আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের (আই এম এফ) একজন সর্বোচ্চ আধিকারিক জানিয়েছেন যে, বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলো অপেক্ষা ভারতের ঋণ কম। তিনি সতর্ক করেছেন যে বিশ্বের মোট ঋণ ২০১৭ সালে অত্যধিক বেড়েছে, এক নতুন রেকর্ড মাত্রা ছুঁয়েছে—১৮২ ট্রিলিয়ন ইউ এস ডলার। আই এম এফের রাজস্ব সংক্রান্ত দপ্তরের নির্দেশক ভাইটর গ্যাসপার বলেছেন যে, বিশ্ব জিডিপির তুলনায় শতাংশের হিসাবে বিশ্বের যে মোট ঋণ তার থেকে ভারতের ঋণ অনেক অনেক কম। আই এম এফের থেকে প্রাপ্ত সর্বশেষ তথ্য অনুসারে ২০১৭ সালে ভারতের বেসরকারি ঋণ ছিল জিডিপির ৫৩.৫ শতাংশ আর সাধারণ সরকারি ঋণ ছিল জিডিপির ৭০.৪ শতাংশ অর্থাৎ জিডিপির প্রায় ১২৫শতাংশ। এর তুলনায় চীনের ঋণ জিডিপির ২৪৭ শতাংশ। ঋণ জিডিপি অনুপাতের সঙ্গে মাথাপিছু জিডিপির সম্পর্ক আছে। পৃথিবীর উন্নততম দেশ বা উন্নয়নশীল দেশসমূহের তুলনায় ভারতের ঋণের মাত্রা অনেক কম। গ্যাসপার আরও বলেছেন—বিশ্বব্যাপী বেসরকারি ঋণ গত ১০ বছরে সাংঘাতিকভাবে বেড়েছে, অথচ গত পাঁচ বছরে ভারতের বেসরকারি ঋণ প্রায় ৬০ শতাংশ কমে গেছে। এখন তা কমে হয়েছে ৪৫.৫ শতাংশ। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম। সুতরাং ভারতীয় অর্থনীতির বুনিয়াদ খুব মজবুত। যেখানে অন্য উন্নয়নশীল দেশগুলো, (ভারতও উন্নয়নশীল দেশ), বেসরকারিভাবে দেনা করে গেছে কিন্তু গত দু’বছরে তাদের অর্থনীতি অনেক মন্থর হয়েছে সে তুলনায় ভারতের ভিত দৃঢ়। সুতরাং ভারত সেইরকম উন্নয়নশীল দেশ নয় যে ধার করা টাকা খাটাচ্ছে ভবিষ্যতে লাভ হবে এই আশায়। গ্যাসপারের মতে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বেসরকারি ঋণ সরকারি ঋণের তুলনায় অনেক বেড়েছে। চীনের মোট ঋণ জিডিপির ২৪৭ শতাংশ কিন্তু সেখানে বেসরকারি ঋণ আর সরকারি ঋণের মধ্যেকার ফারাক খুব অস্পষ্ট (কারণ ওরা সব লুকিয়ে রাখে)। এই অস্পষ্টতার কারণ ওখানে অনেক বেশি সংখ্যায় সরকারি সংস্থা ও নিগম আছে, আছে সরকারের জটিল অনেক স্তর আর বিস্তৃত আঞ্চলিক বাজেট বহির্ভুত ধারা। ফলত ২০১৭ বর্ষের সরকারি ঋণের আনুমানিক হিসাব ভীষণভাবে পাল্টাচ্ছে; সরকারিভাবে সরকারের ঋণ জিডিপির ৩৭ শতাংশ আর সর্বশেষ ওয়ার্ল্ড ইকনমিক আউটলুক দেখাচ্ছে তা জিডিপির ৪৭ শতাংশ। আর বাজেটের বাইরে স্থানীয় সরকারগুলো দেনা করেছে জিডিপির ৬৮ শতাংশ।
ইন্টারন্যাশনাল ব্যাঙ্ক ফর রিকনস্ট্রাকশন (আইবিআরডি) মাঝারি ও নিম্ন আয়ের দেশগুলিকে ঋণ দেয় বাজার দরে আর ইন্টারন্যাশনাল ডেভলপমেন্ট অ্যাসোশিয়েশন (আইডিএ) নিম্ন আয়ের দেশগুলিকে প্রায় বিনা সুদে ঋণ দেয়। এই দুটো নিয়ে ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক। ২০১৫-১৮ ভারত ৬১টা প্রকল্পের জন্য ১৩১ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে (সূত্র গুগল) ১১-১৪ পর্বে ভারত নিয়েছিল ১৩৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ ৬৬টা প্রকল্পের জন্য। স্বাধীনতার পর থেকে ভারতই ২০১৬ সাল পর্যন্ত সবচেয়ে বৃহৎ ঋণগ্রহীতা। এই সময়ে ০.