জার্মান রক ব্যান্ড স্করপিয়নসের গান ‘উইন্ড অব চেঞ্জ’-এর কথা মনে আছে? স্করপিয়নস সেই ১৯৯০ সালে যে ‘হাওয়া বদলের’ কথা বলছিল, তা ছিল রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের পতনের প্রেক্ষাপটে। আরও ভালো করে বললে এ গান ছিল গ্লাসনস্তের প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার সঙ্গে পুঁজিবাদী পশ্চিমা দেশগুলোর গাঁটছাড়া বাঁধার আগমনী বার্তা। গানটি স্পষ্টত সারা বিশ্বের কাছে স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তি ও দুই মেরু বিশ্বকাঠামোর পতনের বার্তা হয়ে এসেছিল। শুধু গান কেন, বিশ্বরাজনীতির প্রতিটি বাঁকবদলের ইঙ্গিত পাওয়া যায় শিল্প-সংস্কৃতির অঙ্গনে। এটা সব সময় হয়ে এসেছে। এখনো হচ্ছে।
বৈশ্বিক রাজনীতি ও অর্থনীতির যেমন মেরু থাকে, তেমনি শিল্প-সংস্কৃতিসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতেও পাওয়া যায় মেরুর উপস্থিতি। এখনকার বিশ্বকাঠামোকে এক মেরু বলা হয়। মেরুটি চিনতে ভুল হওয়ার কথা নয়; যুক্তরাষ্ট্র। শুধু অর্থনীতি কেন, বিজ্ঞান, শিল্পের প্রতিটি মাধ্যমে এই যুক্তরাষ্ট্রই রাজত্ব করছে। দৃশ্যত এখনো একে সেভাবে কেউ চ্যালেঞ্জ করছে না। তবে চীনের দিকে তাকালে কিছু চিহ্নের দেখা মিলবে, যা কিছু পূর্বানুমানে উৎসাহিত করতে পারে।
চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য লড়াই লেগে রয়েছে অনেক দিন হলো। মুখ্যত এটিই এখন বিশ্বরাজনীতিতে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। কিন্তু কিছুটা আড়ালে শিল্পাঙ্গনে যা চলছে, তার দিকে তাকালে একটু বিস্মিত হতে হয়। চীন বর্তমানে আবার ইউরোপীয় শিল্পীদের দিকে মুখ ফিরিয়েছে। শুধু একজন শিল্পীর বিষয়ে চীনের আচরণ পর্যালোচনা করলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে।
গত শতকে এক পাবলো পিকাসোকে চীন গ্রহণ ও বর্জন—দুই–ই করেছিল। দুই–ই ছিল সমাজতন্ত্রের নামে। ইদানীং সেই পাবলো পিকাসোকেই আবার তারা সাদরে গ্রহণ করেছে। গত শতকের মাঝামাঝি সময়ে পিকাসোকে চীন গ্রহণ করেছিল শ্রমজীবী মানুষের পক্ষের শিল্পী হিসেবে। তাঁর ব্লু পিরিয়ডের (১৯০১-১৯০৪) কাজগুলোয় দুস্থ ও হতদরিদ্র মানুষের প্রতিকৃতি তাঁকে নিম্নবর্গের শিল্পী হিসেবে চীনে খ্যাতি দেয়। সে সময় চীনের অন্যতম শিল্পসমালোচক চেন শিওয়েন পিকাসোকে আখ্যা দিয়েছিলেন ‘চিত্রশিল্পের লেনিন’ হিসেবে। ১৯৪৪ সালে পাবলো পিকাসো যখন ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন, তখন এই উপাধি যেন একেবারে খাপে খাপে মিলে গেল। কিন্তু ১৯৬৬ সালে চীনে সাংস্কৃতিক বিপ্লব শুরুর পরই এ দৃশ্য বদলে যায়। পিকাসোকে তখন এই চীনেই আখ্যা দেওয়া হয় ‘সামন্তীয়’, ‘বিষাক্ত আগাছা’ বলে। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র পিপলস ডেইলিই তাঁকে এ আখ্যা দিয়েছিল।
পিকাসো বিষয়ে চীনের এ অবস্থান জারি থাকে সত্তরের দশকের শেষ পর্যন্ত। ১৯৮৩ সালে গিয়ে দেশটির ন্যাশনাল আর্ট মিউজিয়াম পিকাসোর কিছু মূল কাজ নিয়ে প্রদর্শনী করে। এরপর আবার চুপ। এখন আবার পিকাসোকে নিয়ে প্রদর্শনী হচ্ছে। তবে তা সরকারি অর্থায়নে নয়; বেসরকারি ও বিদেশি অর্থায়নে।
