২০১৭-এর মে মাসে চীন সফর এবং ২০১৯ -এর সংক্ষিপ্ত রাশিয়া ভ্রমণের প্রেক্ষাপটে এই লেখা। দু বছর আগের চীন ভ্রমণ বৃত্তান্তের স্মৃতি রোমন্থন করতে গেলে স্বদেশের দীনতার জন্য লজ্জা বোধ হয়, শুধু আর্থিক ও সামরিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকার কারণে নয়—ইতিহাস চেতনা, সামাজিক শৃঙ্খলা, কর্তব্যপরায়ণতা, জাতীয়তাবোধ এবং প্রাচীন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি চীনাদের গর্ববোধ এবং অহংকার আমাকে বিস্মিত করেছে। হয়তো এ কারণেই, বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি প্রায় একই অবস্থান থেকে দৌড় শুরু করা ভারত-চীন এই দুটি দেশ আজ প্রায় শত যোজন দূরে। চীনের কুইনমিং শহর যেমন বিশ্বের সেরা কৃষি হাব, সাংহাই ওদের শিল্প বাণিজ্যকেন্দ্র, তেমনি প্রাচীন রাজধানী সিয়াং সংস্কৃতি ও কলা চর্চার পীঠস্থান, আর নতুন রাজধানী বেজিং রাজনৈতিক রাজধানী। বেজিংয়ে সাংহাইয়ের মতো মাথা উঁচু বহুতল কম দেখা গেলেও, বিশাল ঝাঁ-চকচকে চওড়া রাস্তা-ততোধিক প্রশস্ত ফুটপাথ (দখলমুক্ত), রাস্তার উভয়দিকে সুদৃশ্য ফুলের সমারোহ, কোথাও কোথাও পরিকল্পিত বন-সৃজন খুবই দৃষ্টিনন্দন। প্রায় ৫ কোটি মানুষের বসবাসের বেজিংয়ের রাস্তায় নােংরার ভূ প দূরস্থান—কোথাও একটি শুকনো পাতা বা সিগারেটের অবশিষ্টাংশ পড়ে থাকতে দেখা যায় না। সব সময়ই দেখা যাবে ঝুড়ি এবং চিমটে নিয়ে এক ধরনের সাফাইকর্মী রাস্তায়। টহল দিচ্ছে। এতে যেমন শহর দূষণমুক্ত থাকছে তেমনি প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হচ্ছে।
সমাজতান্ত্রিক গবেষকরা ভেবে দেখতে পারেন মাত্র কয়েক দশকের মধ্যে একটি উন্নয়নশীল দেশ কী ম্যাজিক বলে আর্থিক, সামরিক এবং বাণিজ্যিক বলে বলীয়ান হয়ে বিশ্বের এক মেরু শক্তিশালী দেশ আমেরিকাকে চোখ রাঙাচ্ছে? আর শুধু এটা চোখে দেখার জন্যই এই প্রতিবেদকের চীন ভ্রমণ। চীনা গাইড দু-সপ্তাহ ধরে শুধু এটাই বোঝাবার। চেষ্টা করেছেন যে তারা কোনও ক্ষেত্রেই ৫ নম্বর হতে চান না— ২০০৮ সালের অলিম্পিকে সে প্রমাণ চীন দিয়েছে। অতএব, অলিম্পিক স্টেডিয়াম এবং অংশগ্রহণকারীদের প্যারেড গ্রাউন্ড পর্যটকদের দেখিয়েই ওদের শান্তি। সাংহাইয়ের স্বল্প দূরত্বের ম্যাগনেটিক ট্রেন চাপিয়ে পর্যটকদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা রোজগার ওদের। বেজিং থেকে সাংহাই বুলেট ট্রেনে চেপে ওদের এগিয়ে চলার গতি অনুভব করা যায়। আর আমাদের মেট্রোর থেকেও সঠিক সময়ে হাজার মাইল দূরত্বে পৌঁছে পাওয়া যায় সময়ানুবর্তিতার নিদর্শন। আর যে বিষয়টি এই প্রতিবেদককে বিস্ময়বিহ্বল করেছে তা হচ্ছে ওদের শরীরচর্চা এবং শারীরিক সক্ষমতা। বেজিংয়ে, সিংয়াং বা সাংহাইয়ে যে সমস্ত নৃত্যকলা, থিয়েটার বা নৃত্যনাট্যের শো দেখেছি তা যেন অলিম্পিক জিমন্যাস্টিকের এক ঝলক। কৃষক-শ্রমিক, দেশরক্ষা বাহিনীর শারীরিক ক্ষমতা জাতীয় স্বাস্থ্য এবং গড় আয়ুবৃদ্ধি এসব ক্ষেত্রে শরীরচর্চার ভূমিকা রয়েছে।