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ ভারত নিয়েছে শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনার জন্য। একটা উন্নয়নশীল দেশ যার পরিকাঠামো উন্নতির জন্য খুব চাপ আছে তাকে বিশ্বব্যাঙ্কের থেকে ঋণ নিতেই হয় বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য প্রধানত পরিবহণ, স্বাস্থ্যরক্ষা, শিক্ষা, বিদ্যুৎ ইত্যাদি। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী দায়িত্বগ্রহণের সময়ে বিশ্বব্যাঙ্কের কাছে ভারতের ঋণ ছিল ৫.১১ বিলিয়ন ডলার আর ৩১ জুলাই, ২০১৯-এ তা দাঁড়িয়েছে ৩.২৭ বিলিয়ন ডলার তার অর্থ প্রায় ২ বিলিয়ন ইউ এস ডলার ঋণ অতিরিক্ত শোধ করেছে। জুলাই মাসের তথ্য বলছে আর ছ’মাস বাদে তা হবে মাত্ৰ০.২৫ বিলিয়ন ডলার। সারা বিশ্বের অর্থনীতি একই সময়ে মন্দার মধ্য দিয়ে চলেছে প্রায় সমস্ত বৃহৎ অর্থনীতি গতিবেগ হারিয়েছে। এই মন্দার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ বৃহত্তম দুটি অর্থনীতির মধ্যে জারি বাণিজ্য সংঘর্ষ। এই সংঘর্ষের দুটো ফলশ্রুতি—উৎপন্ন পণ্যদ্রব্যের আয়তন হ্রাস আর দেশগুলোর মধ্যে সবসময়ে শুল্ক বৃদ্ধির ভয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে ভারতের ফলাফল ততটা হতাশব্যঞ্জক নয়। ভারতের রপ্তানি ৬.৫৭% কম হয়েছে ২৬ বিলিয়ন ডলার আর আমদানি ১৩.৯% কমে হয়েছে। ৩৬.৯ বিলিয়ন ডলার। তা সত্ত্বেও আই এম এফ ভবিষ্যদ্বাণী করেছে যে পরবর্তী আর্থিক বছরে ভারতের বৃদ্ধির মাত্রা বাড়বে। সম্প্রতি ভারত সরকার কর্পোরেট কর কমিয়ে ভালো কাজ করেছে কারণ এতে শিল্পে বিনিয়োগ বাড়বে। (টিওআই, ১৮/১০/১৯) বৈদেশিক মুদ্রা ভাণ্ডার ২০১৪ সালে ছিল ৩০৪ বিলিয়ন ডলার আর ২০১৯ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৪২০ বিলয়ন ডলার। মুদ্রাস্ফীতির হার ৩-৪এর মধ্যে আছে যা ২০১৩ সালে হয়েছিল ১৩.৮। ২০১৩ সালে লিটার প্রতি পেট্রলের দাম ছিল ৮৩.৮৪ টাকা আর এখন তা ৭৫.৯২ টাকা লিটার। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম যথেষ্ট বাড়া সত্ত্বেও। ২০১৪-১৯-র মধ্যে গড় দাম ছিল ৭০ টাকা প্রতি লিটার। ভারত ইরানের ৪৩০০০ হাজার কোটি টাকার অপরিশোধিত তেলের দাম মিটিয়ে দিচ্ছে দু’মাসের মধ্যে।
