মনে আছে, কলেজ স্ট্রিটে সত্তরের দশকে বিদ্যাসাগর, প্রফুল্লচন্দ্র এর মূর্তি ভেঙে ছিল দুষ্কৃতকারী কমিউনিস্টরা

সত্তরের দশক, সালটা বোধকরি ১৯৬৮- ৬৯…সময় উত্তাল। চীনের রেডিও থেকে বসন্তের বজ্র নির্ঘোষ বলে এখানে যুবকদের খেপিয়ে তুলেছে। চীনের চেয়ার ম্যান তখন কমিউনিস্টদের মা বাপ। পথে ঘাটে পড়ে থাকে কচি ছেলেদের লাশ। কেউ নকশাল করতে গিয়ে মরেছে। কেউ নকশাল করতে চায় নি তাই মরেছে। কেউ মরছে শুধু সন্দেহের বসে। সমাজে তখন খাদ্য খাদকের বাস্তু তন্ত্র চলছে। তো এ হেন বাস্তু তন্ত্র থেকে মনীষীরাও বাদ যেতেন না।

মনে আছে, কলেজ স্ট্রিটে সত্তরের দশকে বিদ্যাসাগর, প্রফুল্লচন্দ্র এর মূর্তি ভেঙে ছিল দুষ্কৃতকারী কমিউনিস্টরা। সেই সময় সব মনীষী মূর্তি আক্রান্ত হত। প্রতিদিন সকালে উঠে দেখা যেত মনীষীদের কাটা মাথা রাস্তায় পরে আছে।

এই মূর্তি ভাঙার ঘটনায় সব থেকে বড় মাথা ছিল সরোজ দত্ত এর। সরোজ দত্ত যিনি সমর সেনের ‘In Defense of Decadents’ প্রগতিশীলতার মোড়কে ধেয়ে আসা প্রচ্ছন্ন ফ্যাসিবাদী এলিওটিজমকে চিহ্নিত করেন ১৯৩৯এ । ১৯৬৯ সেই সরোজ দত্ত যুক্তি সাজান ভারতে একই সাথে বিদ্যাসাগর , রামমোহন এর মত ব্রিটিশ শাসকের অনুগত ব্যক্তিত্ব’র সাথে মঙ্গল পাণ্ডের মূর্তি ,বীরসার মুর্তি স্থাপিত হতে পারেনা । সিপাহি বিদ্রোহের অর্থাৎ ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের শহিদদের মূর্তি স্থাপন করতে হলে সেই বিদ্রোহের সমর্থকদের মূর্তি ভাঙা দরকার।

সিপাহী বিদ্রোহের সময় সংস্কৃত কলেজ সহ আরো নানা কলেজ ,স্কুলে ব্রিটিশ সেনা ক্যাম্প বসানো হয়। তাতে বিদ্যাসাগরের হাত ছিল না ।

এই ইসুকেই মওকা হিসাবে লাগায় সরোজ দত্ত । তরুণরা তখন জাস্ট সরোজ দত্ত দ্বারা ব্রেইন ওয়াসড এক-একজন ‘মনীষী’র মূর্তি ভাঙছে ‘বুর্জোয়া শিক্ষাব্যবস্থা’য় আঘাত করতে, আর সরোজবাবুর লেখনী সেই মনীষীর সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আপসের নজির তুলে ধরে সেই ভাঙনকে যুক্তিসিদ্ধ করছে, বৈধতা দিচ্ছে। তাঁর মতে, নতুন কিছু গড়তে গেলে পুরনোকে ভাঙতে হয়। মঙ্গল পাণ্ডের মূর্তি বসাতে গেলে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙতে হবে। সিপাহি বিদ্রোহের অর্থাৎ ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের শহিদদের মূর্তি স্থাপন করতে হলে সেই বিদ্রোহের সমর্থকদের মূর্তি ভাঙা দরকার।সরোজ দত্তর নৈতিক প্রশ্রয়ে বা তাত্ত্বিক আস্কারায় নকশাল তরুণরা যে কালাপাহাড়ি তাণ্ডব চালিয়েছিল।

একদিকে পশ্চিমবঙ্গে তখন বিদ্যাসাগরের আবক্ষ মূর্তি ভাঙা হচ্ছে, প্রগতিশীলতার লক্ষণ; অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধ হতে হতে রক্ষা পেয়েছেন, সেই সমাজে বিদ্যাসাগরকে স্মরণ করা তো ভয়াবহ ব্যাপার।

সংস্কৃত কলেজ থেকে স্থানান্তরের পর কলেজ কর্তৃপক্ষ বিদ্যাসাগরের আর একটি মূর্তি প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে এবারে আর ভারতীয় শিল্পী নয়, মূর্তি গড়ার ভার দেওয়া হয় এভাঞ্জেলিনো বইসকে। তিনি ইতালির লোক তবে থাকতেন কলকাতাতেই। অবিকল দুর্গা মিস্ত্রির মূর্তির মত দেখতে শ্বেত পাথরের ওই মূর্তি বসানো হয়েছিল সংস্কৃত কলেজের বর্তমান প্রবেশপথের পূর্ব দিকে।

বইসের গড়া বিদ্যাসাগের ওই দ্বিতীয় মূর্তিটার কোনও খোঁজ এখন আর পাওয়া যায় না। সত্তরের দশকে কলেজ স্কোয়ারে বসানো বিদ্যাসাগরের প্রথম মূর্তির সঙ্গে এটাও দুষ্কৃতি-কমিউনিস্ট দের হামলার শিকার হয়েছিল। মূর্তিটা এমনই ক্ষতিগ্রস্ত হয় যে কলেজ কর্তৃপক্ষে সেটিকে প্রকাশ্য স্থান থেকে সরিয়ে ফেলেন।