এ বছর মে মাসে রাশিয়া সফরে গিয়ে দু’টি মহাদেশ জুড়ে অবস্থিত এক সময় সমাজতান্ত্রিক বুকের নেতৃত্বদানকারী মহাপরাক্রমশালী পৃথিবীর সর্ববৃহৎ দেশটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি শহর মস্কো এবং সেন্ট পিটার্সবার্গ ঘনিষ্ঠভাবে দেখার সুযোগ ঘটেছে। এই দেশটি শুধু জ্ঞান-বিজ্ঞান বা মহাকাশ গবেষণায় অগ্রগামী তাই নয়—কিছুদিন পূর্বেও পশ্চিমি ধনতান্ত্রিক দেশগুলির কাছে ত্রাসের কারণ ছিল। সে কারণেই জোটবদ্ধ হয়ে NATO গঠন করে আত্মরক্ষার তাগিদে। বহু ঐতিহ্যের ও সমৃদ্ধ ইতিহাসের সাক্ষী এই দেশটি প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। এদের শহর পরিকল্পনা, অতীতকে ধরে রাখার পদ্ধতি এবং আগ্রহ বোঝা যেত না, যদি না মস্কো এবং পিটার্সবার্গে বিভিন্ন মিউজিয়াম, বিভিন্ন চার্চ এবং পিটারহপ প্যালেস দেখার সুযোগ না ঘটতো। আর রাশিয়ায় সার্কাস দেখে যেন। অলিম্পিক জিমন্যাস্টিক-এর প্রতিচ্ছায়া ফুটে। উঠে, আর জীব-জানোয়ারের সংগ্রহ কেনিয়ার জঙ্গলের কথা মনে করাবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই ১৯৩৫-এ মস্কোয় মেট্রোর যাত্রা শুরু। কথিত আছে, যুদ্ধের সময় নগরবাসীকে আশ্রয় দেবার জন্য যে গভীর পরিখা খনন করা হয়, সেখানেই চালু হয় মেট্রো। মস্কোয় মেট্রোর চারটি তলা বা Layer রয়েছে, এবং রয়েছে বহু জংশন। কাউন্টার থেকে মেট্রোর টিকিট কিনে সর্বনিম্ন তলায় চলন্ত সিড়িতে নামার সময় মনে হচ্ছিল যেন প্রকৃতঅর্থে পাতালে প্রবেশ করছি। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যনন্দন চিত্রকলা, ভাস্কর্য দেখে মনে হচ্ছিল কিছুটা যেন দিল্লির অক্ষরধাম মন্দিরের মতো। ওদিকে পিটার্সবার্গে বল্টিক সাগরের উপকূলে অবস্থিত পিটারহপ প্যালেসের শিল্পকলা, ভাস্কর্য ভাষায় ব্যক্ত করা অসম্ভব—মনে হয় যেন সারা ইউরোপের সকল সম্পদ, মার্বেল পাথর, সোনা-দানা এখানে রাশিকৃত করা হয়েছে। তাছাড়া পিটার্সবার্গ শহরটিই হচ্ছে অপরূপা। এখানে শহরে পরিকল্পনা দেখে আমার বার বার ভেনিস শহরের কথা মনে পড়ছিল। আমাদের গাইডও একই কথা বললেন—পিটার্সবার্গের এক রাজপুরুষ ভেনিসের রাজকন্যাকে বিয়ে করে নিয়ে আসেন পিটার্সবার্গে। তিনি যাতে ভেনিসের স্মৃতি ভুলে যান, তাই নিভা নদী থেকে খাল কেটে কেটে শহরের ভিতরে অনেকটাই নৌচলাচল উপযোগী করা হয়। টুরিস্ট হিসাবে আমরাও বোটে চড়ে খাল থেকে নিভা নদীতে নৌবিহার উপভোগ করেছি। রাজকন্যাকে ধন্যবাদ তিনি শুধু শহরবাসীর উপকারই করেননি—আমাদের আনন্দের সুযোগ করে দিয়েছেন।
