কাশ্মীর মাঙ্গে আজাদি। জে-এন-ইউ’র শ্লোগান। ধার করেছে যাদবপুরও। ডফলি নামে একটি বাদ্যযন্ত্র আছে। হাতে নিয়ে আঙ্গুলে বাজানো যায়। সেটি বাজিয়ে, ঘুরে ঘুরে শ্লোগানবাজি চলতে থাকে। দেশের খেয়ে দেশের পড়ে, দেশের নিরাপত্তায় নৈশনিদ্রা দুপুর বারোটা অব্দি চালিয়ে সুরে সুরে তাল মিলিয়ে শ্লোগান উঠে- কাশ্মীর মাঙ্গে আজাদি, মণিপুর মাঙ্গে আজাদি, নাগাল্যান্ড মাঙ্গে আজাদি। একজন আওড়ায় বাকিরা দোহার টানে, আজাদি ভাই-আজাদি। মিঠি মিঠি-আজাদি। লড়কে লেঙ্গে-আজাদি। জানসে প্যায়ারা আজাদি। পথ চলতি মানুষ বিস্ময়ে দেখে। ভাবে এরা কারা? এদের বাড়ি ঘর আছে? মা বাবা? ভাই বোন? জ্যাঠা কাকা?এদের শৈশব ছিল, আম কুড়ানোর কৈশোর? এরা এ মাটির শস্য খেয়ে বেড়ে উঠেছে? এ ভুমির জল?অনেকে কাছে যায়। তারপর আবিষ্কার করে এরা বামপন্থী। চরম বামপন্থী। এদের কাছে দেশপ্রেম হল অর্থহীন আবেগ। এরা দেশপ্রেমের ধার ধারে না। এরা ভারতমাতাকে বলে ভাটের মাতা।
বামপন্থীরা দেশপ্রেমিক হয় না। কারণ ওদের বিশ্বপ্রেমিক হতে হয়। ওদের বিশ্ব খেটে খাওয়া মানুষের বিশ্ব। বিশ্বের তাবৎ শ্রমজীবীর তারা স্বাভাবিক ঠিকাদার। ওদের তত্ত্ব বলে, পুঁজি মাত্রই শোষণের হাতিয়ার। একচেটিয়া পুঁজির নিষ্পেষণে শ্রমিক ছিবড়ে হতে থাকে। আখ মাড়াই যন্ত্রে আখ নিংড়ে যেমন রস বের হয়। শ্রমিক নিংড়ে হয় তেমনি রক্ত। সে রক্ত পুঁজির মালিক বড়লোকদের প্রিয় ড্রিংস। সারা বিশ্বে পুঁজির মালিকরা ষড়যন্ত্র করছে। শ্রমিক শোষণের ষড়যন্ত্র। এর বিরুদ্ধে শ্রমজীবীদের সংগঠিত হতে হবে। সেই সংগঠিত শক্তির নেতৃত্ব দেবে বামপন্থা।
বামপন্থার দৃষ্টিতে পৃথিবীতে শুধু দুটিমাত্র জাত। হ্যাভ আর হ্যাভ নট। আছে আর নেই। যাদের আছে তাদের সব কিছুই আছে। যাদের নেই তাদের কোনও কিছুই নেই। একটু ভুল হল। যাদের নেই তাদের একটি জিনিষ আছে। সেটি হল শৃঙ্খল। অতএব নেই লোকেদের কিছুই হারাবার নেই, শুধুমাত্র শৃঙ্খল ছাড়া। যুগে যুগে এটি বামপন্থার একটি জনপ্রিয় শ্লোগান। খুব অভিমানী শ্লোগানও।
বামপন্থার দৃষ্টিতে সমগ্র পৃথিবীর সমস্যা একটাই। তা হল শ্রমজীবীদের সমস্যা। সমস্ত পৃথিবীর দুঃখ একটাই। তা হল শ্রমজীবীদের দুঃখ। এই সমস্যা ও এই দুঃখের কোনও সীমানা নেই। পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত শ্রমজীবীর দুঃখের চেহারা সমান। অতএব বামপন্থী মানেই বিশ্ববাদী। দেশ-পাড়া-গ্রামের প্রেমে বামপন্থীদের উতলা হলে চলে না।
