার জন্য বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা, যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ, সম্পদের হিস্যাসহ বিভিন্ন দাবি তোলে। সেই সঙ্গে ১৯৭১ সালের গণহত্যা, যুব্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের উদ্যোগে শুরু থেকেই বিচলিত ছিল পাকিস্তান।রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী, যিনি অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির প্রাক্তন প্রেস সচিব ছিলেন, তিনি বলেন ,1971 সালের 16 ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের কয়েকদিন আগে, ক্যাপ্টেন জামশেদ যে গণহত্যা এবং পরবর্তীকালে মন্দিরের অপবিত্রতার নির্দেশ দিয়েছিলেন, তিনি প্রভু জগৎবন্ধু সুন্দরের বেদির সামনে আত্মহত্যা করেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা প্রবোধ কুমার সরকারের সাক্ষ্য অনুসারে, ক্যাপ্টেন জামশেদ প্রভু জগৎবন্ধুর সামনে আত্মহত্যার আগে পাগল হয়েছিলেন।  বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর সন্ন্যাসীরা ফিরে আসেন, পবিত্র নিদর্শন পুনরুদ্ধার করেন এবং ক্ষতিগ্রস্ত মন্দির পুনর্নির্মাণ করেন।১৯৯৬ সালে, আশ্রম কর্তৃপক্ষের দ্বারা শ্রী অঙ্গনের প্রাঙ্গণে আটটি মৃত সন্ন্যাসীর জন্য আটটি কালো ফলক উত্থাপিত হয়েছিল।  প্রতি বছর ২১ শে এপ্রিল, স্থানীয় হিন্দু এবং আবাসিক সন্ন্যাসীরা এই ফলকগুলিকে ফুলের মালা দিয়ে অর্পণ করে এবং নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে প্রভু জগৎবন্ধুর স্মৃতিচিহ্ন রক্ষা করার জন্য তাদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করা হয়৷

https://www.storiesofbengalihindus.com/sri-angan-massacre-1971

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.