কলকাতার শতাব্দী প্রাচীন লোরেটো কলেজ (Loreto College)-এর স্নাতক স্তরের প্রথম মেধা তালিকা (1st Merit List for Admission) ঘিরে বিতর্ক ছড়িয়েছে। লোরেটো কলেজের ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক স্তরে ভর্তির মেধা তালিকা। তাতে একদম প্রথম অনুচ্ছেদেই লেখা আছে- যেসব ছাত্রীরা ক্লাস ১২-এ বাংলা বা অন্যান্য মাধ্যমে পড়েছে, স্নাতক স্তরের মেধা তালিকায় তাদের নাম বিবেচনা করা হয়নি। যে সকল ছাত্রী ইংরেজি মাধ্যমে পড়েছে, শুধুমাত্র তাদের আবেদনপত্রই বিবেচনা করা হয়েছে। কারণ হিসাবে দেখানো হয়েছে- যেহেতু, কলেজের লাইব্রেরিতে শুধুমাত্র ইংরেজি ভাষার বই ও জার্নাল রয়েছে (বাংলা এবং হিন্দি সাহিত্যের বই ছাড়া) এবং যেহেতু কলেজে ক্লাস নেওয়া হয় ইংরেজি ভাষায়, কলেজে পরীক্ষার মাধ্যম ইংরেজি, তাই কলেজ কর্তৃপক্ষ শুধুমাত্র ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্রীদেরই বিবেচনা করছে। সূত্র মারফত জানা গিয়েছে, ভর্তির আবেদন করার সময় এ বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি। আবেদনের টাকাও জমা নেওয়া হয়েছিল।
এই ঘোষণার আড়ালে কলেজ-কর্তৃপক্ষের মানসিকতা স্পষ্ট বোঝা যায়। তাঁরা সম্ভবত মনে করেন, বাংলা মাধ্যমের ছেলেমেয়েরা ইংরেজি ভাষায় তেমন দক্ষ নয়। আজকে, সারা পৃথিবী যখন সবার জন্য উন্মুক্ত হয়ে গেছে, সারা বাংলা থেকে শয়ে-শয়ে ছেলেমেয়ে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ছে কাজের সূত্রে, তখন এ ধরনের সিদ্ধান্তকে নিতান্ত মূঢ়তার বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। সারা বিশ্বের শিল্প, বাণিজ্য, বিজ্ঞান, শিক্ষাক্ষেত্রে ভারতীয়দের রমরমা। তাঁদের একটা বিরাট অংশ বাঙালি। কর্তৃপক্ষের মনে রাখা দরকার, তাঁদের মধ্যে অনেকেই কিন্তু গাঁ-মফঃস্বলে বেড়ে উঠেছেন, যেখানে পড়াশোনা চলে বাংলা মাধ্যমেই। তারপরেও সারা বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত হতে তাঁদের অনেকেরই অসুবিধা হয়নি।
লোরেটো কলেজের ইতিহাস শতাব্দীপ্রাচীন। ১৯১২ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই এই কলেজ রাজ্য তথা দেশের শিক্ষা-মানচিত্রে একটি উজ্জ্বল নাম। একসময় ক্যাথলিকদের জন্য খোলা হলেও পরে এখানে সব জাতি-ধর্মের ছাত্রীরাই প্রবেশাধিকার পায়। এই কলেজ থেকে পাশ করে পরবর্তীকালে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন বহু গুণীজন। তাঁরা কি এই ঘোষণায় খুশি? লোরেটোর বিজ্ঞপ্তি বিতর্ক নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধিকারিক দেবাশিস দাস জানিয়েছেন, যে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে এরকম কোনো বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়নি। কেন লোরেটো এমন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করল সে বিষয়ে জবাব চাওয়া হয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে।