চীনের পিকাসোকে গ্রহণ ও বর্জনের মধ্যেই রয়েছে তার রাজনৈতিক অবস্থান বদলের ইঙ্গিত। বেইজিংয়ে সম্প্রতি পিকাসোর শিল্পকর্ম নিয়ে প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল সেন্টার ফর কনটেম্পোর্যারি আর্ট (ইউসিসিএ) নামের একটি প্রতিষ্ঠান। চীনে স্প্যানিশ এ শিল্পীর শিল্পকর্ম নিয়ে এটিই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় প্রদর্শনী। প্রদর্শনীর ক্যাটালগে চায়নিজ একাডেমি অব ফাইন আর্টসের শিল্পসমালোচক উ জুয়েশান তাঁর ‘বার্থ অব আ জিনিয়াস’ শীর্ষক প্রবন্ধে লেখেন, ‘চীনে পিকাসোর ভাবমূর্তির বিবর্তনই জাতি হিসেবে আধুনিক চীনের প্রতিবিম্ব।’
এ প্রদর্শনী আয়োজনের জন্য ইউসিসিএকে পিকাসোর ১০৩টি শিল্পকর্ম ধার দিয়েছিল প্যারিসের পিকাসো মিউজিয়াম। প্রদর্শনীটিতে চীনের সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ অনেকে এসেছিলেন। এসেছিলেন রাষ্ট্রস্বীকৃত বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে শিল্পরসিকেরাও। ইকোনমিস্ট জানাচ্ছে, সাড়ে তিন লাখের বেশি মানুষ এ প্রদর্শনী দেখতে এসেছিলেন। চীনা সংবাদমাধ্যমেও এর খবর বেশ গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করা হয়েছে।
সব মিলিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে আয়োজিত না হলেও এর প্রতি চীনের প্রশাসনের নজর যে খুব ভালোভাবে ছিল, তা আর না বললেও চলে। আর এটিই ইঙ্গিত দেয় বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে চীনের অবস্থান বদলের। আর এর সঙ্গে যখন যুক্ত হয়, এমানুয়েল ম্যাখোঁ ও সি চিন পিংয়ের মধ্যে এ ধরনের সাংস্কৃতিক বিনিময়ের সমঝোতার বিষয়টি, তখন এ ইঙ্গিতকে আর উড়িয়ে দেওয়া যায় না। গত জানুয়ারিতে ম্যাখোঁর চীন সফরের সময়েই এ ধরনের আলোচনা হয়েছিল দুই নেতার মধ্যে।
সম্প্রতি হওয়া পিকাসোর প্রদর্শনীটি ইঙ্গিত দেয় রক্ষণশীল চীন বিশ্বদরবারে নিজের ভাবমূর্তির বদল চায়। ইউরোপের সঙ্গে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মধ্য দিয়ে আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে নিতে চায়। এই চাওয়ার সঙ্গে তার অর্থনৈতিক সক্ষমতা, বাণিজ্যশক্তি, সম্প্রসারণপ্রবণতা, রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার—এই সবকিছুই যুক্ত। স্পষ্টত বিশ্বব্যাপী প্রভাববলয় সম্প্রসারণে শিল্প ও সংস্কৃতির বিনিময়কে চীন আরেকটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে। এখানে ইউরোপের প্রবণতাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। এত দিনের অভিন্নহৃদয় বন্ধু যুক্তরাষ্ট্র যখন চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ও ভূরাজনৈতিক যুদ্ধে লিপ্ত, তখন ইউরোপ চীনের সঙ্গে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে মুক্ত বিনিময়ের পথ খুলে দিচ্ছে। শুধু ফ্রান্স নয়, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে এ প্রবণতা দিন দিন প্রকট হচ্ছে। তাই বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতেই হচ্ছে।
