নৈহরবাঁ হমকো নঁহি ভাবে।।
সাঁঈ কী নগরী পরম অতি সুন্দর
জঁহ কোই জায় না আবে
চাঁদ সুরজ জঁহ পবন ন পানী
কো সন্দেশ পহুঁচাবে!
পরিপূর্ণতার দিকে নিয়ে যায় ব্রহ্ম কখনো নিরাকার আবার কখনো সাকার রূপে। তিনি কখনো চন্দ্র, সূর্য , পবন, জল ; আবার কখনো বৃক্ষ – লতা- পাতা- ঘাস, পর্বত, শিলারূপে অবস্থান করেন। মানব মন দেখেছ পরিপূর্ণতার স্বপ্নই, না ধরিত্রীতে না আকাশে না জলে সবেই সেই অখন্ড-মন্ডলাকারংকে , পরিপূর্ণতাকে প্রত্যক্ষ করেছে সে, অথচ তাকে পাওয়ার জন্য সাধনার কামনার অন্ত নেই।
ধর্ম , কর্ম, শিল্প সকল দিক দিয়ে পূর্ণিমার ব্রত পালন সাধক করে চেলেছে যুগ হতে যুগান্তরে। সেটাই তো অপরিপূর্ণতার আসনে বসে পরিপূর্ণতার পূজা। গত দুই পর্বে যে ব্রত কথা পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ ধর্মপুত্রকে বলেছিলেন , তার গূঢ় অর্থ তো তাই। জীবনে জন্মাবধি এই মৃত লোকে আমরা সকলেই দুঃখী।
“অমৃতের পুত্র মোরা’– কাহারা শুনাল বিশ্বময়।
আত্মবিসর্জন করি আত্মারে কে জানিল অক্ষয়।
দুঃখের অন্তিম তো আসে ঈশ্বরের পায়ে নিঃস্বার্থ ভাবে সব কিছুকে সমর্পন করলে। পূর্ণিমা ব্রত সারা বৎসর পালন করলে, পূর্ণিমা পূর্ণিমায় নারায়ণ পূজা করলে, লক্ষ্মী আরাধনা করলে, মহাবিদ্যাকে প্রাণ ভরে ডাকলে, চন্দ্রশেখরকে ডাকলে মন উজাড় করে কিন্তু যা বলতে চাইলে তা বলা হল না, যা জানতে চাইলে জানা হল না। কর্ম, ধর্ম, শিল্প দিয়ে সে সুর বাজল না। পরিপূর্ণ হল না ব্রতের উপাচার – তেমন পূর্ণিমা ব্রত করে কি মনে সুখ পাবে ব্রতধারী ?
চন্দ্রব্রতের যে কাহিনী পূর্ব দুই পর্বে আমি উল্লেখ করেছি, সেই কাহিনী বিন্যাস থেকে এটুকু ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, এই ব্রত ধান্যপূর্ণিমা ব্রত, আরাধ্য দেবতা শশাঙ্ক। এই যে ব্রত, এটি একসময় পূর্ববঙ্গে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। ব্রতকথার সূচনায় আছে সর্ব সিদ্ধিদাতা গণপতি বন্দনা প্রণাম, তারপর গুরুবন্দনা, সরস্বতী বন্দনা, শঙ্কর শঙ্করী বন্দনা, মাতৃ পিতৃ প্রণাম , রাম- সীতা বন্দনা , দুর্গা – কালী বন্দনা, রাধা – কৃষ্ণ বন্দনা , লক্ষ্মী – শিব বন্দনা।
তারপর আছে , এই জগৎহিতের জন্য দ্বাপরে শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাবের কথা। ন্যায়ধর্ম স্বরূপ নারায়ণ শ্রীকৃষ্ণ ন্যায়ের পক্ষে পাণ্ডবদের সঙ্গে অবস্থান করেছিলেন এবং যুদ্ধ শেষে যুধিষ্ঠিরকে উক্ত ব্রত কাহিনী বলেছিলেন।
