ইসলামিক তাত্ত্বিকগণ এবং বামপন্থী ইতিহাসবিদগণের অধিকাংশ মনে করেন যে, ইসলামিক সমাজব্যবস্থা বা মুসলিম সমাজব্যবস্থায় জাতপাত বলে কিছু হয়না।
হিন্দুশাস্ত্রসমূহে জাতিভেদপ্রথার গঠনগত কাঠামো ও উচ্চনীচ সোপান বিন্যাস যে রকম সুনির্দিষ্ট, মুসলমান সমাজের মধ্যে সে রকম ব্যবস্থা ইতিহাসবিদদের রচনায় খুঁজে না পাওয়া গেলেও বাস্তবে তাদের সমাজে জাতি- বর্ণপ্রথার অস্তিত্ব রয়েছে। জাতিপ্রথার যা প্রাথমিক উপাদান অর্থাৎ বৃত্তিনির্ভর বিশেষ জনগোষ্ঠী এবং সেই গোষ্ঠীর মধ্যেই বিবাহাদি সামাজিক কাজকর্ম প্রক্রিয়াকরণের সীমাবদ্ধতা, হিন্দুদের মতো মুসলমান সমাজেও সমভাবে বিদ্যমান। এর প্রধান কারণ এদেশের মুসলমানদের সর্বাধিক অংশই হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত।কিন্তু ধর্মান্তরিত হওয়া সত্ত্বেও তাদের পেশার বদল হয়নি। ধর্মান্তরিত হওয়ার আগে তারা যে পেশার উপর নির্ভর করে জীবন যাপন করত এবং যে জাতির সাহায্য দ্বারা এই পেশার দক্ষতা, কলাকৌশলের গোপনীয়তা ও পেশাধারীর নিরাপত্তা রক্ষিত ছিল,ধর্মান্তরিত হওয়ার পরেও সেই জাতির উপর নির্ভরশীলতা তাদের ফুরিয়ে যায়নি। মুসলিম সমাজে বৃত্তিনির্ভর জাতিভেদপ্রথা আজও টিকে আছে।
১৯২৭ সালে মহম্মদ ইয়াকুব আলি ‘মুসলমানদের জাতিভেদ’ নামক একটি পুস্তকে বাংলাদেশের মুসলমান সমাজে জাতিভেদপ্রথার বিস্তর আলোচনা করেছেন। জাতি বলতে মুসলমান সমাজে দুটি প্রধান বিভাগ – আশরাফ ও আজলাফ। প্রথমটি উচ্চশ্রেণী ( আরবের মুসলিম সমাজ) এবং দ্বিতীয়টি নিম্নশ্রেণী (ভারত)।আজলাফগণ বাংলাদেশে আতরাফ নামেও পরিচিত।আশরাফরা ৪ টি জাতিতে বিভক্ত- সৈয়দ,শেখ,মোগল ও পাঠান।পঞ্চম জাতি হিসাবে মুসলমান রাজপুতরাও নিজেদের আশরাফ পরিচয় দেন।
আজলাফ শ্রেণীতে নিম্নমর্যাদার অসংখ্য জাতি বর্তমান এবং পেশার গুরুত্ব অনুযায়ী জাতি কাঠামোয় তাদের মর্যাদার পার্থক্য সুনির্দিষ্ট।আজলাফ পর্যায়ের পেশাদার জাতিদের তালিকা নিম্নরূপ :
মোমিন(তাঁতী)বা জুলহা(জোলা),রংকি-কালাল(চোলাইকারী),দর্জি, খরাদি(ছুতোর মিস্ত্রী),কাসব(কসাই),চিক(ছাগল ও ভেড়ার মাংসের কারবারী),রাইও কারারিয়া( সবজি বিক্রেতা),বেসাতি( ফেরিওয়ালা), বেহনা বা মনসুরি( ধুনুরি), চুড়িহার বা মণিহার (চুড়ির প্রস্তুতকারক ও ব্যবসায়ী), নিকারী ( মৎস্যজীবী),দফালি( বাদক ও বাদ্যপ্রস্তুতকারক),নট বা নাট( চামড়ার বাদ্যযন্ত্র প্রস্তুতকারী ও ক্রীড়াকৌশল প্রদর্শক), হাজ্জাম বা নাই( নাপিত),মিরশিকর বা চিরিমার ( পাখী ধরা ও পাখী বেচার কারবারী),কালন্দর ( চুল,দাড়ি,ভুরু কামানো কম্বলাবৃত ফকির),ফকির বা শাহ্ বা শাহ্ ফকির( ভিক্ষোপজীবী এবং ভূমিশ্রমিক), পটুয়া( চিত্রকর),শেখজী বা ঘোষী এবং মেও( খাটালওয়ালা ও দুগ্ধ ব্যবসায়ী) , বাঞ্জারা ( যাযাবর),বেহেন কাসব( মিশ্রজাতি, কসাই,ধুনুরী),ভাঙ্গী বা লালবেগি ( ঝাড়ুদার, মেথর),ধোবী( রজক),গুর্জর( গোয়ালা),হালওয়াই( মিষ্টান্নপ্রস্তুতকারক),কাসগর( কুম্ভকার),নীলগর,লোহার( কর্মকার),শক্ক,মিরাশি( গায়ক),তেলি( তৈলকার),সোনার( স্বর্ণকার) প্রভৃতি।
