প্রথা অনুসারে আইন প্রণয়নই ভারতের সংসদের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। যারা এই কাজ অতিবাহিত করেন তারা হচ্ছেন দেশের আইন প্রণেতা অর্থাৎ সাংসদ। ভারতের সংবিধানের ২৪৫ ও ২৪৬ নম্বর অনুচ্ছেদ মতে সংসদ সমগ্র ভারতে অথবা দেশের বিশেষ কোন অঞ্চলের জন্য আইন প্রণয়ন করতে পারে। সংবিধানের সপ্তম তফসিলে আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত বিষয়গুলিকে তিনটি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এগুলি হচ্ছে কেন্দ্রীয় তালিকা, রাজ্য তালিকা ও যুগ্ম তালিকা। কেন্দ্র তালিকায় সংসদের ক্ষমতা পরিপূর্ণ। যুগ্ম তালিকাভুক্ত কোনও বিষয়ে সংসদের আইনের সঙ্গে বিধানসভা প্রণীত আইনের বিরোধ দেখা দিলে পূর্বোক্ত আইন বলবৎ থাকে। অবশিষ্ট বিষয়ে আইন তৈরির ক্ষমতা সংসদের উপর অর্পিত হয়েছে।
সংবিধানের ১১ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুসারে নাগরিকত্ব অর্জন, বাতিল বা এই সংক্রান্ত বিষয়ে আইন করার বল্গাহীন ক্ষমতা রয়েছে সংসদের। আর সংবিধান প্রদত্ত এই ক্ষমতা অনুসারেই ১৯৫৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর সংসদে পাশ হয় নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫৫। ইতিমধ্যে এই আইন সংসদে বেশ কয়েকবার সংশোধনও হয়েছে। ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনকে আবার সংশোধনের জন্য কেন্দ্রের বর্তমান ক্ষমতাসীন মোদি সরকার ২০১৬ সালের ১৯ জুলাইয়ের বাদল অধিবেশনে লোকসভায় এক সংশোধনী বিল পেশ করে। তখন বিল নম্বর ছিল ১৭২। কংগ্রেস দলসহ অন্যান্য সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রবল বিরোধিতায় বিগত ১১ আগস্ট, ২০১৬ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ বাধ্য হয়ে বিলটি আরো খুঁটিয়ে পরীক্ষণের জন্য যৌথ সংসদীয় কমিটিতে পাঠানোর সিদ্ধান্তের কথা জানান। যৌথ সংসদীয় কমিটি খুঁটিয়ে পরীক্ষা করার উপর ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি তারিখে লোকসভায় পেশ করে ৪৩৮ পাতার এক দীর্ঘ রিপোর্ট। এই রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলে নতুন সংযোজন ঘটে—
“any proceeding pending against any person belonging to minority communities, namely. Hindus, Sikhs, Buddhists, Jains, Parsis and Christians from Afghanistan, Bangladesh and Pakistan shall be abated and such person shall be eligible to apply for naturalisation under section 6 of the Citizenship Act. 1955”
২০১৯ সালের ৮ জানুয়ারি তারিখে লোকসভায় নতুন সংযোজন নিয়ে পেশ হয় নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল, ২০১৯। বিল নম্বর ‘১৭২-সি’। ওইদিনই লোকসভায় বিলটি পাশ হয়। পরে রাজ্যসভায় বিলটি লোকসভা থেকে পাঠানো হয়। রাজ্যসভায় আলোচনার জন্য ১২ ও ১৩ জানুয়ারি তারিখে সংশোধিত তালিকায় আলোচনার জন্য রাখা হয়। কিন্তু সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি হট্টগোলের জন্য রাজ্যসভা ১৩ জানুয়ারি দুপুরবেলা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে যায়। উল্লেখ্য রাজ্যসভায় সরকার পক্ষের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। আর এটাই ছিল বর্তমান কেন্দ্রে সরকারের শেষ অধিবেশন। তাই এই সংশোধনী বিলটি সংসদ কর্তৃক আইনে রূপান্তরিত হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। কেননা লোকসভা নির্বাচনের ঘণ্টা বেজে যাবে কিছুদিনের মধ্যে। সংসদের উভয় কক্ষের অধিবেশন বন্ধ। নতুন লোকসভা গঠন করতে হবে ৩ জুনের মধ্যে। তাই নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল, ২০১৯-এর মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে ৩ জুন। কিন্তু মেয়াদ থেকে কী হবে। যেহেতু ষোড়শ লোকসভা ভঙ্গ হয়ে যাবে এবং যেহেতু নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিলটি উত্থাপন হয়েছিল লোকসভায় সেইহেতু লোকসভা ভঙ্গের সাথে সাথে বিলটির মেয়াদ ফুরিয়ে যাবে। নতুন সরকার শাসন ক্ষমতায় আসার পর পুনরায় বিলটি লোকসভায় উত্থাপন করতে হবে। প্রয়োজনে আবার আলোচনা হবে এবং সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানো হতেও পারে। লোকসভায় পাস করানোর পর রাজ্যসভায় পাস করাতে হবে। তাই এককথায় নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিলের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এই অবস্থায় অধ্যাদেশ হচ্ছে একমাত্র নিরাপদ সমাধানসূত্র। উল্লেখ্য রাম মন্দির ও তিন তালাকের বিষয় থেকে নাগরিকত্বের অধ্যাদেশের বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। কেননা নাগরিকত্ব বিলের প্রস্তাবিত নাগরিকত্বের বিষয়টি সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে one time amnesty। আর এই কাজ বর্তমান মোদি সরকারের পক্ষেই সম্ভব। ৭০ বছরের পুরানো সমস্যা নিরসনে এগিয়ে এসেছে একমাত্র বিজেপি সরকার। সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে লোকসভায় এই বিল পাস করিয়েছিল। বিলের পক্ষে মতামত প্রদান করেছিল সিলেক্ট কমিটি। তাই নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল নিয়ে সরকারের প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাতেই হবে।
অন্যদিকে আধুনিক জীবনে নাগরিকত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। রাষ্ট্রীয় নাগরিকত্ব হচ্ছে গণতন্ত্রের ব্যাপার। কিন্তু এই নাগরিকত্বের নামে সাধারণ আমজনতা সমগ্র অসমে যেভাবে হয়রানি হচ্ছেন তা এককথায় সভ্যসমাজে অকল্পনীয়। কেননা অসমে একশটি ট্রাইবুন্যালে প্রতিদিন হাজার হাজার হিন্দু মানুষ নানাভাবে হেনস্থা হচ্ছেন। এই নাগরিকত্বের নামে দীর্ঘদিন থেকে হিন্দু মানুষ ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দি। ইতিমধ্যে প্রকাশিত এন.আর.সি-র খসড়ায় ৪০ লক্ষ মানুষের নাম আসেনি। পুনরায় দাবি ও আপত্তির সময় প্রায় ৮ লক্ষ মানুষ তাদের নিজ নিজ দাবি দাখিল করতে পারেননি। দাবি দাখিল যারা করেছেন তাদের মধ্যে প্রায় আড়াই লক্ষ মানুষের উপর আবার আপত্তি দাখিল হয়েছে। অসমের লক্ষ লক্ষ ভোটারের গায়ে ডি-ভোটার তকমা লাগানো। এদের বেশিরভাগ হিন্দু মানুষ বলে জানা যায়। অসমের এই নাগরিকত্ব সমস্যা লাঘবের জন্য ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনকে সংশোধন করা এইমুহুর্তে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং জরুরি।
বর্তমান পরিস্থিতিতে এই প্রয়োজনবোধের সাংবিধানিক ক্ষমতা রয়েছে একমাত্র রাষ্ট্রপতির কাছে। কেননা সংবিধানের ১২৩ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ (Ordinance) জারি করে আইন লাগু করতে পারেন। সাধারণত যখন সংসদ অকার্যকর থাকে অথবা যখন সংসদের অধিবেশন বন্ধ থাকে তখন জরুরি প্রয়োজনে রাষ্ট্রপতির কাছে কেন্দ্রীয় ক্যাবিনেট প্রস্তাব পাঠালে রাষ্ট্রপতি নিজের একক ক্ষমতার বলে যে আইন জারি করে থাকেন সেটাকে আমরা ‘অধ্যাদেশ’ হিসাবে জানি। এই সমস্ত অধ্যাদেশ আইনের মর্যাদা ও গুরুত্ব পায়। একমাত্র এই সমস্ত অধ্যাদেশের ক্ষেত্রে সংসদ চালু হওয়ার ছয় সপ্তাহের মধ্যে সংসদের অনুমোদন নিতে হয়। একথা বলা হয়, রাষ্ট্রপতির সন্তুষ্টি বিচার বিভাগের এক্তিয়ারের বাইরে।