বামপন্থা ধর্ম মানে না। তাদের মতে ধর্ম পুঁজিবাদের নম্রসহচর। ধর্মের আফিমে মানুষকে বেহুঁশ করে রাখা যায়। ধর্মে মানুষের হৃদয় প্রবৃত্তি কোমল হয়ে যায়। মালিক, শ্রমিক নির্বিশেষে সকলের মঙ্গল কামনা করতে থাকে। এটা কোনও ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। ধর্মপথে গেলে শ্রমজীবীর মূল উদ্দেশ্য যে সংগ্রাম তা ব্যাহত হয়। অতএব পুঁজিবাদের পাশাপাশি ধর্মেরও মৃত্যু চাই। মানুষকে ধর্মের অক্টোপাস থেকে মুক্ত রাখা বামেদের সুপ্ত সিদ্ধান্ত। ভারতের ফলিত বামপন্থা অবশ্য ধর্ম ও জিরাফ উভয়েই আছে। ঘোর মার্ক্সবাদীর বাড়িতেও ঘটা করে কালীপূজা হয়। তখন অবশ্য ধর্ম একটি ব্যক্তিগত বিষয় বলে মধ্যপন্থা ধরে নেয় বামপন্থীরা।
যাদবপুর আর জেএনইউ’র বামপন্থীরা কাশ্মীরের স্বাধীনতা চায়। কেন চায় ? কারণ তারা মনে করে কাশ্মীরের ভারতে যোগদান একটা ঐতিহাসিক ভুল। কাশ্মীরে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। অঙ্কমতে এটা পাকিস্তানেই যাওয়া উচিত ছিল। আর নয়ত স্বাধীন থাকতে চাইলে স্বাধীন। বামেরা বিশ্বাস করে ভারত সৈন্যবলে কাশ্মীর অধিকার করে রেখেছে।
বামপন্থীরা কাশ্মীরে রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের গল্প শোনায়। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গলাবাজি করে। সেনাদের সামান্য দোষ ত্রুটি নিয়ে বাজার জমায়। তাদের মতে সেনা অত্যাচারের পরিণাম যুবকদের পাথরবাজি। যুবকদের কোনও দোষ নেই। কাশ্মীর থেকে সেনা তুলে নিয়ে আলোচনা করে এর সমাধান বের করার পক্ষে বামপন্থীরা ওকালতি করে। ৩৭০ ধারা তোলার বিষয়ে কেউ কথা বললেই ওরা রে রে করে তেড়ে আসে।
বামপন্থীরা বর্তমানে চিনপন্থী। ভারতের যেমন কাশ্মীর চিনের তেমন শিনজিয়াং প্রদেশ। কাশ্মীর যেমন ভারতের মাথাব্যাথা, শিনজিয়াং চিনের। সমস্যা ও তার চরিত্র হুবহু এক। শিনজিয়াং চিনের মুসলিম বহুল প্রদেশ। মধ্য এশিয়ার মুসলিমদেশগুলির গায়ে লাগা তার অবস্থিতি। শিনজিয়াং প্রদেশে উগ্রপন্থা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তাদের সামলাতে যে সব ব্যবস্থা চিন গ্রহণ করেছে সেগুলি কাশ্মীরে কি প্রয়োগ করা যাবে ? আমাদের বামপন্থীদের কাছে এর জবাব চাইবার অধিকার দেশবাসীর আছে।
চিন কি শিনজিয়াং প্রদেশে ৩৭০ ধারা টাইপ কোনও সুবিধা সেখানকার মূল অধিবাসী উইঘুর মুসলিমদের দিয়েছে ? কদাপি না। বরং উইঘুরদের বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবনতা ও স্বাধীনতাকামিতা দেখে চিন তার মূল অধিবাসী হানদের বেশি বেশি করে শিনজিয়াং প্রদেশে বসবাস করার উৎসাহ জুগিয়েছে। গত ৬০ বছর ধরে হানরা শিনজিয়াং প্রদেশে অনুপ্রবেশ করে করে সেখানকার জনসংখ্যাগত চরিত্রে বিশাল পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলেছে। প্রদেশের সাংস্কৃতিক চরিত্রে ইসলামকে দাবিয়ে হান সংস্কৃতির ব্যপক প্রচার রাষ্ট্রীয় মদতে সম্ভব হচ্ছে।