আজলাফ পর্যায়ভুক্ত এইসব পেশাদার জাতিদের বিষয়ে জারিনা ভাট্টি বলেছেন যে এদের পেশার শ্রেণীবিভাগের ক্ষেত্রে ব্যাপক দুটি মানদণ্ড বর্তমান।প্রথমটি হচ্ছে পবিত্রতা – অপবিত্রতা অথবা পরিচ্ছন্নতা- অপরিচ্ছন্নতা বিষয়ে সামাজিকভাবে গৃহীত ধারণা বা পেশার বিষয়বস্তু বা ধরনের উপাদান পেশাধারী ব্যবহার করে সেগুলোর উপর নির্ভরশীল।দ্বিতীয় মানদণ্ডটি হচ্ছে পেশাটি বাস্তব ক্ষেত্রে আশরাফ শ্রেণীর কতটা কাছাকাছি। অর্থাৎ কায়িকশ্রমে নিযুক্ত আজলাফদের তুলনায় বুদ্ধিজীবী আজলাফদের সামাজিক মর্যাদা অনেক বেশি।
সিদ্দিকী বলেছেন যে,বাস্তবে শুধু যে আশরাফদের সাথে আজলাফদের বিবাহাদি সামাজিক সম্পর্ক স্থাপন নিষিদ্ধ তাই নয়,আজলাফদের মধ্যেও বৃত্তিধারী গোষ্ঠীগুলোর ক্ষেত্রে এক গোষ্ঠীর সাথে অপর গোষ্ঠীর বিবাহাদি সম্পর্ক স্থাপন নিষিদ্ধ।মোমিনের ছেলের সাথে মোমিনের মেয়ের বিবাহই স্বাভাবিক ও কাম্য।এমনকি বৃত্তির বদল ঘটে গেলেও বিবাহের সম্বন্ধের ক্ষেত্রে পূর্বপুরুষদের অনুসৃত বৃত্তিই বিবেচ্য। অসবর্ণ বিবাহ মুসলিম সমাজে নিন্দার চোখেই দেখা হয় এবং এই বিবাহজাত সন্তানকে সম্নানের চোখে দেখা হয় না। উচ্চবর্ণদের ক্ষেত্রে অনুলোম ও প্রতিলোম বিবাহ( প্রাচীন যুগে হিন্দুদের বিবাহরীতির মতো) প্রচলিত আছে,যেমন সৈয়দ ও শেখদের মধ্যে।কিন্তু এক্ষেত্রে বিবাহজাত সন্তান সৈয়দদের মর্যাদা পায়না।সৈয়দজাদা বা সেখজাদা নামে পরিচিত হয় এবং তারা অনুরূপ সংকরদের সাথেই বিবাহাদি সম্পন্ন করে।
এছাড়া মুসলিম সমাজে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে জাতিভেদপ্রথার অস্তিত্ব রয়েছে। প্রাচীনপন্থী সুন্নিরা ৪ টি সস্প্রদায়ে বিভক্ত – হানাফী,শাফেয়ী, মালেফী ও হানবালী।ধর্মের থেকে এদের মধ্যে মূল পার্থক্য আইন প্রয়োগ সংক্রান্ত ক্ষেত্রে।তবে সুন্নিদের সাথে শিয়াদের পার্থক্য অনেক বেশি এবং তা জাতি-পার্থক্যের নামান্তর।
নজমুল করিম বলেন যে,হানাফীদের মতে একজন আরব একজন অ – আরবের চেয়ে শ্রেষ্ঠ,এবং আরবদের মধ্যে কুরেশীরা শ্রেষ্ঠ।যারা আরবের নয় তাদের মধ্যে কোন মানুষ জন্মসূত্রে আররবদের সমতুল্য হতে পারে,যদি তার পিতা ও পিতামহ তার পূর্বে মুসলমান হয়ে থাকে। আরবের নয় অথচ শিক্ষিত এই রকম একজন লোক একজন অশিক্ষিত আরবের সমান।অর্থাৎ যেহেতু ভারত,পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের অধিকাংশ মুসলিম ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হয়েছে, তাই আরব মুসলিম সমাজে তাদের কদর নেই।মুসলিম সমাজে একজন মুসলমান কাজী বা তত্ত্বজ্ঞ একজন বনিকের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। একজন বণিক একজন সাধারণ ব্যবসায়ীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ। সুতরাং বুঝতে অসুবিধা হয়না যে,মুসলিম সমাজে জাতিপ্রথা মারাত্মকভাবে রয়েছে।