এই ব্রতকথার বক্তা যেমন যাদবশ্রেষ্ঠ , তেমনি রচয়িতা বা কবির নাম – যাদবেন্দ্র বা যাদবকৃষ্ণ। ব্রতকথাটির গ্রন্থে কেবলমাত্র কবি বা কথকঠাকুর আর কোনো পরিচয় দেন নি। ব্রত পুস্তিকাটির ভাষা সহজ সরল এবং সকলের বোধগম্য যুক্ত। পুস্তকটি মুদ্রিত আকারে প্রাপ্ত হয়েছে। প্রথম দিকে নামপত্র না থাকায় এ সম্পর্কে অধিক কিছুই বলা যায় না। মাতাপিতাকে অসংখ্য প্রণাম জানাতে গিয়ে নিজেকে কবি #মূর্খপুত্র বলে উল্লেখ করেছেন। ব্রতের লেখনী বা ভাষা শৈলী দেখে মনে হয় এ কবির বিনয়ভাব।
উক্ত ব্রতপুস্তিকাটি বর্তমান বাংলাদেশের নোয়াখালি জেলার দেওপাড়া গ্রাম থেকে প্রাপ্ত। অতীতে এস্থানে পৌষ মাসের পূর্ণিমায় ধান্য পূর্ণিমা পালন করা হতো ব্যাপকভাবে তা ব্রত কথা থেকেই উপলব্ধি করা যায়। বলি রাজার পুত্রের রাজত্ব নদীমাতৃক বঙ্গে , যেখানে মানুষ পাখির ভাষায় কথা বলত, যেখানে কৃষি এবং বাণিজ্যে লক্ষ্মী বাস করতেন সেখানে ধান ওঠার পর পৌষ পূর্ণিমা বা ধান্য পূর্ণিমা পালন হবে এটাই স্বাভাবিক ব্যাপার।
অঘ্রাণে আমন ধান্যে মাঠ গেছে ভরে।
লক্ষ্মীপূজা করি মোরা অতি যত্ন করে।।
পৌষপার্বনে মাগো মনের সাধেতে।
প্রতি গৃহে লক্ষ্মী পূজি নবান্ন ধানেতে।।
মাঘ মাসে মহালক্ষ্মী মহলেতে রবে।
নব ধান্য দিয়া মোরা পূজা করি সবে।।
যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি তাঁর “পূজা- পার্বন” গ্রন্থে বলেছেন :
ষোলোশত বৎসর পূর্বে পৌষ – সংক্রান্তির দিন উত্তরায়ণ আরম্ভ হইত। পরদিন পয়লা মাঘ নূতন বৎসরের প্রথম দিন । সেদিন আমরা দেব- খাতে প্রাতঃস্নান করি। লোকে বলে #মকরস্নান।
পূর্বের দিন ছিল পৌষ মাসের শেষ দিন অর্থাৎ #মকরসংক্রান্তি ।গোটা পৌষ মাস জুড়ে গ্রাম- ঘরে যে টুসুগান গাওয়া হতো ,পৌষ সংক্রান্তির দিন সেই টুসু ঠাকুরের ভাসান হত। টুসু লৌকিক পূজা, তাই উপবাস বা মন্ত্রোচ্চারণ নেই । একটি মাটির সরায় গোবর এবং তুষ মিশ্রিত একটি পিন্ড রেখে তাতে চালবাটা পিটুলি দিয়ে চোখ মুখ ফুটিয়ে তোলা হত। একে তুষতুষালী ব্রতও বলা হয়। বছর দশেক আগেও চোখ মুখ ফুটিয়ে তোলা এই মূর্তিকে দেবী জ্ঞানে পূজা করা হত। এখনো কিছু কিছু জায়গায় হয়। তবে রঙিন মূর্তি দেখতে পাওয়া যায় অধিকমাত্রায়। টুসু হলেন লৌকিক রূপে দেবী লক্ষ্মী, তিনি ঘরের মেয়ে, শস্য উৎসবের সঙ্গে জড়িত। তাই তার ভাসান বা বিদায় হয় না। হয় পুনরায় ফিরে আসার এখ্যান। শস্যের পুনরুজ্জীবন বা পুনর্জন্মের আচার।
