নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল বিগত লোকসভায় পাশ হয়েছিল। সেবার বিলটি রাজ্য সভাতে পাশ হতে দিলেন না তৃণমূল কংগ্রেসের মাননীয় সাংসদরা। নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাশ হলে সবচেয়ে বেশী উপকৃত হবেন পূর্বপাকিস্তান বা বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দু উদ্বাস্তুরা। বাংলার নেতা, নেত্রী, বুদ্ধিজীবী হয়ে বাংলাভাষী মানুষের এতবড় ক্ষতি করেছিলেন তাঁরা। দেশভাগের পর থেকে লাগাতার অত্যাচার হয়েছে পূর্ববঙ্গের হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রষ্টানদের উপর। সাংসদে নতুন করে বিলটি পেশ হওয়ার পরে শশী থারুর বলেছেন ধর্মের ভিত্তিতে কিভাবে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে তিনি তা বুঝতে পারছেন না। সংবিধানের ১৪তম অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ভারতবর্ষের সব ধর্মের নাগরিক সমান।
অবশ্যই সকলেই ভারতবাসী। কিন্তু যাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে তারা তো ভারতবাসীই নন। সংবিধান কেবল দেশের নাগরিকদের জন্যই প্রযোজ্য। কিন্তু যাঁরা পশ্চিমবঙ্গ থেকে সংসদে গেছেন? তারা তো নিজের চোখে এই অত্যাচারিত হয়ে পালিয়ে আসা মানুষদের কষ্ট দেখেছেন। যাদের চোখের সামনে পরিবারের এক একজন সদস্যকে খুন হতে দেখে বর্ডার পার হয়ে পালিয়ে এসেছেন, ধর্ষিতা মেয়ের মুখ চেপে ধরে সারারাত কান্নার শব্দ লুকিয়েছেন। তাদের ভারতে থাকতে নাদিলে কোথায় যাবেন? সেই মানুষগুলি এতবছর পরে সম্মানজনক নাগরিকত্ব পাবনে। এই কায়েমী স্বার্থের নেতৃত্ব স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবী যেটা বুঝতে পারছেন না? নাকি সবটুকু বুঝেও নিজের সাময়িক স্বার্থের কথা ভাবছেন।
নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯ অনুসারে পাকিস্তান, বাংলাদেশ আফগানিস্তান থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান, পারসি সম্প্রদায়ের মানুষ ভারতবর্ষে নাগরিকত্ব পাবেন। বাংলার আপামোড় মানুষ তো সেই ভীষণ অত্যাচার চোখের সামনে দেখেছে। সে সব খবরের কাগজ উদ্বাস্তুদের পরম কল্যাণকারী এই বিলটি “ধর্ম নাগরকিত্ব” বলে সমালোচনা করছে, বাংলাদেশ বা পূর্বপাকিস্তানে নরসংহারের সময় তারা নিজেদের ব্যবসা দেখেছে মানবতা দেখে নি। একদম সাম্প্রতিক ইতিহাস থেকে বলছি ২০০১ সালে যখন বাংলাদেশে ভয়াবহ দাঙ্গা হচ্ছে তখন এইসব প্রখ্যাত কাগজ একটি লাইনও ছাপেনি। পূর্নিমা শীলের ঘটনা নিউইয়র্ক থেকে লন্ডন সর্বত্র প্রকাশিত হয়েছিল। বিশ্ববাসী শিউড়ে উঠেছিল অধ্যাপক গোপাল কৃষ্ণ মুহুরীকে যেদিন নির্দয়ভাবে হত্যা করা হল, সারা পৃথিবীর মানুষ কেঁপে উঠেছিল। পৃথিবীর নৃশংসতার ইতিহাসে যেটি বিরলতম ঘটনা। কলকাতার এইসব বড় বড় কাগজে ভেতরের পাতাতেও একটু খবর প্রকাশিত হয়নি। তাই ওইসব কাগজের কাছে ধর্ম নাগরিকত্ব কখনোই ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত নিপীড়িত মানুষের নাগরিক অধিকার হয়ে উঠবে না। সেটাও স্বাভাবিক। অত্যাচারিত হিন্দু হয়েছে, বৌদ্ধ হয়েছে এমনকি ঢাকার নোটরডাম কলেজের অধ্যাপক ফাদার রিচার্ড নোভাককে ১৯৬৪ সালে নারায়ণ গঞ্জে খুন করা হয়েছে।