উল্লেখ্য, এই অধ্যাদেশ জারি করার ক্ষমতা নিয়েও দেশের সর্বচ্চ আদালত অর্থাৎ সুপ্রিমকোর্টে বেশ কয়েকবার মামলা হয়েছে। এইসব মামলা থেকে পরিষ্কার যে অধ্যাদেশের সাংবিধানিক বৈধতা স্বীকৃত। কিন্তু রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারি করার ক্ষমতা কিন্তু সংসদের আইন সংক্রান্ত ক্ষমতার মতোই সীমাবদ্ধ। কোন বিচারাধীন বিষয়, মৌলিক অধিকার, সপ্তম তফশিলে বর্ণীত আইন সংক্রান্ত ক্ষমতার ক্ষেত্রে অধ্যাদেশ জারি করা যায় না। সে যাইহোক বর্তমান আলোচিত নাগরিকত্ব নিয়ে আদালতে কোনও মামলা দাখিল হয়নি। প্রস্তাবিত নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের পটভূমি কিন্তু সেই ১৯৪৭ সালের সাম্প্রদায়িক বিভাজন। কারণ পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানে সংখ্যালঘুদের উপর ধর্মীয় নির্যাতন সর্বজনবিদিত। শুধু তাই নয়, ওইসব সংখ্যালঘুদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণও করা হয়। তার জ্বলন্ত প্রমাণ হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারের ধর্ম মন্ত্রালয়ের বাজেট। সংখ্যালঘু হিন্দু জনগোষ্ঠীর উপর লাগাতার আক্রমণের পিছনে রয়েছে একটিমাত্র কারণ। কারণটি হচ্ছে ‘এথনিক ক্লিনজিং’, অর্থাৎ সংখ্যালঘু-শূন্য রাষ্ট্রে পরিণত করা। বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সংখ্যাগুরুরা প্রকৃতপক্ষে চায় না বাংলাদেশে একটিও হিন্দু পরিবারের অস্তিত্ব থাকুক। তাইতো চলছে ধারাবাহিক আক্রমণ। তার জ্বলন্ত প্রমাণ হচ্ছে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সরকারি জনগণনার রিপোর্ট। এই কারণেই ওদের ভারতে আশ্রয় নেওয়াটা অতি স্বাভাবিক। তাই কেন্দ্রের সরকার মানবিক কারণেই ২০১৫ সালের ৮ সেপ্টম্বর তারিখে দু’টি রুলসের সংশোধনী করে তাদের ভারতে বসবাসের অধিকার দিয়েছে। এই দুটি রুলসের সাথে মিল রেখেই আনা হয়েছিল এই নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল, ২০১৯। বিরোধীরা বলছেন, ওই বিলে নাকি ‘নাগরিকত্বের’ কোনও স্পষ্ট সংজ্ঞা ভারতবর্ষের সংবিধান বা ভারতের কোন আইনেও নেই। সংশোধনীতে দেশীয়করণের মাধ্যমে নাগরিকত্ব প্রদানের কথা বলা হয়েছে। তাই ঢালাও নাগরিকত্ব বা পাইকারিভাবে নাগরিকত্ব প্রদানের কথা না থাকা বাস্তবসম্মত।
আবার ফিরে আসি মূল বিষয়ে, বর্তমান পরিস্থিতি বিচার করে ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনী দেশে আনতে হলে বর্তমান কেন্দ্র সরকারের কাছে একটিমাত্র রাস্তা খোলা রয়েছে। তবে সবকিছু নির্ভর করবে সরকারের মানসিকতা ও ইচ্ছাশক্তির উপর। কারণ সংবিধান মতে কেন্দ্রীয় ক্যাবিনেট রাষ্ট্রপতির কাছে দেশে অধ্যাদেশ জারি করে নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনী লাগু করতে চায় বলে একটি প্রস্তাব পাঠাতে হবে। আর এই প্রস্তাব পেয়ে রাষ্ট্রপতি এক অধ্যাদেশ জারি করতে পারেন। আর এই কাজ করতে হলে শীঘ্রই করতে হবে। কেননা ২০১৯ সালের লোকসভা ভোট আর দূরে নেই। বড়জোর আর এক মাস। তারপরই এসে যাবে সেই বহুপ্রতীক্ষিত মহাসংগ্রামের দিন।
দেশের শাসন ক্ষমতার মসনদ দখলের লড়াইয়ে মুখোমুখি হবে শাসক এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিও। নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে। তাই এক্ষুনি কেন্দ্রীয় ক্যাবিনেট অধ্যাদেশ জারির প্রস্তাব পাঠাক রাষ্ট্রপতির কাছে। তখনই রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ জারি করে সমগ্র দেশে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন লাগু করতে পারবেন। ইতিমধ্যে রাষ্ট্রপতি সংসদে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাস করানোর জন্য সংসদদের কাছে আবেদন করেছিলেন। কিন্তু বিফল হয়েছে সেই আবেদন। তাই এখন চাই অধ্যাদেশের মাধ্যমে নাগরিকত্ব সংশাধনী।
ধর্মানন্দ দেব