যেহেতু স্বাধীন ধর্মাচরণের ক্ষেত্রে মুসলিম সমাজে কোন বাধানিষেধ নেই,যেমন মসজিদে প্রবেশের অধিকার,নমাজ পাঠের অধিকার এইসব ক্ষেত্রে উচ্চ- নীচ বিচার করা হয়না,তাই ইসলামিক তাত্ত্বিকগণ প্রায়শই বলে থাকেন মুসলমান সমাজ সাম্যের ভিত্তিতে গঠিত, কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রটি কিন্তু অন্য।মুসলিম সমাজেও রয়েছে অস্পৃশ্যতা।ভারতে মুসলিমদের অস্পৃশ্যতা নিয়ে আলোচনা হয় না।ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যেও যে ‘অস্পৃশ্য’ বা ‘দলিত’ মুসলিম আছে— সেই তথ্যই উঠে এসেছে সাম্প্রতিক এক গবেষণায়।
গবেষক প্রশান্ত কে ত্রিবেদী, শ্রীনিবাস গোলি, ফাহিমুদ্দিন ও সুরিন্দর কুমার মিলে ভারতের ১৪টি জেলার মোট সাত হাজারের বেশি বাড়িতে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছেন।২০১৪ এর অক্টোবর থেকে ২০১৫ এর এপ্রিল পর্যন্ত ভারতের উত্তর প্রদেশে চলে এই গবেষণার তথ্য সংগ্রহ।
গবেষণায় যা উঠে এসেছে:
এলাকার ধনী প্রতিবেশীদের বাড়িতে কোনো বিবাহ অনুষ্ঠানে দলিত মুসলিমদের নিমন্ত্রণ করা হয় না।
কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে দলিত মুসলিমদের নিমন্ত্রণ করা হলেও তাদেরকে বসানো হয় আলাদা এবং তাদেরকে খাবার পরিবেশন করা হয় উচ্চবর্ণের মুসলিমদের খাওয়া শেষে। এমনকি কোনো-কোনো জায়গায় দলিত মুসলিমদেরকে ভিন্ন ধরণের প্লেটে খাবার পরিবেশন করা হয় বলেও উল্লেখ করেছেন গবেষণায় অংশ নেওয়া অনেক দলিত মানুষজন।
গবেষণায় অংশ নেওয়াদের মধ্যে অন্তত ৮ ভাগ দলিত মুসলিম জানিয়েছেন যে, তাদের শিশু সন্তানদেরকেও উচ্চবর্ণের শিশুদের চেয়ে আলাদা সারিতে বসানো হয়। এমনকি স্কুলেও দুপুরের খাবার গ্রহণের সময় তাদের সন্তানেরা আলাদা সারিতেই বসে।
উচ্চবর্ণের মুসলিমদের জন্য যে গোরস্থান রয়েছে সেখানে দলিতদের সাধারণত কবর দিতে দেওয়া হয় না বলে উঠে এসেছে এই গবেষণায়। তাদের জন্য রয়েছে আলাদা কবরস্থান। আর যদি কোনো দলিত কাউকে উচ্চবর্ণের কবরস্থানে গোর দেওয়া হয় তবে সেই লাশের জায়গা হয় একেবারে কোনো একটা কোণায়।
বেশিরভাগ মুসলিম একই মসজিদে নামাজ আদায় করলেও দলিত মুসলিমদের অনেকেই বলছেন যে তারা প্রায়সময়ই বোধ করেন তাদের প্রতি অন্যদের এক ধরণের উপেক্ষা বা বৈষম্য।
সাধারণত নিচু জাতের সব কাজ করাই দলিত মুসলিমদের কাজ বলেও মনে করা হয়।গবেষণায় অংশ নেওয়া অন্তত ১৩ ভাগ দলিত মুসলিম জানিয়েছে যে, উচ্চ বর্ণের কোনো মুসলমানের বাড়িতে যদি তাদেরকে খাবার বা জল দেওয়া হয় তাহলে তা পরিবেশন করা হয় ভিন্ন পাত্রে।
সুতরাং ভারতীয় হিন্দু সমাজের জাতপাত নিয়ে যারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমাজব্যবস্থাকে আক্রমণ করে থাকেন, তারা এইক্ষেত্রে কি মতামত ব্যক্ত করবেন?
…….সন্দীপ মুখোপাধ্যায়…….
গ্রন্থসূত্র :History of Bengal(p -433-435) prof, s Ghosh.
বিবিসি।
ছবিঃ সংগৃহীত (গুগল)।