দেশের অখণ্ডতা রক্ষায় কম্যুনিস্ট চিন যে কোনও সীমা অব্দি যেতে পারে। তার প্রমাণ সম্প্রতি পাওয়া গেছে। বলা হচ্ছে উইঘুর মুসলিমরা প্রদেশে অশান্তি করছে। ওরা উগ্রপন্থার দিকে ঝুঁকছে। চিনের মূলস্রোত থেকে ওরা নিজেরদের পৃথক করে রাখতে চাইছে। শিনজিয়াং প্রদেশে কম্যুনিস্ট চিনের ব্রজ্রকঠিন শাসন প্রবল দৃঢ়তায় উইঘুর মুসলিমদের টুঁটি চেপে ধরেছে।
চিনের কম্যুনিস্ট সরকারের বকলমে শিনজিয়াং প্রদেশ সরকার মুসলিমদের ধর্মাচরণের স্বাধীনতায় প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ করতে লেগেছে। সম্প্রতি বিশেষ কোনও ধর্ম গোষ্ঠীর কথা উল্লেখ না করেও যে সব বিধিনিষেধ বলবত করা হয়েছে তাতে মুসলিমদেরই যে টার্গেট করা হয়েছে তা স্পষ্ট বোঝা যায়। যেমন বলা হয়েছে শিনজিয়াং প্রদেশের অধিবাসীরা দাড়ি বাড়াতে পারবে না(মুসলিমদের অনেকেই ধর্মীয় চিহ্ন হিসেবে লম্বা দাড়ি রাখে, এখন থেকে এটা চলবে না)। আপাদমস্তক ঢাকা পোশাকে কেউ পথে বেরোতে পারবে না। ( অর্থ বোরখা নিষিদ্ধ)। সন্তানদের ধর্মীয় অর্থবোধক বা ওইরকম ইঙ্গিতবাহী কোনও নাম রাখা যাবে না। (যেমন মহম্মদ)। জনসংখ্যা সংক্রান্ত চিন সরকারের নীতি কঠোর ভাবে পালন করতে হবে। সমস্ত ছাত্রছাত্রীদের বাধ্যতামুলক ভাবে সরকারী বিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণে যেতে হবে (অর্থ-মাদ্রাসা শিক্ষা বন্ধ)। উত্তেজনাপূর্ণ ধর্ম ব্যাখ্যা মুলক ভিডিও অডিও প্রচার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ (অর্থ জাকির নায়েক টাইপের ধর্ম প্রচার)। এই সব আইন ভঙ্গ কারীদের ধরে নিয়ে গিয়ে দীর্ঘমেয়াদী কারাবাসের ব্যবস্থাও করা হয়েছে।
শিনজিয়াং প্রদেশে ইসলাম দমনে সে দেশের কম্যুনিস্ট সরকার যে সব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে তার সম্পর্কে ভারতের চিনমুখী বামাবতারগণ কী মনোভাব পোষণ করেন তা জানার সম্পূর্ণ অধিকার এদেশের মানুষের রয়েছে। এই সম্পর্কে যাদবপুরের স্বাধীনতাকামীদের স্পষ্টীকরণও এই মুহূর্তে জানা দরকার। কারণ আগে বা পরে ভারত সরকার যদি এই একই ব্যবস্থা কাশ্মীরে গ্রহণ করে তখন তাদের ভুমিকা কী হবে এটা পরিষ্কার হওয়া উচিত। কাশ্মীরে ভারতের ভুমিকা যদি নিন্দনীয় হয় তবে শিনজিয়াং প্রদেশে চিনের কমুনিস্ট সরকারের ভুমিকা ও নিন্দনীয়। বামপন্থীরা চিনের এই কঠোর ব্যবস্থাকে পীড়নমূলক, অত্যাচারী, মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী ইত্যাদি বিশেষণে যদি ভূষিত করতে না পারেন তবে কাশ্মীর সম্পর্কে বিরূপ প্রচারের জন্যে তাদের কেন দেশদ্রোহী বলা হবে না সে ব্যাখ্যাও তাদের দিতে হবে।