তাই খুন, ধর্ষিতা লুঠ হয়ে সব শ্রান্ত হয়েছেন হিন্দু, বৌদ্ধ আর খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের মানুষ, এদের প্রাপ্য অধিকারের সঙ্গে ভোট ব্যাঙ্ক সর্বস্ব রাজনৈতিক ব্যবসায়ীরা সাকিল আহমেদের নাগরিকত্ব দাবী করেছেন। যে সাকিল খাগড়া গড়ের বিস্ফোরণের মূল অভিযুক্ত ছিল। বাংলাদেশের এই নাগরিক রাজনৈতিক কল্যাণে ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড বানিয়ে স্লিপার সেল তৈরী করেছিল। রাষ্ট্রসংঘের যে সংস্থা আন্তর্জাতিক ভাবে উদ্বাস্তু বিষয়টি তত্ত্বাবধান করে তার নাম ইউনাইটেট নেশনস হাইকমিশন ফর রিফিউজিস (অই.এন. এইচ. সি. আর)। এই সংস্থা তাদের ১৯৫১ সালের জেনেভা কনভেনশন ও ১৯৬৭ সালের উরুগুয়ে প্রটোকল মতে উদ্বাস্তুর সঠিক সংজ্ঞা নিরুপন করছে। যদি কোন মানুষ তার ধর্ম,বর্ণ, জাতি রাজনৈতিক মতামত ব কোন বিশেষ সামাজিক সংস্থার সদস্য হওয়ার জন্য যদি নিজের দেশে অত্যাচারিত হন, এবং মনের মধ্যে গভীর ভয় থাকার জন্য সেই দেশে ফিরে যেতে না চান, তাহলে ওই ব্যক্তিকে দ্বিতীয় দেশে উদ্বাস্তু বলা হবে। সেই হিসাবে বাংলাদেশ বা পূর্বপাকিস্তান দেশ থেকে ধর্মীয় কারনে অত্যাচারিত হয়ে আসা হিন্দু, বৌদ্ধবা খ্রীষ্টানকে ভারতবর্ষের মানবিকতার প্রশ্ন। সারা পৃথিবীর কেউ এতে সাম্প্রদায়িকতা দেখবেন না দেখছেন কেবল পশ্চিমবঙ্গের কতিপয় স্বার্থন্বেষী মানুষ। ওই পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ বড় কাগজের উত্তর সাম্প্রদায়িক লেখা পন্ডিত মানুষেরা, সকলেই এইসব বোঝেন। তাঁরা জানেন এই পৃথিবীতে অত্যাচারিত হয়ে আসা উদ্বাস্তু আর অর্থনৈতিক বা অন্য কারণে আসা অনুপ্রবেশকারীকে একভাবে দেখা হয়না। পশ্চিমবঙ্গের নেতা নেত্রী হিসাবে বা খবরের কাগজের লেখক হিসাবে বা এনারা দন্ডকারন্যের কথা জানেন। মানা ক্যাম্পের কথা জানেন। কিন্তু বাঙ্গালী হিন্দু উদ্বাস্তুদের কথা সব কিছুর উর্ধ্বে গিয়ে বিচার করার হৃদয়টা হয়তো নেই। মূলতঃ বামপন্থীরাই খুব জোরের সঙ্গে বলেন যারা ওপার থেকে এসেছেন তারা সকলেই অর্থনৈতিক কারণে এখানে এসেছেন।
একজন উদ্বাস্তু পরিবারের ছেলে হিসাবে আমি বলতে পারি যে আমরা প্রায় কেউই অর্থনৈতিক কারণে এপারে আসে নি। ওপারের সবজি বিক্রেতা পরাণ বিশ্বাস এপারে এসে পাঁচতারা হোটেলের মালিক হয়ে গেছেন, এমন উদাহরণ প্রায় নেই। ওপারে সবজি বিক্রেতা এপারে সবজিই বেঁচছেন, সোনার দোকানের মালিক এপারে সোনার দোকানই দিয়েছেন। সেরকম একশো জন সবজিবিক্রেতাবা ধীবরের ছেলের মধ্যে একজন অধ্যাপক হয়েছে সেটা উদ্বাস্তু পরিবারেরও সত্যি, পশ্চিমবঙ্গের আদি বাসিন্দাদের জন্যও সত্যি। বাঙ্গালীরা অর্থনৈতিক কারণে ওপার থেকে এপারে এসেছে এটা একটি শিক্ষিত শয়তানি।
ঢাকার সূত্রাপুরে ঢোকার মুখে সেতুটার পুরাতন নাম লোহাপুল। লোহার পুল এখন কংক্রিটের সাঁকো হয়ে গেছে। সাঁকো পার হয়ে বাঁদিকে গ্যান্ডারিয়া থানার। গান্ডারিয়া থানার পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা এঁকেবেঁরে একেবারে বাংলা বাজারের দিকে চলে গেছে। সেই পথেই লক্ষ্মী নারায়ণ জড়িয়ের মন্দির। গোস্বামীদের এই মন্দিরটি বহুবার আক্রান্ত ও লুট হয়েছে। তবু এখনও মন্দিরটা টিকে আছে। ২০০১ সাল পর্যন্ত গোস্বামীরাও ছিলেন। তার উল্টোদিকের বাড়িটা আমাদের ছিল। আমার বাবার জন্মও ওই বাড়িতে। বাবা ম্যাট্রিক পাশ করেছিলন সেন্ট গ্রেগরী স্কুল থেকে, যে স্কুলে নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনও পড়তেন। আমাদের পরিবার ১৯৪৯ সালে ১৯৪৮ সালে ঢাকায় ভয়াবহ দাঙ্গা শুরু হল। বাবাদের পরিবার কলকাতায় চলে এলেন। বাবারা সব কিছু ছেড়ে দিয়ে কলকাতায় চলে আসে। আমার বাবারা অর্থনৈতিক কারণে ভারতবর্ষে আসেননি। তারা নিজেদের ধর্ম সংস্কৃতি বাঁচিয়ে সেখানে থাকতে পারবেননা বুঝে ভারতে চলে এসেছিলেন।