পরের দিন পয়লা মাঘ ,নতুন কৃষি বর্ষের সূচনা । তাই বৎসর সমাপ্তির দিন ঘরে ঘরে পিঠা-পায়েস , মাছ-মাংস , নতুন জামা কাপড় পরার কখনোই থাকত না যদি এটি বিসর্জনের উৎসব হত । এ এক আনন্দ উৎসব , ভগবান সূর্যনারায়ণকে কৃতজ্ঞতা জানানো। কৃষি কেন্দ্র করে এই আনন্দ উৎসব আজও থেকে গেছে সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে। সেখানে কেবল টুসু নয়, সারা ভারত জুড়ে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে সেই উৎসব অনুষ্ঠিত হয় । যেমন -তামিলনাড়ুর পোঙ্গল , মহারাষ্ট্রের তিলগুল, অন্ধ্রপ্রদেশের পেদ্দাপনদুগা, পাঞ্জাবের লোহরি, অসমের বিহু আর নবান্ন উৎসব। মকর সংক্রান্তি ব পৌষ সংক্রান্তি উৎসব আজকের শারদীয় দুর্গা পূজার মতোই অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ এবং চিত্তাকর্ষক , অতীত ভারতবর্ষ থেকে আজকের দিনেও।
অশোক কলিঙ্গ জয় করে তৌসলী এবং সমাপা নামক দুটি নগরীকে কলিঙ্গদেশের শাসনকেন্দ্র হিসাবে ব্যবহার করেন প্রসঙ্গত বলে রাখি এই তৌসলী বর্তমানে ধৌলী এবং সমাপা বতর্মানে জৌগড় নামে সুপরিচিত।
উক্ত দুই স্থানে নতুন গিরিশাসন পাওয়া যায় । কলিঙ্গের শাসনকার্যে নিযুক্ত কর্মচারী ও কলিঙ্গের নাগরিকগণের উদ্দেশ্যে বিশেষভাবে নির্দেশিত এই দুইটি অনুশাসনকে ঐতিহাসিক ও পন্ডিতেরা মনে করেন #কলিঙ্গেরস্বতন্ত্রগিরিশাসন । বলাবাহুল্য, দুইটি অনুশাসন বিশেষ একটি সময় পাট ও প্রচারের নির্দেশ আছে। দুটি অনুশাসনের শেষের অংশ দুটি আচার্য দীনেশ চন্দ্র সরকার মহাশয় অনুবাদ করেছেন-
” যেন মহামাত্রগণ প্রত্যন্তবাসীদের আমার সম্পর্কে আশ্বস্ত করার জন্য এবং তাদের মধ্যে ধর্মাচরণ বৃদ্ধি করার জন্য সবসময় এই লিপি অনুসরণ করে। এই লিপিটি তোমাদের সকলের চাতুর্মাসী এবং তিষ্যা নক্ষত্রের মধ্যবর্তী সময়ও সুযোগ পেলেই একা – একাও শুনবে। ( পঞ্চদশ মুখ্য গিরিশাসন : জৌগড়ার পাঠ )
প্রতি তিষ্যা নক্ষত্রে এই লিপিটির পাঠ তোমাদের সকলের শুনতে হবে। দুটি তিষ্যা নক্ষত্র যুক্ত দিনের মধ্যে সুযোগ ঘটলে মাঝে মাঝে তোমরা লিপিটি একা – একাও শুনবে । ( ষোড়শ মুখ্য গিরিশাসন : ধৌলির পাঠ )
“কলিঙ্গের স্বতন্ত্র গিরিশাসন” দুটি পাঠ করে আচার্য সুকুমার সেন তাঁর #বঙ্গভূমিকা গ্রন্থে উল্লেখযোগ্য মন্তব্য করেছেন । সেই মন্তব্য আলোচনা আমাদের নববর্ষ আলোচনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মতামত প্রদান করে থাকে –