ভারত এখন পৃথিবীর চতুর্থ গাড়ি প্রস্তুতকারক দেশ আর দ্বিতীয় বৃহত্তম ইস্পাত উৎপাদনকারী দেশ। দু-চাকার গাড়ি উৎপাদনে ভারত পৃথিবীতে এক নম্বর। আর বিক্রিত মোবাইলের ৯৪% এখানে প্রস্তুত হয়। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মোবাইল উৎপাদনকারী দেশ ভারত। ইজ অব ডুইং বিজনেসে ২০১৪ সালে ১৩৪ নম্বর স্থানে ছিল ভারত এখন উঠে এসেছে ৭৭ নম্বর স্থানে। ১৯৪৭ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৫৭ বছরে যেখান ৯১,২৮৭ কিমি রাস্তা নির্মাণ হয়েছে। সেখানে মোদীর আমলে ৪০,০৩৯ কিমি. রাস্তা নির্মাণ হয়েছে মাত্র ৪ বছরে ২০১৪-১৮-র মধ্যে কাজ চলছে। ৩৪টা নতুন বিমানবন্দর চালু হয়েছে। আড়াই লাখ পায়খানা নির্মাণের কাজ প্রায় সম্পূর্ণ। রেলের ১০০ শতাংশ বৈদ্যুতিকীকরণের কাজ চলছে দ্রুত গতিতে। সৌরশক্তিচালিত ট্রেন চালিত হয়েছে। ১০টি দ্রুতগতিসম্পন্ন রেল করিডর নির্মাণের কাজ চলছে।’তেজস, s। জি : হা হউক। গতিমান আর বন্দের মতো দ্রুতগতির ট্রেন প্রস্তুত হয়েছে। ৮৭১ টা নতুন ট্রেন সার্ভিস-সহ ১৮০টা নতুন রেললাইন তৈরি হয়েছে। সামান্য কিছু উন্নয়নের কাজ উল্লেখ করলাম। সদ্য স্মারক নোবেলপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ পুরস্কার ঘোষণার অব্যবহিত পরে বললেন ভারতের আর্থিক অবস্থার হাল খুব খারাপ। তেমনটাই প্রত্যাশিত ছিল। তার রাজনৈতিক অবস্থানের কথা এখন ভারতবর্ষের মানুষ জেনে গেছেন। তিনি সুপারিশ করেছেন সাম্প্রতিক কর্পোরেট কর হ্রাসের সিদ্ধান্তকে উল্টে দিয়ে বেশি করে কর চাপাতে, সেই সঞ্চিত অর্থ পি এম কিষাণ ও নরেগা প্রকল্পে ঢালতে হবে। এটা ভাবতে কষ্ট হয় যে এই ভয়াবহ বিশ্বব্যাপী মন্দার দিনে যে বামপন্থী আর্থিক তত্ত্ব সারা পৃথিবীতে ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে তার সুপারিশ কেউ করতে পারে। আমাদের অর্থনীতিবিদরা তাদের ছাত্রাবস্থায় যে ব্যর্থ অর্থনৈতিক তত্ত্ব একবার মাথায় ঢুকেছে তা ভুলতে পারেন না। এটা মানুষকে স্বীকার করতেই হবে যে সমস্ত কমিউনিস্ট দেশগুলো বরবাদ হয়ে গেছে তাদের অর্থনৈতিক তত্ত্বের কারণে। ব্যতিক্রম চীন, যে দেশ কিনা অনুসরণ করছে পুঁজিবাদী-ফ্যাসিস্ট-কমিউনিস্ট সাম্রাজ্যবাদী এক বিপজ্জনক পন্থা। শিল্প বিপন্ন। তার জন্য ভারত দায়ী নয় তা আগেই বলা হয়েছে।
গাড়ি শিল্পে মন্দার অনেক কারণ আছে-কালোটাকার উপর নিয়ন্ত্রণ, বাজারে প্রচুর ভালো পুরনো গাড়ির যোগান, বৈদ্যুতিক গাড়ির উপর জোর দেওয়া ইত্যাদি। শিল্পই কাজ বা চাকরি সৃষ্টি করে তাদের মদত দেওয়া দরকার। শিল্প ও গ্রামীণ ক্ষেত্রে যারা চাকরি সৃষ্টি করে তাদের ঋণের উপর সুদ কমাতে হবে। গ্রামীণ ক্ষেত্রে সহায়তা বাড়ানো যেতে পারে অন্য উপায়ে, শিল্পকে মেরে নয়। যুগের দাবি এটাই। নেহরু মডেলকে ফিরিয়ে আনার কোনো মানে হয় না। তিনি গরিবের হাতে টাকা দিতে সুপারিশ করেছেন (ন্যায়’-এর মতো প্রকল্প)। প্রথমত টাকা আসবে কীভাবে? উনি যে পথ বাতলেছেন তা শুরুতেই বাতিলযোগ্য। দ্বিতীয়ত, এতে কোনো স্থায়ী সম্পদ সৃষ্টি হবে না। সবচেয়ে বড় কথা, যে দেশে যোগ্য গ্রহীতার চয়ন সন্দেহজনক, টাকাটা কোথায় পৌঁছবে। শেষাবধি, সন্ত্রাসবাদীদের হাতে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব প্রবল।
সুদীপ নারায়ণ ঘোষ
2019-11-01