এই বাংলা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাংলা। যাঁর হাত ধরে এসেছিল ভারতের প্রথম নোবেল পুরস্কার। যে গ্রন্থের জন্য এই স্বীকৃতি, তার মূল গ্রন্থ গীতাঞ্জলি লেখা হয়েছিল বাংলা ভাষাতেই। এই বাংলা রামমোহন-বিদ্যাসাগরের, যাঁরা গুলে খেয়েছিলেন পাশ্চাত্য দর্শন। সেগুলি নিশ্চয়ই বাংলা বা সংস্কৃত ভাষায় লেখা হয়নি। কিন্তু তখনকার ঔপনিবেশিক শাসনও বাংলা ভাষাকে তাঁদের চর্চা আর মনন থেকে সরিয়ে দিতে পারেনি। সৈয়দ মুজতবা আলি একাধিক ভাষার মহাপণ্ডিত, কিন্তু তাঁর মতো গদ্যকার বাংলা ভাষায় এসেছেন কতজন? মধুকবির মতন এক লাইন ইংরেজি বা বাংলা কবিতা লিখতে পারবেন কি কেউ? প্রধানত বিজ্ঞান চর্চাতে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার প্রবল। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের বই প্রায় নেই-ই। কিন্তু তা বিজ্ঞান-লেখকদের দায়, বাংলা ভাষার ত্রুটি নয়। এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিখ্যাত পদার্থবিদ সত্যেন্দ্রনাথ বসুর একটি উক্তি স্মরণীয়, “যাঁরা বলেন বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা হয় না, তাঁরা হয় বাংলা জানেন না, নয় বিজ্ঞান বোঝেন না।”
ভাষা শুধুমাত্র ভাব-প্রকাশের মাধ্যমই নয়, ভাষা জাতির সংস্কৃতি আর ইতিহাসের অংশ। বাংলা ভাষার ক্রমাগত কোণঠাসা হয়ে পড়া নিয়ে আলোচনা কম হয়নি। ইংরেজি-হিন্দির আগ্রাসনে বাংলা মাধ্যমের গুরুত্ব ক্রমেই কমেছে। ছাত্রছাত্রী আর অভিভাবকরা অনেকে একে সমর্থনও করেন। বাংলা ভাষা ঠিকঠাক বলতে না পারলে আত্মশ্লাঘাও অনুভব করেন অনেকেই। কিছুদিন আগে পাঠভবন স্কুল কর্তৃপক্ষ ২০২৪ সাল থেকে বাংলা মাধ্যম তুলে দেওয়ার ঘোষণা করেছে। বাংলা বিজ্ঞাপনে ইদানীংকালে সরাসরি হিন্দি শব্দ বা হিন্দি শব্দের নিম্নস্তরের বঙ্গানুবাদ জ্বলজ্বল করে। কিন্তু বাংলা মাধ্যমের ছাত্রীদের ভর্তির জন্য বিবেচনা না করার সিদ্ধান্ত এই দুর্দিনেও বিরল, যার মতো উদাহরণ সমকালে অন্তত স্মরণে আসে না। এই ভাষা বিভাজনের (Language Divide) পিছনে লুকিয়ে আছে ঔপনিবেশিকতা-প্রীতি (Colonial Hangover) যা স্বাধীনতার ৭৬ বছর পর একেবারেই দৃষ্টিকটু। এই ঔপনিবেশিকতা প্রীতি লুকিয়ে আছে রাস্তার নামে, স্থাপত্যের নামে, ইংরেজি ভাষা বলতে পারার আত্মশ্লাঘায়, ইংরেজি বলতে পারাকে শিক্ষিত হওয়ার মাপকাঠি হিসাবে বিবেচনা করায়। যা নতুন করে বেরিয়ে এল কলেজ-কর্তৃপক্ষের এই নির্দেশে।
লোরেটো কলেজের ইতিহাস শতাব্দীপ্রাচীন। ১৯১২ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই এই কলেজ রাজ্য তথা দেশের শিক্ষা-মানচিত্রে একটি উজ্জ্বল নাম। একসময় ক্যাথলিকদের জন্য খোলা হলেও পরে এখানে সব জাতি-ধর্মের ছাত্রীরাই প্রবেশাধিকার পায়। এই কলেজ থেকে পাশ করে পরবর্তীকালে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন বহু গুণীজন। তাঁরা কি এই ঘোষণায় খুশি? লোরেটোর বিজ্ঞপ্তি বিতর্ক নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধিকারিক দেবাশিস দাস জানিয়েছেন, যে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে এরকম কোনো বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়নি। কেন লোরেটো এমন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করল সে বিষয়ে জবাব চাওয়া হয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে।
বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তাগিদ মাঝেমধ্যে ছোটোবড়ো আকারে দেখা যায় ঠিকই। প্রতিবাদও চোখে পড়ে, বিশেষত সামাজিক মাধ্যমে। কিন্তু সব কিছু মেনে নেওয়ার যুগে দাঁড়িয়ে বৃহত্তর বঙ্গসমাজ মেনে নিয়েছে এতদিনের সমস্ত বিদেশি-ভিনরাজ্যের ভাষার আগ্রাসনকেই। এক্ষেত্রেও সামাজিক মাধ্যমে আজ সকাল থেকে প্রতিবাদ দেখা যাচ্ছে। প্রতিবাদ করছেন সমাজের সর্বস্তরের মানুষ। এতে কাজ হবে, নাকি নতুন ভাইরাল পোস্টের তলায় ‘মেমোরি’ হিসাবে চাপা পড়ে যাবে, তার উত্তর দিতে হবে সাধারণ মানুষকেই।