অশোকের সময়েও ভাদু পরব ও পৌষ পার্বণ অনুষ্ঠিত হতো । তবে হয়তো সবটা এখনকার মতো নয় । আমাদের দেশের ফসল ওঠার সময় দুইটি – ভাদ্র ও পৌষ । তিথি ধরে হিসাব করলে দুই ই তিষ্যা ( নামান্তর পুষ্যা )। এই দুই মাসে এই তিথিতে লোকে উৎসব করত। অশোক বলেছেন যে, তাঁর এই অনুশাসন যেন ওই উৎসব উপলক্ষে এবং ইচ্ছা হলে যেকোনো দিন সকলে শোনে।
হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তিষ্যা সম্পর্কে বলেন , ” যাহাতে তিষ্যযুক্ত #পৌর্ণমাসী আছে ; পৌষমাস । ” পৌর্ণমাসী অর্থে আমরা বলি #পূর্ণমাস অর্থাৎ মাস পূর্ণ হল। আবার কেউ কেউ মনে করেন , #পূর্ণিমাতিথি । এ প্রসঙ্গে বলা যায় পুরনো দিনে মাস ছিল দু’ধরনের পূর্ণিমান্ত ও অমান্ত। এক পূর্ণিমা থেকে গণনা শুরু করে আরেক পূর্ণিমায় শেষ হলে পূর্নিমান্ত মাস। আর এক অমাবস্যা থেকে শুরু হয়ে পরের অমাবস্যায় শেষ হলে তাহলে অমান্ত মাস।
তবে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তিষ্যযুক্ত যে পৌর্ণমাসীর কথা বলেন, তা তিষ্যা নক্ষত্রের নিকট অবস্থানকারী চন্দ্রের পূর্ণিমা তিথি।
বলা বাহুল্য অশোক কথিত তিষ্যা নক্ষত্র পুষ্যা নক্ষত্র নামেও প্রচলিত ছিল বা আছে সেই অথর্ব বেদের কাল থেকে। মহাকাশে তিষ্য নক্ষত্রের যে তারকা পুঞ্জ আছে তা পুষ্পগুচ্ছের ন্যায় বলেই তার নাম পুষ্পা । এই পুষ্পা থেকেই পুষ্যানক্ষত্র এবং তা থেকে পৌষ একটি মাসের নাম হয়েছে।আর টুসুর অবয়ব তুষ দিয়ে গড়া। তিষ্য থেকেই বোধয় তুষ শব্দটির উৎপত্তি। তুষ অর্থাৎ ধানের খোসার চূর্ণিত রূপ।
মাঘাশুক্লাপ্রাপান্নাসায়া পৌয়াকৃষ্ণাসমাপিনাঃ।
যুগস্যা পঞ্চাবর্ষায়া কালজনানাম প্রকাশতে।।
অর্থাৎ পাঁচ বছরের একটি যুগের সূচনা হতো মাঘ মাসের শুক্লপক্ষে এবং এবং সমাপ্তি হতো পৌষ মাসের কৃষ্ণপক্ষে। জৈন সাধু ভদ্রবাহু অনেক কাল পরে #সূর্যপ্রজ্ঞপ্তি রচনা করেছিলেন।সেই গ্রন্থেও পাঁচ বৎসরকে যুগের পরিবর্তে উল্লেখ করতে দেখা যায়।আসলে পাঁচ বৎসর যুগগণনার এক মাত্র কারণ, প্রতি পাঁচ বৎসর অন্তর কুম্ভরাশির অন্তর্গত ধনিষ্ঠা নক্ষত্রে চন্দ্র ও সূর্যের মিলন ঘটে। এই টুকুই পাঁচ বছরের যুগ গণনার ভিত্তি।
অপ্রাসঙ্গিক হলেও একটি কথা এ প্রসঙ্গে আসে : প্রাচীন ঋষিগণ আকাশে চন্দ্র ও সূর্যের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে খুঁজে পেয়েছিলেন , প্রতি পাঁচ বছর অন্তর , কুম্ভরাশির অন্তর্গত ধনিষ্ঠা নক্ষত্রে উভয়ের মিলন হয়। চন্দ্র সূর্যের এই মিলন বলা বাহুল্য যুগ গণনার মূল কারণ। প্রতি পাঁচ বছরে ফাল্গুন মাসের অমাবস্যার দিন এই মিলন ঘটে।