১৯৯১ সালে বিদ্যাসাগরের মৃত্যু-শতবর্ষের সময় পর্যন্ত মূর্তিটা কলেজের একটি গুদাম ঘরে পড়ে ছিল বলে জানা যায়, কিন্তু বর্তমানে কোথায় তা কেউ জানে না, কলেজ কর্তৃপক্ষও আগ্রহী নয় ‘ভাঙা মূর্তি’ নিয়ে মাথা ঘামাতে।

বইসের মূর্তি ভেঙে যাবার পর ওই জায়গায় বসানো হয়েছে বিদ্যাসাগরের তৃতীয় একটি মূর্তি। সেটাও শ্বেত পাথরের তৈরি, রূপকার প্রমোদগোপাল চট্টোপাধ্যায়। এখনও সংস্কৃত কলেজের বর্তমান প্রবেশপথের পূর্ব দিকে রয়েছে ওই মূর্তি।

কলেজ স্কোয়ারে স্থাপিত অন্যান্য মূর্তিগুলোর মধ্যে আর একটা হল বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মর্মর মূর্তি। ১৯৫৫ সালের ২ অগস্ট প্রফুল্লচন্দ্রের পঁচানব্বইতম জন্ম তারিখে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে মূর্তির আবরণ উন্মোচন করেন তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হরেন্দ্রকুমার মুখোপাধ্যায়।

বেলে পাথরের বেদীর ওপর দণ্ডায়মান ভঙ্গীর শ্বেত পাথরে তৈরি ওই মূর্তির কোথাও ভাস্করের নাম খোদাই করা না থাকলেও অসমর্থিত সূত্র থেকে জানা যায়, ভাস্কর প্রদোষ দাশগুপ্ত ওই মূর্তির রূপকার। সত্তরের দশকে এটিও দুষ্কৃতি- কমিউনিস্ট দ্বারা হামলার শিকার হয়েছিল।

সেই ভাঙার নোংরামি আজও চলে । উগ্র বামপন্থা দেশদ্রোহ, পর রাষ্ট্র প্রীতির সঙ্গে সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন , উগ্র প্রাদেশিকতা ইত্যাদির মাধ্যমে দেশে ভীত দুর্বল করে দেবার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। শ্যামাপ্রসাদ থেকে শুরু করে স্বামী বিবেকানন্দ কেউই মুক্তি পান নি এদের হাত থেকে। কারন আমরা প্রতিবাদ প্রতিরোধ করে মুক্তি দিতে চাই নি।

কাল ছিল বাঙ্গালীর ইতিহাসের কালো দিন। জেএনইউ ক্যাম্পাসের মধ্যে স্বামীজির মূর্তি ভাঙল বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ এম. জগদীশ কুমার বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন, যে সমস্ত ছাত্র এই ন্যক্কারজনক ঘটনার সঙ্গে যুক্ত অবিলম্বে তাঁদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এফআইআর দায়ের করা হবে সবার বিরুদ্ধে। পাশাপাশি, ঘটনা খতিয়ে দেখতে বিশেষ তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে বলেও জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এছাড়া, মূর্তি ভাঙার সময় নাকি মহিলা নিরাপত্তারক্ষীদেরও বেধড়ক মারধর করেন ছাত্ররা, এমন অভিযোগও শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে এনেছে জেএনইউ কর্তৃপক্ষ।

প্রসঙ্গত, বেতন বৃদ্ধি নিয়ে সোমবার ব্যাপক বিক্ষোভের পরে, কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রীকে কয়েক ঘন্টা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঘেরাও করে রেখেছিলেন বিক্ষুব্ধ ছত্ররা। বুধবার, জেএনইউ শিক্ষার্থীরা প্রস্তাবিত বেতন বৃদ্ধি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ জানান। খবর, এরপরেই বুধবার রাতে মূর্তি উদ্বোধনের আগেই শিক্ষার্থীরা ভেঙে দেয় স্বামী বিবেকানন্দের মূর্তি। ভাঙচুর চালায় ব্লকের অন্যত্রও।

মূর্তির বেশ কিছু অংশ ভেঙে এর নীচে আপত্তিকর কথাও লেখা হয়েছে। মূলত ভারতীয় জনতা পার্টিকে নিশানায় নিয়েই এই মূর্তি ভাঙা হয়েছে বলে খবর সূত্রের। কে বা কারা এই কাজের পিছনে রয়েছে তা এখনও সাফ নয়। তবে বিজেপি বিরোধী আপত্তিকর শব্দ এই মূর্তির নীচে জ্বলজ্বল করছে।

ছাত্র-ছাত্রীদের বিরামহীন আন্দোলনের মুখে যদিও ফি বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করেছে কেন্দ্র। তবুও বিক্ষোভ কমতে দেখা যাচ্ছে না। এখনও পর্যন্ত ড্রেস কোড বাধ্যতামূলক করার নির্দেশিকা প্রত্যাহার করা নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। সেই কারণেই যত ক্ষোভ। তবে এই সবের মধ্যে বিবেকানন্দের মূর্তি ভাঙা নতুন করে শোরগোল ফেলেছে। মূর্তির নীচে গেরুয়াকরণ রোখার বার্তা দেওয়া হলেও সাম্প্রতিক গেরুয়া রাজনীতির সঙ্গে তাঁর চিন্তাধারার ফারাক কতটা ছিল, সেই সম্পর্কে হয়তো অন্ধকারে এই কাজের মূল কাণ্ডারিরা।

তথ্য ও আংশিক উদ্ধৃতি : গৌতম বসুমল্লিকের কলেজ স্ট্রিট পরিক্রমা (সপ্তদশ পর্ব) থেকে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.