এবার আসা যাক—‘ওরা পারে অথচ আমরা পারি না কেন—এই বিতর্কে। এর কারণ বিশ্লেষণ (সবিস্তার) করতে গেলে ‘মহাভারত’ লিখতে হয়—সে পরিসর এখানে নেই। প্রথমত ভারতবাসী আজও একটি সুসংগঠিত এবং বলিষ্ঠ জাতি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেনি। কারণ ভারতীয় ঐতিহ্যের এবং সংস্কৃতির ধারক হিসাবে পরিচয় দিতে সব ভারতবাসী গর্ববোধ করে না। আমাদের পরিচয়ে জাতি-ধর্ম এবং আঞ্চলিকতা প্রাধান্য পায়। সার্বভৌম ভারতের অঙ্গরাজ্য কাশ্মীরে জাতীয়তার প্রশ্নে গরিষ্ঠাংশ মানুষ জবাবে ভারতীয় না বলে নিজেদের কাশ্মীরি বলবেন—এটা একটা উদাহরণ মাত্র। ভারতে বিচ্ছিন্ন মনোভাব দেশের নানা প্রান্তে কমবেশি রয়েছে, কোথাও সুপ্ত আবার কোথাও জাগ্রত। আমাদের দেশের অতি বামেরা ওই সুপ্ত বিচ্ছিন্ন চিন্তার প্রচার এবং প্রসারে আড়ালে-আবডালে কাজ করে যাচ্ছেন। সব দেখে শুনে মনে হবে—-ভারতবর্ষ যেন একটি Confederation of Nationalities-9 017816264 একটি জাতিতে পরিণত করতে দরকার রাশিয়ার পুতিনের মতো নেতৃত্ব যিনি প্রকৃত confederation থেকে দেশটিকে Russian Nation State এর দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। গত শতকের ৮০ দশকের শেষে রাষ্ট্রপতি গোর্বাচভের রাশিয়ায় প্রেইসট্রোক এবং গ্লাসনস্ত-এর মুক্ত হাওয়ার প্রভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া জাতিগুলির মধ্যে তাদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিচারের চিন্তা ভাবনা চলছে। চীন-রাশিয়া ভ্রমণকালে লক্ষ্য করেছি, দেশের জাতীয় স্মারকগুলির প্রতি ওদের উচ্ছ্বাস এবং বৃহৎ কিছু করার জন্য ওদের গর্ব। পাশাপাশি আপনি লক্ষ্য করুন, গুজরাটে পৃথিবীর সর্বোচ্চ প্যাটেল মূর্তি—এমনকী আমেদাবাদ-মুম্বাই বুলেট ট্রেন প্রকল্প নিয়ে নেতির রাজনীতি করা স্বঘোষিত নেতা এবং উদারপন্থার নামে জাতীয়তাবিরোধী এক ধরনের সংবাদপত্র যে ধরনের সমালোচনা করে যাচ্ছে তাতেই প্রমাণ হয় দেশটি এখনো Nation State হয়ে ওঠেনি সম্পূর্ণভাবে। জাপান-চীনের বুলেট ট্রেন হচ্ছে ওদের। অগ্রগতির এবং দক্ষতার ছাপ—আর ভারত বুলেট ট্রেনে টাকা খরচ করলে তা নাকি জাতীয় অপচয়, এই টাকা গরিবদের মধ্যে বাঁটোয়ারা করলে মাথা পিছু কত পায় তারই হিসেব কষেছেন কেউ কেউ। ভারতীয় ‘যোগ দিবস’ বিশ্বে বন্দিত হলেও কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশিকা অনেক রাজ্য সরকার কার্যকর করতে অস্বীকার করে—পশ্চিমবঙ্গ এ ব্যাপারে অবশ্যই অগ্রণী। অথচ ভারতীয় নিজস্ব সম্পদ—যোগ-ব্যায়াম জনস্বাস্থ্য সচেতনতা এবং শরীর গঠনে বিশেষ ভূমিকা নিতে পারে।
তা হলে ভারতের খামতি কি ঢিলেঢালা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়—যা কিনা কায়েমি স্বার্থ এবং জাতীয়তাবিরোধী শক্তিকে সাহায্য করছে— তদুপরি বিলম্বিত বিচার ব্যবস্থা। সকলেরই জানা আছে ‘Justice delayedJustice denied’-এই প্রবাদবাক্যটি। ভারতে বিচারের সমাপ্তি বলে কিছু নেই—উচ্চ আদালত থেকে মামলা সর্বোচ্চ আদালতে গেলে তা কখনো কখনো আবার নিম্ন আদালতে ফেরৎ পাঠাতেও দেখা যায়। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সামনে আজমল কাশভকে বন্দুক হাতে আক্রমণ করতে দেখার ছবি থাকলেও তার বিচারের সমাপ্তি অর্থাৎ ফাঁসিতে ঝোলাতে এক দশক পেরিয়ে যায়। অথচ কালোবাজারি, দুর্নীতি এবং দেশদ্রোহিতার দায়ে চীনে গড়ে প্রায় দু’হাজার অপরাধীর ফাঁসি হয়। কমিউনিস্ট রাশিয়ার পতনের পর রাশিয়ায় বর্তমানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই রয়েছে এবং ছোট-বড় ৪টি রাজনৈতিক দল রয়েছে। এমনকী চীনেও রয়েছে ছোট ছোট ৮টি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। যদিও সেগুলি কমিউনিস্টদের নিয়ন্ত্রণভুক্ত। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটিকে দেশবিরোধী প্রচার বা প্রসারে ব্যবহার করা যায় না। অধিকারের সাথে দায়িত্ব নিতে হয় নইলে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে হবে মানুষ এতটাই সজাগ। তাই বলে কি ওদেশে কোন ক্ষোভ-বিক্ষোভ, ষড়যন্ত্র বা বিদ্রোহ নেই? অবশ্যই আছে—তবে তা কখনো মাত্রা ছাড়াতে দেওয়া হয় না। রাশিয়ার চেচেন বিদ্রোহ বা চীনের উইঘুর বিদ্রোহ কঠোর হাতে দমন করা হয়। ভারতবর্ষে যেমন রাজ্যগুলিকে ক্ষমতার অংশীদারিত্ব দেওয়া হয় তেমনি, ও সমস্ত দেশেও প্রদেশ বা রিপাবলিকগুলিকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়। তার বাইরে ক্ষুদ্র জাতীয়তাবাদ বা বিদেশি এবং ধর্মীয় উস্কানিতে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেওয়া হয়। উদাহরণ স্বরূপ ২০১৩ সালের ৪ মে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের আইনসভায় দেওয়া ভাষণের একাংশ উদ্ধৃত করা হলো, রাশিয়া রাশিয়াবাসীদের জন্য। যদি অন্য কোথাও থেকে এসে এখানে সংখ্যালঘুরা বসবাস করে এবং রাশিয়ার খাবার খায় তাকে রাশিয়ার ভাষা জানতে হবে এবং রাশিয়ার আইন মানতে হবে। কেউ যদি শরিয়তি আইন চান তাহলে যে সমস্ত দেশে ওই আইন রয়েছে সেখানে চলে যেতে পারেন—আমরা তাদের খুশি করতে দেশের আইনের পরিবর্তন করব না। অথচ ভারতবর্ষে ভাষাগত সেতুবন্ধনের জন্য (হিন্দি তৃতীয় ভাষা) সূত্রের সুপারিশ হলে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রীর মাথা কাটার মতো লেকের অভাব হয় না। অথচ, ভাষাগত-সাংস্কৃতিক ঐক্যই ভারতকে আগামীদিনে শক্তিশালী ভারত হিসাবে অভ্যুদয় ঘটাতে সাহায্য করবে। মাতৃভূমির প্রতি অকপট ভালোবাসা, ঐতিহ্যে গর্ববোধ, রাষ্ট্রের সামর্থ্যের প্রতি আস্থাবোধ দেশের অগ্রগতি ত্বরান্বিত করবে।
পরিশেষে বলা ভালো, স্বল্প অভিজ্ঞতা নিয়ে কোনো বিজ্ঞের ভান না করেই চোখের দেখায় বলা যায় (কবির ভাষায়), যা দেখেছি, যা পেয়েছি তুলনা তার নাই’। এই প্রতিবেদকের মনে হয়েছে দুটি দেশই (চীন-রাশিয়া) উন্নতির উচচ শিখরে, অতিথি বাৎসল্য এবং পর্যটনবান্ধব দেশ হিসাবে উভয়ই নজির সৃষ্টিকারী। তবুও মনে হয়েছে চীনের উন্নয়নে মাথা উঁচুতে তোলার গর্ব আছে—আছে ঈর্ষা-শ্রেষ্ঠত্বের অহংকার। আর রাশিয়ার শতাব্দী পুরানো ইতিহাসে একটি সভ্যজাতির নিবেদনের ভাব ছাপ ছড়িয়ে রয়েছে সর্বত্র।
কে. এন. মণ্ডল
2019-06-29