এক মেরু হিসেবে আজ যেটা যুক্তরাষ্ট্র করছে সারা বিশ্বে, তার ভিতটি তো শুধু অস্ত্র ও অর্থবলের মাধ্যমে রচিত হয়নি। এই ভিতটি তৈরিতে যুক্তরাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি শিল্প-ধারণাও ব্যাপকভাবে কাজ করেছে। আজকের হলিউডের দিকে তাকালে এর প্রমাণ পাওয়া যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি রাজনীতিকদের মাধ্যমে যতটা প্রসার পায়, তার চেয়ে ঢের বেশি পায় তার চলচ্চিত্র, বই, শিল্পকর্মসহ নানা সাংস্কৃতিক উপাদানের মধ্য দিয়ে।
চীনের এ চেষ্টা শেষ পর্যন্ত কতটা সফল হবে, তা এখনই বলা সম্ভব নয়। চলতি শতকের শুরুর ধাপে রাশিয়া একই ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। পারেনি পশ্চিমের কারণেই। ২০০১ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত সময়ে রাশিয়া তার গ্যালারি ও জাদুঘরগুলোকে উন্মুক্ত করে দেয়। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ শিথিল করে দেয়। উদ্দেশ্য ছিল এর মাধ্যমে সারা বিশ্ব থেকে বিনিয়োগকারীদের রাশিয়ার প্রতি আকৃষ্ট করা। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের যে ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছিল, তা ভেঙে একটি মুক্ত সমাজের ভাবমূর্তি ধারণ করা। শুরুতে বেশ কাজে দিচ্ছিল। কিন্তু রাশিয়ার ভেতরে ভ্লাদিমির পুতিনের হাত ধরে কট্টরবাদ যত জেঁকে বসতে লাগল, ততই এটি হিতে বিপরীত হয়ে দেখা দিল। শিল্পমাধ্যমগুলোকে স্বাধীনচেতা মানুষ প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিল, যা আবার লুফে নিল পশ্চিমা মিডিয়া।
রাশিয়ার ব্যর্থ হওয়ার দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমটি তার ভেতরের কট্টর শাসনব্যবস্থা। দ্বিতীয়টি হচ্ছে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র সমাজতন্ত্র প্রশ্নে তাকে কখনোই বিশ্বাস করেনি। ফলে রাশিয়াকে ফিরে যেতে হয়েছে তার পুরোনো অবস্থানে। চীনের ক্ষেত্রেও একই বাস্তবতা অপেক্ষা করছে কি না, তা দেখার বিষয়। তবে চীন একটি জায়গায় এগিয়ে আছে। আর তা হলো তার বাজার ও বাণিজ্যশক্তি।
পুঁজির কেন্দ্র হিসেবে বহু বছর ধরে পশ্চিমারা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। এ প্রতিষ্ঠার জন্য নানা নামে, নানা উপায়ে সে নিজের ধারণাকে ফেরি করার জন্য প্রতিষ্ঠান গড়েছে। এ প্রতিষ্ঠানগুলোই পশ্চিম ও পশ্চিমা ভাবধারাকে নিয়ে গেছে বিশ্বের নানা প্রান্তে। এখন একই ধরনের প্রতিষ্ঠান গঠন, বহুজাতিক ও দ্বিপক্ষীয় পর্যায়ে সাংস্কৃতিক বিনিময়, নানা ধরনের শিক্ষাবৃত্তি ইত্যাদির মাধ্যমে চীন কাজ করছে। মধ্যপ্রাচ্যের বহু দেশের সঙ্গে এরই মধ্যে চীন বহু শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিনিময় সম্পর্কিত সমঝোতায় পৌঁছেছে, যা তার সম্প্রসারণ ইচ্ছারই বহিঃপ্রকাশ। চীনের এ লক্ষ্যকে এখন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা কীভাবে মোকাবিলা করে, তা-ই এখন দেখার বিষয়।