পশ্চিমবঙ্গের বসিরহাট শহরের নিকটবর্তী ঘোজাডাঙ্গা সীমান্ত থেকে মাত্র ৪৪ কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশের চুকনগর। বিজয়া দশমীতে ইছামতী নদীতে যেখানে ‘দুই বাংলার মিলন’ নামক নাটক মঞ্চস্থ হয়, সেখান থেকে কতই বা দূর! বঙ্গভূমির সবচেয়ে বড় পরিকল্পিত বাঙ্গালী হিন্দুর গণহত্যা হয়েছিল সেখানেই ২০শে মে, ১৯৭১ সালে। বাংলাদেশের খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগরে পশ্চিম পাকিস্তানি উর্দুভাষী খান সেনা আর পূর্ব পাকিস্তানি বাঙ্গলাভাষী রাজাকারেরা ১০ থেকে ১২ হাজার বাঙ্গালী হিন্দুকে হত্যা করেছিল। চুকনগর গণহত্যা পৃথিবীর যেকোনো দেশের মুক্তিযুদ্ধের সর্ববৃহৎ একক গণহত্যা।
পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ অধুনা বাংলাদেশে রাজাকার বাহিনী গড়ে ওঠার পর হিন্দুদের উপর অত্যাচার সংগঠিত ও হিংস্রতর রূপ নেয়। জামায়াতের অন্যতম শীর্ষনেতা মওলানা ইউসুফের নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী গড়ে ওঠে ৫ মে। এরপর থেকে খুলনা শহর সহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় ত্রাসের মাত্রা বেড়ে যায়। রাজাকাররা বেছে বেছে ধরে এনে ‘কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে’ নিয়ে অত্যাচার চালায়, হত্যা করে, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ঘরবাড়ি লুট সহ হত্যা, নির্যাতন ও নারী নিগ্রহ চালাতে থাকে। এরই মধ্যে আসে ১৫ মে। খবর ছড়িয়ে পড়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা আসছে লোকজন ধরতে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিতে। ফলে ভয়ের মাত্রা দ্বিগুণ হয়।
অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে ধর্ম প্রাণ মান সম্ভ্রম বাঁচাতে পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলের হিন্দুরা ভারতে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। মে মাসের মাঝামাঝি সময় বৃহত্তর খুলনার বাগেরহাট, রামপাল, মোড়েলগঞ্জ, কচুয়া, শরণখোলা, মংলা, দাকোপ, বটিয়াঘাটা, চালনা, ফরিদপুর, বরিশালসহ বিভিন্ন অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ ভারতে যাবার উদ্দেশে রওনা হন। ভারতে যাবার জন্যে তারা ট্রানজিট হিসেবে বেছে নেন ডুমুরিয়ার চুকনগরকে। নদী পেরিয়ে প্রাণভয়ে জড়ো হয় চুকনগর বাজার, পাতখোলা ও ভদ্রা নদীর চারপাশে, যাতে তারা সাতক্ষীরার সড়ক ধরে বর্ডার পাড়ি দিতে পারে। কিন্তু পথে সেনাদের মুখোমুখি হওয়ার ভয়ে তারা কোথাও যেতে পারে না। ফলে বিশাল এক জনগোষ্ঠীর সম্মিলন ঘটে এলাকায়। ১৯মে রাতে সবাই চুনগরে এসে পৌঁছান। পরদিন সকালে সাতক্ষীরা এবং কলারোয়ার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করার জন্য লক্ষাধিক হিন্দু চুকনগরে সমাবেত হন।
২০ মে বেলা ১১টার সময় দুটি দল একটি ট্রাক ও একটি জিপ গাড়িতে এসে চুকনগর বাজারের উত্তর প্রান্তে "কাউতলা" নামক একটি স্থানে এসে থামে। পাতখোলা বাজার থেকে তারা গুলি চালনা শুরু করে এবং পরবর্তীতে চুকনগর বাজারের দিকে অগ্রসর হয়। বিকেল তিনটা পর্যন্ত গোলাগুলি চলতে থাকে। পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার মোহাম্মদ হায়াত এই গণহত্যার নেতৃত্ব দেয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে মৃতের সংখ্যা ১০ হাজার বা তারও বেশী। মৃতদেহগুলো নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।