কৃষকের ঘরে ধান উঠলে বৎসরান্তে খুশির মেলা বসে। সাময়িকের জন্য এই সমাজ দুঃখ ভোলে। এমনি করে তাদের দারিদ্র্য যাতে চিরকালের জন্য দূরীভূত হয় সে জন্যই এই ধান্যপূর্ণিমা বা পৌষ পূর্ণিমা তাঁরা পালন করতেন। ব্রহ্মাংশ অত্রি পুত্র চন্দ্র , পরমেশ্বর পরমেশ্বরী তাঁকে ধারণ করেন ,তিনিতাঁর আলোক তরঙ্গ দিয়ে মানবলোকের দুঃখের কথা অনন্ত লোকে পৌঁছে দেবেন , এটাই তো মূল কথা। ঈশ্বরকে পাবার জন্য চন্দ্রালোক হয়ে ওঠে সেতু বারবার।
কতকাল থেকে ধান্যপূর্ণিমা বা চন্দ্রপূজার ব্রত প্রচলিত তা এই পুস্তিকাতে উল্লেখ নেই। তবে চন্দ্র পূজা বৈদিক যুগ থেকে চলে আসছে। পৌরাণিক নানা কথায়ও পূর্ণিমা ও চন্দ্রপূজার কথা জানা যায়। একসময় যেমন – শৈব, বৈষ্ণব, শাক্ত , সৌর , গাণপত্য সম্প্রদায়ের ব্যাপকতা ছিল এবং এখনো আছে , তেমনি ব্রহ্মাণ্ডপুরানে উল্লিখিত অখণ্ড ভারত , ভদ্রাসবা, সিংহল, মহালঙ্কা, কুরু , আভারাত্না, সুভারিন্য, কেতু মালা, হরিণা, মান্দারা , রামানাকা এই নিয়ে গঠিত সম্পূর্ণ পৃথিবীতে চন্দ্র উপাসনার একটি চল ছিল। পুরানাদি যদি বাদও দিয়ে দি তবে, বর্তমান মানচিত্র অনুসারে চীন, মধ্যপ্রাচ্য ( মিশর , মরুময় আরব, সিরিয়া ) , গ্রীস, রোম, ব্রাজিল, আফ্রিকার নানা স্থানে চন্দ্র সম্প্রদায়ের নানাভাবে অবস্থান ও নানা পদ্ধতিতে চন্দ্র উপাসনা করা হতো। আপনারা “THE CULT OF THE MOON GOD – BRIAN WILSON” পড়ে দেখতে পারেন।
মুনিশ জব্দ জাওনে
খাইয়ে জব্দ দাওনে।
দাওন অর্থাৎ কৃষিলক্ষ্মীর স্নেহ আশীর্বাদ। দাওন শব্দের উৎপত্তি নিয়ে বেশ বিতর্ক আছে। এই দাওন পদ্ধতি কিন্তু কেবল বঙ্গে নয় , ভারতের সকল সনাতনী কৃষক পরিবারে প্রচলিত আছে। কেবলমাত্র ভারত কেন প্রাচীন যেকোনো দেশ বা অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে এই প্রথা প্রচলিত ছিল । এখনো ইউরোপ, পেরু, ব্রাজিল, মেক্সিকো , আফ্রিকা , বৃহত্তর ভারতের বহু অংশে বেশ কিছু মানুষ এই প্রথা অনুসরণ করেন। সুবিশাল ভারত ছাড়িয়ে মেক্সিকো , পেরু , আফ্রিকার মানুষজনও শারদ পূর্ণিমার রাত্রি পালন করেন। সেখানের প্রাচীন মানুষজন দেবী রূপে ভুট্টার ছড়াকে পূজা করেন। নানা খাবার রন্ধন করে তাঁরা শস্যদেবীর কাছে উৎসর্গ করেন। কোনো জায়গায় দেবীর উদ্দেশ্যে আগুন ঘিরে এলো চুলে মেয়েরা সারারাত নৃত্য করেন। ইতিহাস ঘাঁটলে এসব নিয়ে বিতর্ক ওঠে । অনেকে বলেন এসব মানুষজন হাজার হাজার হাজার হাজার বছর পূর্বে ভারতের দক্ষিণ উপকূল থেকে গিয়ে সেথায় বসত বেঁধেছিল। এখানে না হয় আলোচনা করলাম না সে সব বির্তক।