ঢাকার কমলাপুর স্টেশন থেকে যে কোন এক্সপ্রেস ট্রেনে পৌনে দু ঘন্টার পথ নরসিংদি। সেখান থেকে আরও ঘন্টাখানেক দুরের রাস্তা শিলমান্দি। শিলমান্দি আমার মায়ের গ্রাম ছিল। ১৯৫০ সালের মন্বন্তরে আমার দাদু হিন্দু মুসলমান সব গ্রামবীসীকে একবেলা খাইয়েছিলেন। সেই বিশ্বাসে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত মায়েদের পরিবার গ্রামে ছিল কিন্তু বাকি সব হিন্দু চলে আসে। মেয়ে বড় হচ্ছে, তাই মায়েদের পরিবারও পশ্চিমবঙ্গে চলে এল। তারাও অর্থনৈতিক কারণে আসেননি। আমার মামা অমূল্য ঘোষ স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। ভগত সিংহের ফাঁসির আদেশের প্রতিবাদে বি এ পরীক্ষার হল থেকে পালিয়ে এসেছিলেন। আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের নথিতে আজও অমূল্য ঘোষের নাম পাওয়া যাবে। জেলের অবর্ণনীয় অত্যাচারেই প্রকৃতপক্ষে মামা ৩৫ বছর বয়সে মারা যান। আমার মেয়েরা অনেক ভাই বোন। মা ছিলেন সবচেয়ে ছোট মা জ্ঞান হওয়ার পরে মামাকে কখনো দেখেন নি। কিন্তু ঘরের এখানে ওখানে লুকিয়ে রাখা স্বদেশী প্রচারপত্র দেখে বড় হয়েছেন।
আমার পরিবার অখ্যাত, কিন্তু দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের কিংবা বাঘাযতীনের পরিবারের কারোকে যদি ভারতবর্ষ আসার পরে নাগরিকত্ব দেওয়া নিয়ে টালবাহানা করা হত তবে কি সমগ্র দেশের কাছে সেটা লজ্জার বিষয় হত না?
বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তের জন্ম ব্রাহ্মণবেড়িয়ায় হয়েছিল। স্বাধীনতার পরে উনি নিজের গ্রামে ফিরে গিয়ে সেখানে থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই কলকাতায় চলে আসতে হয় তাঁকে। অমূল্য ঘোষের মত শত শত দেশপ্রেমিকের নাম হয়ত সবাই জানি না যাঁরা পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ভারতবর্ষকে স্বাধীন করার জন্য লড়েছেন। দেশের বাড়ি ছেড়ে মানুষ আসতে চায় নি। অনেক অত্যাচারিত হয়ে একান্ত বাধ্য হয়েই তাঁরা দেশ ছেড়েছেন। এক এক দশকে অত্যাচারের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। কেউ ষাটের দশকে কেউ সত্তরের দশকে আবার কেউবা তারাও পরে এদেশে এসেছেন। কেউ অর্থনৈতিক কারণে আসেন নি। নিজের ধর্ম সংস্কৃতি পরিত্যাগ করবেন না বলেই তারা এদেশে এসেছেন। তাদের নাগরিকত্ব তো অনেক আগেই দেওয়া উচিৎ ছিল।
আজকের বাংলার সকল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের সামনে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল একটা মস্ত বড় চ্যালেঞ্জ। যারা এতবছর ধরে নির্যাতিত, বঞ্চিত মানুষ তাদের জন্য একটা মানবিক কাজ করা। এরাজ্যে কেবলমাত্র ভোট ব্যবসায়ী রাজনৈতিক নেতা নেত্রী নেই, শুধুমাত্র পিঠ বাঁচানো উন্নাসিক লোকই বাংলার মনীষাকে গ্রাস করে ফেলেনি, বাংলায় আজও হৃদয়বান, সাহসী মানুষ আছেন। তারা শিয়ালদহ স্টেশন থেকে মরিচঝাঁপি পর্যন্ত এই ভাগ্য হত মানুষদের কষ্টের কথা জানেন। এমন হাজারে হাজারে তরুণ যুবক ঘরে ঘরে গিয়ে প্রতিটি বাঙ্গালী, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান উদ্বাস্তুকে খুঁজে বের করবে, কায়েমী স্বার্থের রাক্ষসকূলের সামনে বুক চিতিয়ে বলবে, ভারতবর্ষের নাগরিকত্ব এই অত্যাচারিতদের অধিকার। কে আছে এমন ডাকু যে এই হতভাগ্যদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে নিজের ক্ষুদ্রস্বার্থ পূর্ণ করবে? এ লড়াইয়ে আমাদের জিততেই হবে। না হলে আমাদের মহান পূর্বপুরুষরা আমাদের ক্ষমা করবেন না।