গণহত্যার পর নদীতে লাশ আর রক্তের স্রোত দেখে আঁতকে উঠেছিলো জীবিত থাকা অবশিষ্টরা। আটলিয়া ইউনিয়নের পাতাখোলার বিল থেকে ভদ্রা নদী এবং সাতক্ষীরা রোড থেকে ঘ্যাংরাইল নদী পর্যন্ত যতোদূর দেখা যায় শুধু লাশ আর লাশ ছিল। ২০ তারিখের পর ২৪ তারিখ পর্যন্ত টানা চারদিন লাশ সরানোর কাজে ব্যস্ত ছিল ৪২ জনের একটি দল। লাশ পিছু ৫০ পয়সা পারিশ্রমিক দেওয়া হত তাদের। তবে মৃতদেহ হাতড়ে পকেটে পাওয়া টাকা ও শরীরের অলংকার সেই ৫০ পয়সাকে তুচ্ছ করে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য থেকে জানা যায়, ২৪ তারিখ দুপুর পর্যন্ত চার হাজার লাশ গুণে শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দেয় তারা। এই গণনার মধ্যে নদী, পুকুর, ডোবা, জলায় ভাসমান হাজার হাজার লাশ অন্তর্ভুক্ত ছিল না। অথচ ভিয়েতনাম যুদ্ধে একসাথে কয়েকশো মানুষ হত্যার বিষয়টি অনেক বড় গণহত্যা হিসেবে আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃত যা চুকনগরের হত্যাকাণ্ডের তুলনায় নগণ্য। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে চুকনগর গণহত্যা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে সাংবাদিক ফজলুল বারী জনকণ্ঠের এক নিবন্ধে লিখেছিলেন-
'লাশের উপর লাশ, মায়ের কোলে শিশুর লাশ, স্বামীকে বাঁচাতে স্ত্রী জড়িয়ে ধরেছিল। বাবা মেয়েকে বাঁচাতে জড়িয়ে ধরেছিল। মুহূর্তেই সবাই লাশ হয়ে যায়। ভদ্রা নদীর পানিতে বয় রক্তের বহর, ভদ্রা নদী হয়ে যায় লাশের নদী।’
প্রত্যক্ষদর্শী, যারা কোনোভাবে বেঁচে গেছেন, তাদের বয়ান এরকম : ওরা পশুপাখির মতো গুলি করে মানুষ মেরেছে, উন্মত্ত মাতালের মতো গুলি ছুড়েছে।
অসহায় হয়ে, মাটিতে শুয়ে সে দৃশ্য দেখতে হয়েছে আমাদের, ভাগ্যগুণে বেঁচে গেছি। শুধু এই নয়, সৈন্যদের নির্বিচার গুলি থেকে বাঁচতে বহু মানুষ নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঁচার আশায়। নদীতেও নির্বিচার গুলি চালায় উন্মত্ত সৈন্যরা- রক্তাক্ত হয়ে ওঠে নদীর জল। চারদিকে তখন কেবল লাশের স্তূপ, রক্তের স্রোত, যা নামতে থাকে নদীর পানিতে। বাতাস ভারী হয়ে ওঠে হাজারও নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধের আর্তনাদে।
।চুকনগর জেনোসাইড একটি পরিকল্পিত বাঙ্গালী গণহত্যা ছিল। যখন ঘোষণা করে একটি নির্দিষ্ট জাতিগত ও ধর্মীয় গোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করতে চাওয়া হয় তখন সেটি জেনোসাইড বলে বিবেচিত হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও ঠিক সেরকমটাই ঘটেছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু হত্যা ও ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হওয়া পাকিস্তান জাতীয়াতাবাদ প্রতিস্থাপন করতে গিয়েই এতসব রক্তপাত। চুকনগর গণহত্যাও এর ব্যতিক্রম নয়। যেহেতু চুকনগরের আশেপাশের এলাকায় বিপুল সংখ্যক হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করত তাই শুরুর দিকেই এই এলাকা রাজাকার আলবদরদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। বাংলাদেশের আর কোথাও যেহেতু এক এলাকায় এতো হিন্দু জনগোষ্ঠীর বসবাস নেই তাই মুসলিম লীগ নেতাদের একক দৃষ্টি পড়ে এই চুকনগর অঞ্চলে। আর তাই সময় সুযোগ বুঝে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ও তাদের বাংলাদেশীয় দোসররা ১৯৭১ সালের ২০ মে জেনোসাইডের ষোলকলা পূর্ণ করে চুকনগরের মাধ্যমে।
একটি এলাকায় এতো কম সময়ে এতো মানুষ আর হত্যা করা হয়নি। অথচ এত ভয়াবহ একটি ঘটনা নব্বই দশকের পূর্ব পর্যন্ত অধিকাংশ মানুষের কাছে ছিল অজানা। অবশ্য ১৯৭১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত এমন অনেক বধ্যভূমি ও গণহত্যার ইতিহাস রয়েছে যা জনসম্মুখেই আসেনি। এমনও অনেক স্মৃতিচিহ্ন আছে যেগুলো এখন বিলুপ্ত। দশ হাজারেরও বেশি