যাক, তো আলোচ্য ব্রতকথার পুস্তিকাটি হাতে লেখা নয় বরং মুদ্রিত অবস্থায় প্রাপ্ত হয়। তাই পুস্তিকার প্রাচীনত্ব গৌরব নিয়ে কোনো কথা বলা চলে না। তবে, এর বিষয় বস্তু বিচার করলে বোঝা যায় যে এই ধারণা কৃষিকার্যের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। সাধারণ গ্রামীণ জীবনে দারিদ্র্য নিত্যসঙ্গী। সেখানে কৃষি ও বাণিজ্য এরাই লক্ষ্মী আনে। কৃষক ফসল ফলালে খুদা মেটে , বস্ত্র উৎপাদন হয় এবং বাণিজ্যের পণ্য জোটে , এমনকি মাথা ছাওয়ার খড়টুকুও। আর পূর্বেই বলেছি , বেদে ও উপনিষদের গ্রন্থ প্রকৃতি , মন্ত্রের গরিষ্ঠ অংশ জুড়ে আছে আর্তি ও প্রার্থনা। সাধারণ জীবসহ মানবকুলের স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় অন্ন , বাসস্থানের সংস্থান এবং শত্রুর হাত থেকে নিজেকে রক্ষা এগুলিই ছিল প্রাচীন কালের মানুষদের প্রাথমিক ও প্রধান সমস্যা। এই প্রার্থনা ও আর্তিই বিভিন্ন রূপে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ পেয়েছে। তাই ঋগ্বেদের মন্ত্রের মুনি ঋষিগণ ছিলেন প্রার্থী। তাঁর সকল জীবের মঙ্গলের জন্য অর্থাথী ছিলেন। বেদ পরবর্তী যুগের একটা সময়ের পর থেকে পুনরায় সেই আর্তি প্রকাশিত হয়েছে নানা কথা, উপকথা , ব্রত , ছড়ার মাধ্যমে। এসবের মধ্যে দিয়ে আমরা গ্রাম্য বঙ্গ তথা ভারতের একটি বাস্তব পরিচয়, অসহায় আকুতির একটি নিখুঁত চিত্র খুঁজে পাই।
তবে, এই যে চন্দ্রব্রত বা ধান্যপূর্নিমার ব্রত, তা কেবলমাত্র ওপার বঙ্গেই প্রচলিত ছিল তা নয়। বরং এপার বঙ্গেও তা রীতিমতো জনপ্রিয় ছিল। ধান্যপূর্ণিমার ব্রত এপারে #ধানাইপূর্ণিমারব্রত নামে প্রচলিত ছিল। পৌষ মাসের পূর্ণিমায় এই ব্রত পালন করে #পূর্ণিমা_গোঁসাই – এর পুজো করতে হয়। ওই যে বললাম, স্থান – কাল – পাত্র ভেদে ব্রতের নিয়ম আচার, ব্রতকথা , ছড়া ইত্যাদি গুলোর পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু মূলভাবনা একই থেকে গেছে। পরের পর্বে ধানাই পূর্ণিমা ব্রতকথা বলব।
ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ চন্দ্র পূজার এক লৌকিক কাহিনী
(প্রবন্ধটি ঋতম্ বাংলায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত)